স্মৃতিতে অমলিন দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান
প্রকাশিত : ১৯:১৬, ২০ অক্টোবর ২০১৯ | আপডেট: ১৯:২৯, ২০ অক্টোবর ২০১৯
সন্দ্বীপের মাটি ও মানুষের পরম আপনজন সাবেক সাংসদ দ্বীপবন্ধু মোস্তাফিজুর রহমানের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০১ সালের ২০ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে সেদিন সন্দ্বীপসহ সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।তার প্রয়াণে জন্মদাত্রী সন্দ্বীপ হারিয়েছিল তার প্রিয় সন্তানটিকে। সেদিন এই কৃতিসন্তানের শোকে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষের গগনবিদারী কান্না আর আহাজারিতে বাকরুদ্ধ হয়েছিল আপামর জনতা।
দ্বীপবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করা সত্যি কষ্টকর। তাঁর সঙ্গে মধুর স্মৃতিগুলো মনের আকাশে উঁকি দিচ্ছে বারংবার। আমি তখন খুব ছোট। একেবারেই শৈশবের কোলে। দাদু (উপমহাদেশের বিশিষ্ট শ্রমিকনেতা কাজী সাঈদ) আমাকে প্রায় সব অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন।১৯৯৯ সালের কথা, তখন চারদিকে দ্বীপবন্ধুর অনেক নাম ডাক। বাড়ির সামনে দিয়ে দ্বীপবন্ধুর জলপাই রঙের জিপ গাড়িটি যাওয়ার সময় আমরা দৌড় দিতাম, তাকে এক নজর দেখতে চাইতাম। সেসময় আমাদের কাছে তিনি একজন মহাতারকার মতই। ভীড়ের মধ্যে তাকে অনেকবার দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এ দেখায় কিছুতেই মন ভরতো না। এই ছোট্ট বয়সে দ্বীপবন্ধুর দেখা পেতে মনটা ভীষণ অস্থিরতায় ভুগতো। ইচ্ছে হতো তাকে ছুঁয়ে দেখি।
অবশেষে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এলো।১৯৯৭ সালের কথা। সন্দ্বীপ পাবলিক হাই স্কুলের মাঠে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। দাদু আমাকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে। লোকে লোকারণ্য মাঠ, যত দূর চোখ যায়, মানুষ আর মানুষ। বিকেলের ক্লান্ত আলো পেরিয়ে সন্ধ্যা আসন্ন। আমি দাদুর আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক ঘুরছি। একটু পর পর দাদুকে বারবার প্রশ্ন করছিলাম দাদু মোস্তাফিজ সাব কোথায়? তিনি বললেন, আসবেন। একটু পর মুস্তাফিজুর রহমানের গাড়ি স্কুলে এসে পৌঁছালো। হাজারো জনতা তাকে স্লোগানে স্লোগানে বরণ করে নিল। এরপর ধীরে ধীরে তিনি মঞ্চে এলেন। অনুষ্ঠানে মধ্যমণি মঞ্চে উঠলেন।
শীতের সন্ধ্যায় আমি মঞ্চে দাদুর কোলে বসে আছি। আমার সঙ্গে দ্বীপবন্ধুর পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে দাদুর কোল থেকে তাঁর কোলে তুলে নিলেন। শুরুতেই আমার নাম জানতে চাইলেন? আমি নাম বললাম। তারপর আমাকে বললেন তোমার গেঞ্জিতে কি লিখা আছে, সেটা পড়? সাথে সাথে পড়লাম। আমার গেঞ্জিতে লেখা ছিল congratulation বাংলায় এর অর্থ কী সেটা জানতে চাইলেন তিনি? উওরে বললাম, 'অভিনন্দন'। তিনি আমাকে বললেন তোমাকেও অভিনন্দন। এই বলেই আমার সঙ্গে হাত মেলালেন।
আমার মুখে তখন এত বড় কঠিন শব্দের উচ্চারণ এবং এর অর্থ শুনে কিছুটা অবাক হয়েছেন? অবাক চোখে তাকিয়ে তিনি বললেন, তোমাকে এই শব্দের অর্থ কে শিখিয়েছে? আঙ্গুল দিয়ে দাদুকে দেখিয়ে দিলাম। দ্বীপবন্ধুর পাশের চেয়ারে বসে থাকা বিশেষ অতিথি দাদুকে বললেন, কাজী সাহেব আপনার নাতি সঠিক অর্থ বলতে পেরেছে।
এই বলেই তিনি আমার সঙ্গে হাত মেলালেন। আমার দু'চোখ তখন তাঁর চোখে। তারপর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হাসি। তিনি জনতার দৃষ্টি ভুলে আমাকে নিয়ে মশগুল হয়ে গেলেন। এরপর তিনি আমাকে আদর দিয়েছেন, ভালোবেসেছেন, বুকে চেপে রেখেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শুরু হল। অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে মাল্যদান করা হয় দ্বীপবন্ধুকে। একই মঞ্চে থাকা দাদুর গলায় মালা পরিয়ে দেন দ্বীপবন্ধু। হঠাৎ করে দ্বীপবন্ধু আমাকে কোলে থেকে টেবিলে দাঁড় করিয়ে তার নিজের গলার মালাটা আমাকে পড়িয়ে দিলেন। দেহের চেয়ে মনে হচ্ছিল মালার ওজন অনেক বেশি। বড় মালা গলায় ঝুলছে আমার। আর তখন উৎসুক জনগণের মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দিত করছিলো। সেই করতালির শব্দ যেন এখনও কানে বাজে। সেই ছোঁয়া এখনও হৃদয়ে শিহরণ জাগায়।
এরপর দাদু আমাকে কোলে নিতে চাইলে তিনি দিলেন না। বললেন, থাক না আমার কোলে, ছোট মানুষ। ওর ঠাণ্ডা লাগছে। দ্বীপবন্ধুর তার গায়ের শাল দিয়ে আমার হাত পা মুড়ে রাখলেন। দাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে তিনি আমাকে একটার পর একটা কমলার কোষ আর বাদাম খাইয়ে দিলেন। দ্বীপবন্ধুর এই অকৃপণ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। ঘটে তার হৃদয়ের বিশালতার সঙ্গে। শিশু সুলভ দ্বীপবন্ধু সেদিন আমাকে চমকে দিয়েছিলেন।
ওনার গায়ের সাদা শাল দিয়ে আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। যত খানি তিনি জড়ালেন, মনে হয় যেন তার চেয়ে বেশি আমি ছড়িয়ে গেলাম তাঁর কাছে। মুগ্ধতার সঙ্গে, যেন ভালোবাসার আকাশের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটলো। আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান যে, দ্বীপবন্ধুর ভালোবাসা পেয়েছি। আসলেই মহৎ হৃদয়বান মানুষগুলো বোধ হয় এমনই হয়।
সেই কবেই শৈশবের স্মৃতিতে তুমি মিশে আছো। আজও অনুভবে, পরম আপন হয়ে। সেই অনুষ্ঠানের পরদিন আমার এলাকার মানুষজন পরম আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল মুস্তাফিজ সাব তোমাকে কি বলেছে? কি দিয়েছে? কথাটা আজও মনে পড়লে অজানা সুখে মন ভরে উঠে। তিনি যা দিয়েছেন তা আজও মনে রেখেছি। আমার মরণ অবধি এই সুখস্মৃতি মনে থাকবে। আমাকে পরম আনন্দ দিবে, শক্তি দিবে, আবেগে অশ্রুসিক্ত করবে। তাঁর কথা মনে হলে আমি ওনার পরশ অনুভব করি। অজান্তেই চোখ ভিজে আসে, হৃদয় কেঁপে উঠে।
ভাগ্যবান আমি, এক পরম ভালো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপরে অনেকবার তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখেছি। সেসব স্মৃতি আজও অমলিন। বাড়ির সামনে দিয়ে তোমার জলপাই রঙের জিপটি গেলে, মনে হতো এই তো তুমি?
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র মৃত্যুকে নিয়ে লিখেছেন–‘যে তারা জাগিয়া থাকে তারে লয়ে, জীবনের খেলা ভুবনের মেলা/যে তারা হারালো দ্যুতি/যে পাখি ভুলিয়া গেল গান/এ ভুবনে কোথা তার স্থান?
তোমার স্থান গণমানুষের হৃদয়ে, আমার হৃদয়ে, হাজার হৃদয়ে, লাখো মানুষের মনোমন্দিরে। তোমার নাম লিখা হয়ে গেছে সন্দ্বীপের ইতিহাসের সোনালী পাতায়। তুমি ঘুমাও,পরম মমতায় এই দ্বীপ তোমাকে ধরে রাখবে, মানুষ মনে রাখবে।
লেখক- সাংবাদিক