বিমুগ্ধ জাপানিদের সৌরভিত নাম রাধাবিনোদ পাল
প্রকাশিত : ১৬:৫০, ১০ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১৬:৫১, ১০ মার্চ ২০২০
যে ক’জন ক্ষণ জন্মা বাঙালি দেশ ও জাতির সীমা না ডিঙিয়ে বিশ্ব দরবারে উচ্চাসনে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষারে লিখিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিচারপতি রাধাবিনোধ পাল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার জগদীস চন্দ্র বসু, সত্যজিৎ রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, অমর্ত্য সেন, ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ বিদগ্ধ বাঙালি নিজেদের প্রজ্ঞা, বিদ্যা-বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান-গরিমা, সাহস ও দূরদৃষ্টি দিয়ে বাংলাভাষা, কৃষ্টি- কালচার, শিল্প-সাহিত্য, বাঙালি জাতিসত্ত্বা তথা বাংলা ভাষা অধ্যুষিত মানুষের ভূ-খণ্ডকে তুলে ধরেছেন মর্যাদার আসনে। তাঁদের নাম আমরা অনেকেই জানি। তাঁদের নাম বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হলেও বিচারপতি ডক্টর রাধাবিনোদ পালের নাম অনেকটা অবহেলায় অজানা অধরায় থেকে গেছে।
ডক্টর রাধাবিনোদ পাল ছিলেন (২৭ জানুয়ারি ১৮৮৬ - ১০ জানুয়াারি ১৯৬৭) একজন বাঙালি আইনবিদ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দূরপ্রাচ্যে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারার্থে স্থাপিত আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘জাপান-বন্ধু ভারতীয়’ বলে খ্যাতি রয়েছে তাঁর। আমরা বিমুগ্ধ জাপানিদের সৌরভিত নাম, বিচারপতি ডক্টর রাধাবিনোদ পালের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন,অবদান ও তাঁর সৌরভিত অধ্যায়ের গৌরবগাঁথা নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরবো।
প্রাথমিক ও শিক্ষাজীবন:
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের সালিমপুর মৌজার তারাগুনিয়া গ্রামে, মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। এলাকাটি এখন জজপাড়া নামে পরিচিত। তাঁর পিতার নাম বিপিন বিহারি পাল। তার প্রাথমিক জীবন চরম দারিদ্রের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের ছাতিয়ান গ্রামের গোলাম রহমান পন্ডিতের কাছে তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। কুষ্টিয়া হাইস্কুলে তিনি মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত লেখা-পড়া করেন। ১৯২০ সালে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও ১৯২৪ সালে রাধাবিনোদ পাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল Hindu Philosophy of Law in Vedic and Post-Vedic Times Prior to the Institute of Manu.
কর্মজীবন:
১৯১৯-২০ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে তার কর্মজীবনের শুরু। ১৯২৫-১৯৩০ মেয়াদে এবং পরবর্তীতে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে অধ্যাপনা করেন। পরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগদান করেন। ১৯৪১-৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৪-৪৬ মেয়াদে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে তিনি ইউনিভার্সিটি ল কলেজে আইনের অধ্যাপক ছিলেন। আইন বিশারদ হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তিনবার মর্যাদাপূর্ণ Tagore Lwa Lecture প্রদান করেন, প্রথমবার ১৯২৫ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৩০ সালে এবং তৃতীয়বার ১৯৩৮ সালে। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল Law of Primogeniture with Special Reference to India, Ancient and Modern; History of Hindu Law in the Vedic and Post-Vedic Times Down to the Institutes of Manu; Crimes in International Realtions.
ডক্টর রাধাবিনোদ পাল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অব কমপ্যারাটিভ ল’-এর যুগ্মসভাপতি এবং ১৯৩৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হন। আইন বিশারদ হিসেবে তিনি এতোটাই খ্যাতিমান হন যে, ১৯৪১ সালে তাঁকে ভারত সরকারের আইন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। এর অল্প কিছুদিন পর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ১৯৪৩ সালের জুলাই পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে রাধাবিনোদ পাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন সলিমপুররে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।
টোকিও ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি
গ্রামের বাড়ি সলমিপুরে অবস্থানকালে একটি ঘটনা তাঁকে তাঁর জীবনের এক অচিন্তনীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে রাধাবিনোদ পাল দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতি হিসাবে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। তাঁর ভিন্নমতের রায় যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র শক্তির কাছে পছন্দসই ছিল না, তথাপি এ ভূমিকাই তাঁকে বিজিত ও পরাধীন এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোর কাছে বীরের জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে জাপানের আত্মসমর্পণের পর মিত্রশক্তি তাদের বিবেচনায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধে জাপানের সম্পৃক্ততা এবং বিশ শতকের ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে জাপানে সমরবাদের উত্থানের জন্য যেসব জাপানি নেতা ও জেনারেল দায়ী ছিলেন তাদের বিচারের আয়োজন করে। মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক ডগলাস ম্যাক আর্থার পটস-ডাম ঘোষণা দ্বারা অর্পিত ক্ষমতাবলে দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে এই ট্রাইব্যুনালে জাপানের প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় (১৯৪৬-১৯৪৮) এবং তাতে জাপানের আটজন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড এবং আরও সতের জনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনে সর্বমোট ১১ জন বিচারককে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ সদস্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে জাপানি নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করেন এবং আন্তর্জাতিক আইনে তাদের সাজা দেন। কিন্তু এ ট্রাইব্যুনালের ভারতীয় বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশের রায়ের সাথে একমত হতে পারেননি। তিনি ভিন্নমত পোষণ করে একটি রায় প্রদান করেন এবং অধিকাংশ বিচারকের রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর দীর্ঘ আটশত পৃষ্ঠার রায়ে রাধাবিনোদ পাল দেখিয়েছেন যে, বিবাদী পক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো আইনের চোখে টিকে না। তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, সব সাক্ষ্য প্রমাণাদি খুবই দুর্বল এবং তাতে বিজয়ীদের দৃষ্টিভঙ্গী ও খেয়ালখুশির প্রতিফলন ঘটেছে।
দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি রাধাবিনোদ প্রদত্ত ভিন্নমত পোষণকারী রায়টি একদিকে আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসে এবং অন্যদিকে যুদ্ধ ও শান্তির ইতিহাসে অসাধারণ গুরুত্ব বহন করে। এতে যুদ্ধ ও শান্তির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতিহাসের আইনগত ভিত্তির দালিলিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ডক্টর রাধাবিনোদের ভিন্নমত পোষণকারী রায়ের মূল প্রশ্ন ছিল, যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করার এবং নিজেদের শর্তানুযায়ী পরাজিত শত্রুদের বিচার করার নৈতিক ও আইনগত এখতিয়ার আছে কিনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনে জাপানের কোনো ভূমিকা ছিল না।
বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল বিজয়ী পক্ষের একতরফাভাবে প্রণীত বিচারের দিক নির্দেশনা ও বিধি নিয়ম দ্বারা চালিত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। নেদারল্যান্ডের একজন এবং ফিলিপাইনের একজন বিচারপতি রাধাবিনোদকে নৈতিক সমর্থন যুগিয়েছিলেন যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রদত্ত রায়কে মেনে নিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ বিচারক রাধাবিনোদ পালের ভিন্ন মতের রায়কে এশিয়ায় ইউরোপীয় আধিপত্যের বিরোধী একজন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীর পাশ্চাত্য বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যায়িত করেন। রাধাবিনোদ পালের আরও বক্তব্য ছিল এই যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে বিকাশ লাভ করা আন্তর্জাতিক আইনের বেশিরভাগই টোকিও ট্রাইব্যুনাল আমলে নেয়নি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাধাবিনোদ ও উপাধি গ্রহন:
বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল টোকিওর যুদ্ধাপরাধ বিচারের পর কয়েক বার জাপান সফর করেন। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি জাপানের স্বনামধন্য মানবতাবাদী ইয়াসাবুরো শিমোনাকার আমন্ত্রণে জাপান গমন করেন এবং সে দেশের বিভিন্ন সমাবেশে শান্তির উপর বক্তব্য প্রদান করেন। ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্ব ফেডারেশন ও ন্যায় বিচার বিষয়ক এশীয় সম্মলেনে তাঁকে সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সম্মলেন শেষে হিরোশিমা শান্তি ঘোষণা গৃহীত হয়। জাপানের নিহন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক LL.D উপাধিতে ভূষিত করেন।
জাপানের সম্রাট তাঁকে First Order of the Secret Treasure উপাধিতে ভূষিত করেন। টোকিও এবং কিয়োটো শহরের মেট্রোপলেসি গর্ভনরগণ তাঁকে এই দুই নগরীর Freedom of the City of Toïo and Kzoto প্রদান করে সম্মানিত করেন। এ সময়ে (১৯৫২-১৯৬৬) বিচারপতি রাধাবিনোদ জাপানি মন্ত্রিসভায় এবং টোকিও ও ওয়াসদো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেন।
১৯৫২ সালে ডক্টর রাধাবিনোদ পাল জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৪ সালে কমিশনের দ্বিতীয় ভাইস চেয়যারম্যান এবং ১৯৫৮ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে পুনরায় তিনি কমিশনের ও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তাঁকে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক নির্বাচিত করেন। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাঁকে Jurisprudence- এর জাতীয় অধ্যাপক নিয়োগ করেন। একই বছর তিনি আমেরিকান সোসাইটি অব ইন্টারন্যাশনাল ল’য়ের সদস্য নির্বাচিত হন।
তার রচনাবলী:
ডক্টর রাধাবিনোদ পাল রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে The Hindu Philosophy of Lwa in the Vedic Age; Lwa of Limitation; The Lwa of Income Tax; Lwa of Primogeniture (With special emphasis on India); Crimes in International Relationses The History of Hindu Lwa in the Vedic Age.
শেষ কথা:
ডক্টর রাধাবিনোদ পালকে (২৭ জানুয়ারি ১৮৮৬ - ১০ জানুয়াারি ১৯৬৭) জাপানের ইতিহাসে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। জাপানের টোকিও শহরে তার নামে রাস্তা, কিয়োটো শহরে রাস্তা, জাদুঘর, সড়ক ও স্ট্যাচু এবং জাপান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রিসার্চ সেন্টার রয়েছে। তিনি আইন সম্পর্কিত বহু গ্রন্থের রচয়িতা। টোকিও ট্রায়াল টেলিসিরিয়ালটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের ট্রায়াল নিয়ে নির্মিত হলে তার চরিত্রে অভিনয় করেন ভারতীয় অভিনেতা ইরফান খান। বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল ১৯৬৭ সালরে ১০ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক-সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব