নবরাষ্ট্র পুনর্গঠন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু
প্রকাশিত : ১০:০১, ১৩ জানুয়ারি ২০২০
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অল্পদিনের জন্য অন্তরবর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১২ জানুয়ারি ১৯৭২। এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত হওয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিসভা গঠনের কাজটি করতে গিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ একদিনেই সম্পন্ন করা হয়।
১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শপথ নেওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ১১ সদস্যের মন্ত্রিসভার নাম দেন। এরআগে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ করেন।
এরপর একে একে মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, আবদুস সামাদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী, আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার ও ড. কামাল হোসেন। যে মন্ত্রিসভা ঘোষণা করা হয় সেখানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া তিন জন নতুন মন্ত্রীকে নেওয়া হয়।
শপথ গ্রহণের পর রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা রাতেই শহীদ মিনার এবং শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শপথ অনুষ্ঠানের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অন্যদের সঙ্গে নিয়ে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে যান। সেখানে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি সাংবাদিকদের বলেন, শহীদদের স্মরণে তার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিলো তারা আমাদের এই মুক্তির দিনটি দেখতে পেলো না।
প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পরে বঙ্গবন্ধু বলেন, যারা জনগণের ক্ষতি করেছে তাদের যথাযোগ্য শাস্তি পেতে হবে।
তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রধানমন্ত্রিত্বের ভার নিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গর্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি গত মার্চ মাসে আপনাদের বলেছিলাম, যখন আমরা মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিতে শিখবো তখন কোনও শক্তিই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
১৯৭০-এ পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার জন্য নির্বাচিত রাজনীতিবিদরা নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংসদ গঠন করেন। মুক্তিবাহিনী এবং অন্যান্য মিলিশিয়াদের নিয়ে নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়। তারই অনুরোধক্রমে ১৭ মার্চ ১৯৭২ ভারতীয় বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ত্যাগ করে।
বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টাইম ম্যাগাজিন ইউএসএ ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ প্রতিবেদনে প্রকাশ করে-
‘গত মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর বিশ্বব্যাংকের পরিদর্শকদের একটি বিশেষ টিম কিছু শহর প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, ওগুলোকে দেখতে ভুতুড়ে নগরী মনে হয়। এরপর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এহেন ধ্বংসলীলার ক্ষান্তি নেই। ৬০ লাখ ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ২৪ লাখ কৃষক পরিবারের কাছে জমি চাষের মতো গরু বা উপকরণও নেই। পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুল-কালভার্টের চিহ্নও নেই এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগেও অনেক বাধাবিঘ্ন। এক মাস আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত দেশের ওপর নির্বিচার বলাৎকার চলেছে। যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো (কার্যত প্রতিটি ব্যবসা ক্ষেত্রই পাকিস্তানিদের দখলে ছিল) তাদের সব অর্থ-সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেয়। যুদ্ধ শেষে চট্টগ্রামে পাকিস্তান বিমানের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭ রুপি জমা পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকার প্রকট সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে প্রাইভেটকারগুলো তুলে নেওয়া হয়, গাড়ির ডিলারদের কাছে থাকা গাড়িগুলো নিয়ে নেওয়া হয় এবং এগুলো নৌবন্দর বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেওয়া হয়।’
বঙ্গবন্ধু তার বাঙালির স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তাকে সর্বজনীন করে তোলার জন্য বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধে জাগিয়ে তোলার ব্রত গ্রহণ করেন। ‘আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা’ এই কথাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার অনেক আগে থেকেই তিনি সোচ্চার কণ্ঠে প্রচার করতে থাকেন। ৬ দফা আন্দোলনকালে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ এবং ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি স্লোগান মাত্র ছিল না। এসব উচ্চারণের ভেতর দিয়ে বাঙালির মানসলোককে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে মাতোয়ারা করে তোলা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু এসে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, একটি দেশ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুয়ায়ী, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ইউরোপে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল বাংলাদেশে। দেশের দুটো বন্দরই ছিল অচল। সব রেললাইন অকেজো। সব সেতু ভাঙা। এই অবস্থায় একটা দেশকে গড়ে তোলা দুরূহ কাজ। এখানে অবধারিতভাবে আর্থিক দৈন্য, খাদ্যাভাব ও সংকট—এগুলো দেখা দেয়। কখনো খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষও হয়। চীন, রাশিয়ায় এমন হয়েছে। অন্য যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সব জায়গারই ছিল এক অবস্থা।
তবে বঙ্গবন্ধু তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জাতিকে নিজের মর্যাদার আসনে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও চিন্তা চালিয়ে যেতে লাগেন। কিভাবে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্নির্মাণ করা যায়, তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিতে থাকেন।
এসএ/