ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

৭১’র যুদ্ধশিশুদের জন্য নিবেদিত প্রাণ মুস্তফা চৌধুরী

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ২৩:২৯, ১৮ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১৬:৩১, ১৯ মার্চ ২০২০

মুস্তফা চৌধুরী

মুস্তফা চৌধুরী

অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের পরই পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের খড়গ চলে লাখ লাখ নারীর উপর। পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলাদেশের নারীদের ধর্ষণ করে। তারপর অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ বলা হয়।

অনেক পরিবার সেসব সন্তানদের গ্রহণ করেনি। তাদের ঠাঁই হয়নি এ দেশের স্বাধীন মাটিতে। সে সময় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশ যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এসব যুদ্ধশিশুদের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে রচিত হয় একটি বই-’৭১ এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস। গবেষণামূলক বইটির রচয়িতা মুস্তফা চৌধুরী।

মুস্তফা চৌধুরী ১৯৭২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে কানাডায় পাড়ি জমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে কয়েক মাস তিনি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি কানাডার ওয়েস্টার্ন অনটালিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান এবং কারলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কানাডিয়ান হিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ৩৪ বছর ধরে কানাডার ওটোয়াতে সেদেশের সরকারী চাকরি করেন। তিনি দেশটির সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কর্মসংস্থান এবং ইমিগ্রেশন, কানাডার মানব সম্পদ বিভাগ, কানাডার স্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে চাকুরি করেছেন। ২০১১ সালে তিনি চাকুরি থেকে অবসর নেন। মুস্তফা চৌধুরী গ্রন্থগার ও আর্কাইভে কাজ করার সময় মূলত বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের উপর গবেষণা শুরু করেন।  

মুস্তফা চৌধুরী মূলত গবেষণা শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের যেসব দেশ ও জাতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে সহযোগীতা করেছিল সে ক্ষেত্রে কানাডার ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরতে। কাজ শুরু করার অল্পদিনের মধ্যেই কিছু চাঞ্চল্যকর দলিলপত্রের সন্ধান পান তিনি। এ দলিলপত্রে ৭১‘র ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কানাডীয়দের উদ্যোগ, পরিশ্রম ও ত্যাগের প্রমাণ। সেসব নথিপত্র রয়েছে কানাডীয় কেন্দ্রীয় সরকারের ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়, প্রাদেশিক সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মাদার তেরেসার আশ্রম ‘শিশু ভবন’ এবং জেনেভাস্থ ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল সার্ভিসেসের নিজ নিজ রেকর্ডস অফিস ও আর্কাইভসে।

যুদ্ধশিশু শামা জামিলা ঢাকার মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে- সংগৃহীত

মুস্তফা চৌধুরীর ৭১ এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস বইটি বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও কানাডায় পাওয়া বিভিন্ন প্রামাণিক দলিলের ভিত্তিতে লেখা। এতে বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের জন্মকথা থেকে শুরু করে এখন তারা কেমন আছেন তা তুলে ধরা হয়েছে। মুস্তফা চৌধুরী এক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘কানাডায় বড় হওয়া যুদ্ধশিশুদের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেছেন। একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া অন্যরা ভালো আছেন। তারা তাদের মা, দেশ ও জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে জানেন ও গর্ববোধ করেন। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে সরকার ও বেসরকারি সংগঠনকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তবে বাংলাদেশে বড় হওয়া ‘যুদ্ধশিশুরা’ সামাজিকতার ভয়ে এখন পর্যন্ত সমাজের সামনে আসতে পারছেন না।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদররা এদেশের মা বোনদের জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রেডক্রস ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা যুদ্ধের সময় নির্যাতিত ও ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কাজ করেছিল। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই গর্ভপাত করানো হতো। সেসব বীরাঙ্গনা হোমে আশ্রয় নিতেন। সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিল, যুদ্ধ শিশুদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তখন রেডক্রসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে এগিয়ে আসে। পরবর্তীতে রেডক্রসের সহযোগিতায় কয়েকটি দেশ যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। সবার আগে এগিয়ে আসে কানাডার দুটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে দুই দেশের সহযোগিতায় তা সম্ভব হয়।

সম্প্রতি অনিল নামের এক যুদ্ধশিশু নিজের অনুভূতির কথা জানান। যদি কখনো তার জন্মদাত্রী মায়ের দেখা পান তখন তিনি মাকে ধন্যবাদ দেবেন। কেননা মা তাকে মেরে ফেলেননি। মা হয়তো চেয়েছিলেন তার সন্তানকে কেউ না কেউ কোলে তুলে নেবে এবং তার সন্তান ভালো থাকবে। অনিল তার মাকে বলবেন, ‘মা আমি ভালো আছি।’ তবে রানী নামের যুদ্ধশিশু বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে ২৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। অনিল আর রানী দুজনই ’৭১-এর যুদ্ধশিশু। তাদের মতো ১৯৭২ সালে জন্ম হওয়া ১৫ যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন কানাডার বাবা-মায়েরা।

যুদ্ধশিশু শামা জামিলা ও তার মেয়ে, পাশে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুস্তফা চৌধুরী- সংগৃহীত

একটি দৈনিকে নিজ প্রবন্ধে মুস্তফা চৌধুরী উল্লেখ করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামকালে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। বিশেষ করে আজ যাদের বয়স ষাটের ওপর, তারা অনেকেই বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফের গ্রামগঞ্জ ও শহরে শহরে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক অগণিত বাংলাদেশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষদর্শী। গত ৪৩ বছরে স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর বহু গবেষণা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে শুরু করে বাঙালিদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উল্লাসের কাহিনী বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও সে সময়ের নারী ধর্ষণ ও যুদ্ধশিশু নিয়ে কোনো বিশেষ গবেষণা হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পরপরই পৃথিবীর যেসব অগ্রগামী দেশ বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল তার মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশি সেই ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের কোলে তুলে নিতে কিছু কানাডীয় পরিবার এগিয়ে এসেছিল। তার মধ্যে ছিলেন ডক্টর রবার্ট ফেরি এবং তার স্ত্রী হেল্কা ফেরি, ফ্রেড ও বনি কাপুচিনো, লিজ মউলিং প্রমুখ। তারা ১৫টি যুদ্ধ শিশুকে নিয়ে কানাডা পৌঁছান ২০ জুলাই ১৯৭২। এসব শিশু কানাডার বৃহত্তম পরিবেশে বড় হয়ে গড়ে তুলেছে তাদের জীবন।

১৯৭২ সালে কানাডার ১৪ জন দম্পতি যারা বাংলাদেশি ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন। তাদের সবারই বয়স ছিল ৪০ এর কোঠায়। 

মুস্তফা চৌধুরী গত ২০ বছর ধরে যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে গবেষণা করছেন। কানাডিয়ান সরকার সব রকমের প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে তাকে। যুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া এসব শিশুরা বর্তমানে তাদের জন্ম পরিচয় দেওয়ার সময় বাংলাদেশ নামটি উল্লেখ করতে সংকোচবোধ করে না। তারা বলে ‘আমরা কানাডিয়ান, বাই বর্ন বাংলাদেশি’। এদের কেউ কেউ মায়ের খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে মাকে আর তারা খুঁজে পাননি। দত্তক দেওয়ার সময় অনেক বিষয়ই সুস্পষ্টভাবে লেখা ছিল না। কোনো কোনো জায়গায় লেখা ছিল যুদ্ধ শিশুর মায়ের জন্মস্থান বরিশাল। ব্যাস এতটুকুই। যা থেকে তাদের এখন আর খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। যখন এদের দত্তক দেওয়া হয় তখন কারো বয়স ছিল ১৫ দিন, ৩ মাস, ৫ মাস এমন।

মুস্তফা চৌধুরী বলেন, ১৯৭২ সালে রেডক্রসের মাধ্যমে প্রথম ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেয় কানাডার দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তিনটি ধাপে এসব শিশুদের দত্তক নেয় কানাডা সরকার। প্রথম পর্যায়ে নেওয়া ১৫ শিশুর মধ্যে ছিল ৮ জন মেয়ে ও ৭ জন ছেলে। এদের সম্পর্কে সব তথ্য সে দেশের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও দ্বিতীয় ধাপে আরও ৮ জনকে দত্তক নেওয়া হয়। এদের মধ্যে যুদ্ধশিশু ও অনাথ শিশু দুটোই ছিল। যুদ্ধের সময় বাবা-মাকে হারানো অনাথ শিশুদের মধ্যে একজন মনোয়ারা ক্লার্ক। পরবর্তী ধাপে যাদের কানাডা সরকার গ্রহণ করেছিল তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য আর্কাইভে সংরক্ষিত না থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

যুদ্ধশিশু আমিনা উলসির সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন মুস্তফা চৌধুরী, ১৯৯৮- সংগৃহীত

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধর্ষণ, খুন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এসব ছিল তখন স্বাভাবিক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করতো, এ দেশের মানুষ এখনো পরিপূর্ণ মুসলমান হয়নি। তাই তারা এদেশের কিশোরী, যুবতীকন্যা ও গৃহবধূদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তরসূরী করে রেখে যেতে চেয়েছিল। 

মুস্তফা চৌধুরী বলেন, দেশ স্বাধীন হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন যুক্তিসঙ্গত কারণে সিদ্ধান্ত নিলেন এসব যুদ্ধ শিশুদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কারণ অনেক মা এসব শিশুদের লালন পালনের দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে নিঃসন্তান দম্পতিরাও এসব শিশুদের গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে থাকা যুদ্ধশিশুরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। দত্তক নেওয়া এসব শিশুরা ভালো আছেন। নিজ পরিচয়ে বড় হয়ে এখন তারা প্রতিষ্ঠিত। তাদের কেউ ডাক্তার, কেউ কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়ে তারা ভালো আছেন বলে জানা যায়। (সংকলিত)।

এমএস/এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি