স্বাধীনতা রক্ষায় সুশৃঙ্খল ও সজাগ থাকুন
প্রকাশিত : ১৫:১৭, ৫ মার্চ ২০২০
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: সংগৃহীত
১৯৭২ সালের ৫ জুলাই কুমিল্লা সেনানিবাসে জওয়ানদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মহান বীর সৈনিকদের প্রতি তাঁর আস্থার কথা জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় চরম আত্মত্যাগের জন্য তারা সদাপ্রস্তুত থাকবে। স্বাধীনতা নস্যাতের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সদাসজাগ থাকার জন্যেও তিনি জওয়ানদের প্রতি আহবান জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সশস্ত্রবাহিনীকে সর্বদা জনগণের পাশে থাকার আহ্বান জানান। সশস্ত্রবাহিনী জনগণের সাথে থেকেই স্বাধীনতার গৌরবময় যুদ্ধ করেছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এ চার রাষ্ট্রীয়নীতির প্রতি আস্থা রেখে তারা জনগণের সেবার জন্য প্রস্তুত থাকবে, জনগণের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রশাসন কর্তৃপক্ষের প্রতিও তারা অনুগত থাকবে। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের একথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী হলো জনগণ।
বঙ্গবন্ধু ময়মনতি সেনানিবাসে ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজে ভাষণ দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন এটাই প্রথম। এখন পর্যন্তও ‘বহুশক্তি আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে চায়’ বলে বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে জওয়ানদের সতর্ক থাকতে বলেন।
দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর সশস্ত্র বাহিনী আত্মত্যাগের জন্য তৈরি থাকলে এসব দুশমনিতে কোন ফল হবে না বলে বঙ্গবন্ধু গভীর আস্থা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আত্মত্যাগ ছাড়া কোন জাতিই সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে না, আর বিরাট আত্মত্যাগের মাধ্যমেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। তাই, তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর কেউই বানচাল করতে পারবে না। টিকে থাকার জন্যই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে বলেও তিনি জানান।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সেনাবাহিনী জাতির প্রতি ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের যে মহান ঐতিহ্য স্থাপন করেছে তা থেকে তারা বিচ্যুত হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর গভীর আস্থার কথা প্রকাশ করেন। এ সময়ে জওয়ানরা প্রচণ্ডভাবে হাততালি দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ’ ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু সৈনিকদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া বিশেষ কোন জাতিই তাদের মহত্ব অর্জন করতে পারেনি। বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে নিয়মানুবর্তিতা একান্তভাবে প্রয়োজন। নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া জাতির ঐক্য-সংহতি বিপন্ন হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাঙালিদের বীরত্ব ও যুদ্ধ করার দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, মুক্তিবাহিনী, পুলিশ ও জনগণের অবদান, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি তাদের বলেন, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য করত আর বাঙালি জাতিকে দাস হিসেবে ব্যবহার করত।
১৮৫৮ সালে যে বাঙালিরা ব্যারাকপুরে প্রথম বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন, সেই যোদ্ধা বাঙালিদের সম্পর্কে ভীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে শত শত বছর আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখে। আর পুরাতন প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসারী ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি চক্রের অবস্থাও দাঁড়ায় তাদের প্রভুদেরই মতো। বাঙালিরা যোদ্ধা জাতি নয়, এ ভাঁওতা তুলে তারা উভয়েই বাঙালিদের সেনাবাহিনী হতে দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু গত যুদ্ধে সে ভাঁওতা চিরদিনের মতো নির্মূল হয়ে গেছে। তাই, তিনি চান যে, এখন থেকে সশস্ত্র বাহিনী জনগণকে সেবা করার ঐতিহ্য গড়ে তুলবে।
বর্তমান সেনাবাহিনীর সাজসরঞ্জাম ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা আশানুরূপ নয়, একথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বর্তমান মুহূর্তে এছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ, দেশের আর্থিক সঙ্গতি বর্তমানে বিরাট বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তিনি সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তাদের একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, যে গ্রাম থেকে তারা এসেছে, সে গ্রামেই তাদের পিতামাতারা রয়েছেন। তারা সেখানে এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করছেন। প্রথমে তাদের সে অবস্থার প্রতিকার করতে হবে।
অতপর, প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড হাততালির মধ্যে চারটি রাষ্ট্রীয়নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যাদান করেন। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, পাকিস্তানিরা চেয়েছিল, বাঙালিরা আগামী ২৫ বছরের মধ্যেও নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারবে না। গত ছয় মাসকালেই তাদের এ গর্ব যে শুধু ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তাই নয়, পাকিস্তানের অবস্থাই বরং তদ্রুপ দাঁড়িয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু সেনানিবাসের নিকট কোটারীতে বাংলাদেশ বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন, তাদের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু চোরাচালান বন্ধের জন্য সীমান্তের কড়া প্রহরার আহ্বান জানান।
তথ্যসূত্র : এই দেশ এই মাটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের বক্তৃতা, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার নিয়ে রচিত।
এএইচ/