ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

অহিংস আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা মার্টিন লুথার কিং

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৪৭, ১৫ এপ্রিল ২০২০

মার্টিন লুথার কিং। আমেরিকার গান্ধী। যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন এক শ্রান্ত মায়ের ক্লান্ত পা দুখানির দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন অহিংস আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা।

১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার। আমেরিকার মাইগোমারি শহরের সিটি লাইসেন্সে বাস চলছে। বাসের সব আসন পূর্ণ। সামনের দিকে ১২ জন শ্বেতাঙ্গ, পেছনে ২৪ জন নিগ্রো। এই পার্থক্য কারণ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যেই বাসের সামনের দিকে বসবার অধিকার ছিল না নিগ্রোদের। সব বাসই সংরক্ষিত থাকে শেতাঙ্গদের জন্য। শ্বেতাঙ্গরা বসবার পর যদি কোনো আসন খালি থাকে তবেই সেখানে কৃষ্ণাঙ্গরা বসতে পারবে। বাসটি এক জায়গায় দাঁড়াতেই তিনজন শ্বেতাঙ্গ গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের আসন দেবার আদেশ দিলেন। দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু নিজের আসন ছেড়ে নড়ল না একটি নিগ্রো মেয়ে। নাম তার রোজা পার্কস। সে একটি দরর্জির দোকানে কাজ করত। রোজা স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠল, আমি আসন ছাড়ব না।

এই স্পষ্ট প্রতিবাদ সরকারী আইন লঙ্ঘন। রোজাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল। তাকে দশ ডলার জরিমানা করা হল। এটি সামান্য ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল নিগ্রো জাযক। তারা ডাক দিলেন আন্দোলনের। বিচিত্র সেই আন্দোলন। কোনো নিগ্রো আর সরকারী বাসে চড়বে না।

পরের সোমবার থেকে ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। মন্টগোমারির কোন নিগ্রো আর বাসে চড়লেন না। দিনের পর দিন মাসের পর মাস পায়ে হেটে, ঘোড়ার গাড়ি চেপে সাইকেলে করে পরিচিত কারোর গাড়িতে ভাগাভাগি করে যাতায়াত করতে থাকে।

রোজার কন্ঠে সেদিন প্রথম যে প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছিল, সেই প্রতিবাদের ভাষা হাজার মানুষের কাছে পৌছে দিলেন একজন মানুষ। অল্পদিনের মধ্যেই সমগ্র আমেরিকার লক্ষ লক্ষ নিগ্রো মানুষের কন্ঠে ধ্বনিত হল সেই মানুষটির নাম। তিনি আর কেউ নন, মার্টিন লুথার কিং। যিনি মহাত্না গান্ধীর আদর্শে আমেরিকার বঞ্চিত মানুষদের জন্য এনেছিলেন মুক্তির আলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান্ধীর মতই আত্নাহুতি দিতে হয় এই মহা নায়ককে।

বলা হয়ে থাকে যে, জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকাকে স্বাধীন করেছেন, আব্রাহাম লিংকন এনেছেন গণতন্ত্র, তবে মার্কিন দেশকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং। তাঁর নেতৃত্বে কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান অধিকার, আর সাদা নাগরিকেরা পেয়েছে বর্ণবাদের অভিশপ্ত অহংকার থেকে মুক্তি। 

১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি আমেরিকার দক্ষিণের মন্টগোমারি রাজ্যের আটলান্টা শহরে এক নিগ্রো যাজক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন কিং। পিতা-পিতামহ দুজনেই ছিলেন ধর্মযাজক। পিতামহ রেভারেন্ড ডানিয়েল বর্ণষৈম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন। কিং এর পিতাও ছিলেন সংবেদনশীল প্রতিবাদী মানুষ। পিতা-পিতামহের আদর্শ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেলেন কিং।

জন্মের পর বাবার নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল কিং। ছয় বছর বয়সে পিতা মাইকেল ঠিক করলেন নাম পরিবর্তন করবেন। ছেলের নাম রাখা হল মার্টিন লুথার কিং। একদিন খ্রিষ্টান ধর্মের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সেই ধর্মযাজক নিজের পুত্রের মধ্যে বোধহয় নতুন করে আবিস্কার করতে চেয়েছিলেন পিতা। 

ছেলেবেলা থেকেই কিং ছিলেন শান্তু, ধীর, অনুভূতিপ্রবণ। স্বাভাবিক চেতনা জন্ম নিতেই তিনি অনুভব করলেন চারপাশে জগতে রয়েছে বৈষম্য আর ঘৃণা। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা তাদের ঘৃণা করে। ট্রাক-বাসে, স্কুলে-কলেজে, পথে-ঘাটে, চাকরিতে সর্বত্র এ বৈষম্য। সবখানে প্রথম সারিতে বসবে শ্বেতাঙ্গ ছাত্ররা আর পেছনের বেঞ্চে বসবে নিগ্রোরা।

এসব ঘটনা গভীরভাবে বিচলিত করত কিংকে। 

একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা আমাদের ঘৃণা করে কেন? 

মা বেদনাহত কন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমাদের চামড়ার রং যে কালো। তাই ওরা আমাদের ঘৃণা করে নিগার বলে।’

পরিণত বয়সে কিং ছেলেবেলায় স্মৃতি স্বরণ করে লিখেছেন, ‘যখন আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম একই সমাজে কেন আমাদের আলাদা হয়ে থাকতে হবে, মা উত্তর দিতেন, একদিন এই বৈষম্য শেষ হবে। আমি ও বিশ্বাস করতাম একদিন অন্যায়ের প্রতিকার হবেই। কিন্তু কেমন করে হবে তা শুধুই ভাবতাম।’

ছাত্র হিসাবে লুথার কিং ছিলেন খুবই মেধাবী। আটলান্টা পাবলিক স্কুল থেকে পাশ করে মোরাহাউজ কলেজে ভর্তি হলেন। ছাত্র অবস্থায় কিংয়র ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হয়ে নিগ্রোদের সেবা করবেন। পিতা-পিতামহ ধর্মজাযক হলেও ধর্মের প্রতি তাঁর তেমন কোন আকর্ষন ছিল না। কিন্তু কলেজে পড়বার সময় দার্শনিক থোরোর লেখা civil disobedience বইটি তার মনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এরপরই তিনি মনস্থির করলেন ধর্মজাযকের জীবন গ্রহণ করবেন। ধর্মযাজক হিসাবে নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন।

কলেজ থেকে পাশ করবার পর ২৯৪৮ সালে ১৯ বছর বয়সে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার ক্রোজার থিলজিক্যাল সেমিনারিতে ভর্তি হলেন। এ এক ভিন্ন পরিবেশ এখানে শ্বেতাঙ্গ ও নিগ্রো ছাত্ররা একই সঙ্গে পড়াশুনা করত, কোন বর্ণবৈষম্য ছিল না। পড়াশুনায় বরাবরই মনোযোগী ছাত্র ছিলেন কিং। এখানে ধর্মীয় সংগ্রামের ইতিহাস। তবে যার জীবন রচনা তা রমনকে অধিকার করে নিল তিনি ভারতের মহাত্না গান্ধী। তিনি বলতেন নাজারেথের যীশু আর ভারতের গান্ধী আমার জীবনসর্বস্ব। যীশু পরে দেখিয়েছেন, গান্ধী প্রশান করেছেন সেই পথ পাঠ আমি পেয়েছিলাম বাইবেল ও খ্রীষ্টের জীবন আর উপদেশের মধ্যে। আর এই প্রতিরোধের পদ্ধতিটি পেয়েছিলেন গান্ধীর কাছ থেকে।

ক্রোজার থিওলজিক্যাল সেমিনারি থেকে স্নাতক হওয়ার পথ তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মতত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। ডিগ্রি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় তার জীবনে আরো একটি প্রাপ্তি ঘটেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের ছাত্রী ছিলেন কোত্তো স্কট নামে একটি তরুণ। কিং এর সাথে প্রথম পরিচয়ে মু্গধ হন স্কট। অল্পদিনের মধ্যেই দুজনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবার আগেই ১৯৫৩ সালে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ডেক্সর্টা অ্যাভিনিউয়ের ব্যাপটিস্ট চার্চের যাজক হিসাবে যোগদান করেন।

ছাত্রাবস্থা থেকে নিগ্রো আন্দোলনের প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। ধর্মযাজক হিসাবে যোগদান করবার পর থেকে তিনি সরাসরি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লেন। সেই সময় নিগ্রোদের প্রধান সংগঠন ছিল National Association for the Advancement of Coloured People (NAACP), এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিং এর দাদু। সেই সূত্রে এবং নিজের ব্যক্তিত্বে অল্পদিনের মধ্যেই এই অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন কিং।

১৯৫৫ সালে মন্টগোমারিতে শুরু হল ঐতিহাসিক বাস ধর্মঘট। সমস্ত নিগ্রোদের তরফে দাবি তোলা হল।
১. বাসে নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গদের যে বৈষম্য আছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। 
২. বাসে যে আগে উঠবে সে আগে বসবে।
৩. নিগ্রোদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। 
৪. নিগ্রো এলাকা দিয়ে যে সব বাস চলাচল করে সেই সব বাসের ক্ষেত্রে নিগ্রোদের ড্রাইভার নিযুক্ত করতে হবে।

নিগ্রোদের সমর্থনে এগিয়ে এলেন নিগ্রো খ্রীষ্টান ধর্মজাযকরা। প্রতিষ্টা হল মন্টগোমারি ইমপ্রুগভমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন। মার্টিন লুথার কিং এর সভাপতি নির্বাচিত হলেন। তিনি এক প্রকাশ্য সমাবেশে সমস্ত নিগ্রোদের উদ্দেশ্যে বললেন যতদিন না মন্টগোমারির বাস কোম্পানির পক্ষ থেকে আমাদের দাবি না মেনে নেওয়া হচ্ছে ততদিন একটি নিগ্রোও বাসে উঠবে না।

প্রায় একবছর নানা প্রতিকূলতার পরেও নিগ্রোরা সরকারী বাস বয়কট করে। কর্তৃপক্ষ বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত নিগ্রোদের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হলেন। সুপ্রীম কোর্ট বাসের এই বর্ণবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করল। অবশেষে  M I A  এ সমস্ত দাবি মেনে নেওয়া হল। বাসে নিগ্রোদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল।

এই জয়ের পেছনে কিং এর অবদান ছিল বিরাট। তিনি নিগ্রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে তাদের সাহস দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গরা সোচ্চার হয়ে ওঠে তাকে নানাভাবে ভয় দেখানো হতে থাকে। এমনকি একদিন তার বাড়িতে বোমা ফেলা হল। কিন্তু কোন কিছুর কাছেই মাথা নত করলেন না কিং। পুলিশ নানাভাবে তাকে বিব্রত করতে থাকে। এমনকি তিনি নিগ্রোদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছেন বলে তাকে প্রেফতার করা হল। কিন্তু প্রমানের অভাবে তাকে আদালত থেকে ছেড়ে দেওয়া হল।

কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিগ্রোদের কাছে হয়ে উঠলেন প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বাস করতেন শান্তি আর অহিংসায়। তিনি অন্তরে অনুভব করতেন ন্যায় ও সত্যের স্বপক্ষে যে সংগ্রাম আরম্ভ করেছেন তা ইশ্বরের ইচ্ছাতেই করছেন। শ্বেতাঙ্গরা তাকে বিদ্রুপ করে বলত নিগ্রো ধর্মগুরু।

মন্টগোমারির বাস আন্দোলনে এই গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকায় কি এর নাম ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত আমেরিকায়। তার এই অহিংস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে এগিয়ে এল বহু নিগ্রো নেতা। সমস্ত আমেরিকা জুড়েই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জেগে উঠতে থাকে।

১৯৫৭ সালে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশের নিগ্রো নেতৃবৃন্দ এবং তাছাড়া বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারের নিগ্রো মন্ত্রীরা মিলিত হলেন আটলান্টা শহরে। নিগ্রোদের সামাজিক ও আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে আরো জোরদার করবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হল SOUTHERN CHRISTIAN LEADERSHIP CONFERENCE সংক্ষেপে বলা হল  SCLC । মার্টিন লুথার এর সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হলেন, তখন তার বয়স মাত্র ২৮ কৃষ্ঞাঙ্গদের দাবির স্বপক্ষে ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল। ঘানার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উৎসবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হলেন মার্টিন লুথারও আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। এখানে দুই নেতার মধ্যে সাক্ষাৎ হল। নিক্সন নিগ্রোদের দাবির প্রতি সহাননুভূতিশীল ছিলেন। এক বছর পর সাষ্ট্রপতি আইজেন হাওয়ারের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে মিলিত হলেন কিং ও অন্যসব নিগ্রো নেতারা। বেশ কয়েকবার আলোচনা বৈঠক বসবার পরেও কোন সুনিদৃষ্ট সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভবপর হল না। সরকারের অধিকাংশ প্রস্তাবই তাদের স্বপক্ষে মনোমত হল না। কি এর ভাষায়  This is no neal or meaningful settlement দেশের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের আচরণে ক্রমশই বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবপ্র কট হয়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র সামাজিক ক্ষেত্রে নয় আইনগত ক্ষেত্রেও নানাভাবে নিগ্রোদের বঞ্চনা কারা হত। বহু রাজ্যে নিগ্রোদের কোন ভোটাধিকার ছিল না। সরকারী উচ্চপদে বসবার অধিকার ছিলনা নিগ্রোদের। কিং আমেরিকার প্রান্তে প্রাান্তে ঘুরে বেড়িয়ে প্রচার করতে লাগলেন, এই বৈষম্যর বিরুদ্ধে অহিংসা আন্দোলনে যোগদেবার জন্য সমস্ত নিগ্রোদের কাছে আহবান জানাতে লাগলেন, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অহিংসা আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য সমস্ত নিগ্রোদের কাছে আহবান জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে প্রায় প্রতিটি প্রদেশেই আন্দোলন সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। কিং হয়ে উঠলেন সমস্ত আমেরিকার নিগ্রো মানুষের অবিসংবাদিত নেতা।

১৫৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী জহরলালের আমন্ত্রণে ভারতবর্ষে এলেন কিং ও তার স্ত্রী। ভারতবর্ষ কিং এর কাছে ছিল এক মহান দেশ। তিনি গান্ধীর জন্মস্থানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন।

কিং ভারত ভ্রমণ শেষ করে যখন আমেরিকায় ফিরে এলেন, আমেরিকা জুড়ে আন্দোলন হিংসাত্বক রুপ নিয়েছে। নিগ্রোরা শান্তিপূর্ন আন্দোলন করলেও শ্বোতঙ্গরা হিংস্র হয়ে উঠছে। নিগ্রোদের মধ্যে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে উঠে। তারাও পাল্টা আক্রমন করে। সর্বত্রই ভাঙ্চুর লুটতরাজ গুলি লাঠি চলতে থাকে। কৃঞ্চাঙ্গদের উপর সমস্ত অভিযোগ এসে পড়ে। কিছু কিছু কৃষ্ঞাঙ্গ নেতা এই অহিংস আন্দোলনের পথ পরিত্যাগের জন্য কিং এর কাছে অনুরোধ জানায়। কিং জানতেন তাতে উদ্দেশ্য সাধিত হবে না, শুধু রক্তপাতই হবে। তিনি এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারলেন না। অল্প কিছু দিনের জন্য ব্যাপিস্ত মিশনের হয়ে ধর্মযাজকের কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তার কাছে ধর্ম ছিল মানবমুক্তির একটি পথ। আমেরিকার ক্যারোলিনা, টেনিসি, ভার্জিনিয়া, আরো কয়েকটি প্রদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ক্যানটিনে কৃষ্ঞাঙ্গ ছাত্রদের পাশে এসে দাড়ালেন কিং। তারই নির্দেশে অহিংস সত্যগ্রহের পথ বেছে নিল ছাত্ররা। বহুশ্বেতাঙ্গ ছাত্ররাও এই দাবিকে সমর্থন জানাল। কয়েক মাস আন্দেলন চলবার পর প্রতিটি প্রদেশেই এই র্ঘৃণ্য প্রথাকে বিলুপ্ত করা হল। কৃষ্ঞঙ্গ ছাত্ররা শ্বেতাঙ্গদের একই সাথে খাবার অধিকার পেল।

১৯৬৪ সালে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবিস্মরনিয় অবদানের জন্য তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। গান্ধীর মতই তিনি জীবন কর্ম সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন শান্তির পুজারী। যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন তার বয়স হয়েছিল ৩৫ বছর। পুরস্কারের সমস্ত অর্থ তিনি নিগ্রোদের মুক্তি আন্দোলনে দান করলেন।

নিগ্রোদের মানবাধিকারের এই আন্দোলন বিশ্বে সমস্ত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল। প্রেসিডেন্ট জনসন নিগ্রোদের বহু দাবি স্বীকার করে নিলেন। এর মধ্যে ছিল নিগ্রোদের ভোটাধিকার।

১৯৬৫ সালে আমেরিকা ভিয়েৎনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। শান্তির পূজারী কিং ছিলেন যুদ্ধের বিপক্ষে। ভিয়েৎনামের মত একটি ছোট দেশের উপর আমেরিকার এই আক্রমন মেনে নিতে পারলেন না কিং। দেশ জুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেতেই নিগ্রোদের শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের উপর শ্বেতাঙ্গরা হিংস্রভাবে আক্রমন করছিল। নিগ্রোরাও পাল্টা আক্রমন শুরু করল। সর্বত্রই অহিংস সত্যগ্রহ হিংসাত্বক আন্দোলনে পরিনত হল। এতে ব্যাথিত হতেন কিং। তিনি বার বার সকলকে শান্ত সংযত থাকবার জন্য আহবান জানাতেন। আমেরিকা ক্রমশই ভিয়েৎনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বের বহু বুদ্ধিজীবী মানুষের সাথে কিং ও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫ তারিখে তিনি ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ বিরোধী পদযাত্রা করবার আহবান জানালেন আমেরিকার সমস্ত  শান্তিকামী মানুষকে। এরই সাথে তিনি ঘোষণা করলেন ২৭ এপ্রিল দারিদ্র নির্মূল করবার জন্য আর্থিক নিরাপত্তার দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত দরিদ্র মানুষদের সাথে নিয়ে তিনি ওয়াশিংটন যাত্রা করবেন।

শান্তি অভিযানে সেদিন হাজার হাজার মানুষের কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠেছেল শান্তির আহবান।

মেমপিস টেনেসি রাজ্যে নিগ্রো পৌরকর্মীরা শ্বেতাঙ্গদের সামনে মাইনে ও কাজের সুযোগ সুবিধা বাড়াবার জন্য আন্দোলন করছিল। কিং সেখানে গেলেন। কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের একটি দাবিও মেনে নিলেন না। কিছু অল্পবয়সী ছেলে এর প্রতিবাদে ভাঙচৃর শুরু হগে গেল।পুলিশের হাতে বেশ কয়েকজন মাড়া পড়ল। ৩রা এপ্রিল কিংকে হত্যার হুমকি দেওয়া হল। তার সহকর্মীরা তাকে অন্যত্র চলে যেতে বললেন। কিন্তু অকুতোভয় কিং বললেন তার যাই ঘটুক তিনি এখান থেকে যাবেন না। সকলকে হিংসা ত্যাগ করবার আহবান জানালেন।

পরদিন তিনি যখন হোটেলের বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলেন, আততায়ীর বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। সন্ধ্যে সাতটায় চিরশান্তির প্রতীক মার্টিন লুথার কিং তার আদর্শ খ্রীষ্ট, গান্ধীর মতই হিংস্র মানুষের হিংস্রতার কাছে আত্নাহুতি দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তখন তিনি উনচল্লিশ বছরের এক যুবক।

১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে লাখ লাখ মানুষের মিছিলের শেষে দেওয়া এই বক্তৃতা কখনো ভুলার নয়। 

এখানে তাঁর সেই বক্তৃতার সংক্ষেপিত অংশ অনুবাদ করে দেওয়া হলো :

[এই দিনে আমি আপনাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে খুশি। ইতিহাস এই দিনটি মনে রাখবে, আমাদের জাতির ইতিহাসে মুক্তির মহান সমাবেশ হিসেবে।

যে মহান আমেরিকানের প্রতীকী ছায়াতলে আজ এখানে আমরা দাঁড়িয়ে, শতবর্ষ আগের এই দিনে তিনি মুক্তির সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন। অবিচারের আগুনে ঝলসে যাওয়া নিযুত নিযুত নিগ্রো দাসের সামনে সেই যুগান্তকারী ঘোষণা আশার মশাল হয়ে জ্বলে ছিল। বন্দিত্বের দীর্ঘ রাতের পর সেটা ছিল এক আনন্দময় সকাল।

কিন্তু ১০০ বছর পর মর্মান্তিক সত্য হচ্ছে, নিগ্রো আজও মুক্ত নয়। শতবর্ষ পরও নিগ্রোরা আজও দুঃখজনকভাবে বিচ্ছিন্নতার শেকলে আর বৈষম্যের জিঞ্জিরে বাঁধা। শতবর্ষ পরও নিগ্রোদের জীবন যেন ধন-সম্পদের বিরাট সমুদ্রের মাঝখানে এক নিঃসঙ্গ দারিদ্র্যের দ্বীপ। শতবর্ষ পরও নিগ্রোরা মার্কিন সমাজের এক কোণে নির্জীব দশায় পড়ে আছে, হয়ে আছে নিজভূমে নির্বাসিত। তাই আজ আমরা এখানে আমাদের দুর্দশাকে তুলে ধরতে এসেছি।

এক অর্থে আমরা আমাদের রাজধানীতে এসেছি একটা চেক ভাঙাতে। আমাদের প্রজাতন্ত্রের স্থপতিরা যখন সংবিধানের সেই দারুণ কথাগুলো লিখছিলেন এবং দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা, তখন তাঁরা এমন এক চেকে সই করছিলেন, প্রতিটি আমেরিকান যার উত্তরাধিকারী। সেটা ছিল সব মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকার, মুক্তি ও সুখসন্ধানের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি।

আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমেরিকা সেই প্রতিশ্রুতিপত্র খেলাপ করেছে, অন্তত তার কালো নাগরিকদের বেলায়। সেই পবিত্র দায়িত্ব মান্য করার বদলে আমেরিকা নিগ্রো মানুষদের হাতে যে চেক ধরিয়ে দিয়েছে, তা ফেরত এসেছে, ‘তহবিল ঘাটতি’র চিহ্ন নিয়ে। কিন্তু ন্যায়বিচারের ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে—এ আমরা বিশ্বাস করতে রাজি না।

আমরা মানতে রাজি না, এই জাতির সুযোগ ও সম্ভাবনার সিন্দুকে যথেষ্ট তহবিল নেই। তাই যে চেক চাইবা মাত্র মুক্তির দৌলত আর ন্যায়বিচারের নিরাপত্তা দেবে, আজ আমরা এসেছি সেই চেক ভাঙাতে।... এখনই সময় ঈশ্বরের সব সন্তানের জন্য সুযোগের সব দ্বার অবারিত করে দেওয়ার। এখনই সময় বর্ণবৈষম্যের চোরাবালি থেকে আমাদের জাতিকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের পাথুরে জমিতে তুলে ধরার।

...যত দিন না নিগ্রোরা তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারবে, তত দিন আমেরিকায় বিরাম ও শান্তি থাকবে না। যত দিন না ন্যায়ের সুদীপ্ত দিন আসছে, তত দিন বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড় আমেরিকার ভিতকে কাঁপিয়ে দিতে থাকবে।...

বন্ধুরা,

আজ আমি আপনাদের বলছি, বর্তমানের প্রতিকূলতা ও বাধা সত্ত্বেও আমি আজও স্বপ্ন দেখি। আমার এই স্বপ্নের শেকড় পোঁতা আমেরিকান স্বপ্নের গভীরে।
আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন এই জাতি জাগবে এবং বাঁচিয়ে রাখবে এই বিশ্বাস: ‘আমরা এই সত্যকে স্বতঃসিদ্ধভাবে গ্রহণ করছি: সব মানুষ সমান।’
আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে সাবেক দাস আর সাবেক দাসমালিকের সন্তানেরা ভ্রাতৃত্বের এক টেবিলে বসতে সক্ষম হবে।
আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন মরুময় মিসিসিপি রাজ্য, অবিচার আর নিপীড়নের উত্তাপে দম বন্ধ করা মিসিসিপি হয়ে উঠবে মুক্তি আর সুবিচারের মরূদ্যান।
আমি স্বপ্ন দেখি, আমার চার সন্তান একদিন এমন এক জাতির মধ্যে বাস করবে, যেখানে তাদের চামড়ার রং দিয়ে নয়, তাদের চরিত্রের গুণ দিয়ে তারা মূল্যায়িত হবে।
আমি আজ এই স্বপ্ন দেখি।
আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন আলাবামা রাজ্যে, যেখানকার গভর্নরের ঠোঁট থেকে কেবলই বাধানিষেধ আর গঞ্জনার বাণী ঝরে, একদিন সেখানকার পরিস্থিতি এমনভাবে বদলে যাবে যে কালো বালক আর বালিকারা সাদা বালক আর বালিকাদের সঙ্গে ভাইবোনের মতো হাত ধরাধরি করবে।
আমি আজ এই স্বপ্ন দেখি।

আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন সব উপত্যকা উত্তীর্ণ হবে, সব পাহাড় আর পর্বত হবে আনত, এবড়ো-খেবড়ো জমিন মসৃণ হবে, আঁকাবাঁকা জায়গাগুলো সমান হবে এবং ঈশ্বরের জয় উদ্ভাসিত হবে এবং একসঙ্গে সব মানব তা চাক্ষুষ করবে।

এই-ই আমাদের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন নিয়েই আমি দক্ষিণে ফিরে যাব। এই বিশ্বাস নিয়ে হতাশার পর্বত থেকে আমরা সৃষ্টি করব আশার প্রস্তর। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা আজকের এই বেসুরো কোলাহল থেকে জন্ম দেব ভ্রাতৃবন্ধনের সুন্দরতম সংগীতের। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করব, প্রার্থনায় মিলব একত্রে, একদিন আমরা মুক্ত হব এই জেনে, একসঙ্গে শামিল হব সংগ্রামে।

সেটা হবে সেই দিন, যে দিন ঈশ্বরের সন্তানেরা গাইতে পারবে গান, ভাষায় দেবে নতুন অর্থ: ‘ও আমার দেশ, তুমি তো মুক্তির স্নিগ্ধ ভূমি। যে মাটিতে আমার পিতারা শায়িত, যে মাটি তীর্থযাত্রীদের গরিমা, তার প্রতিটি পাহাড়ের ঢাল থেকে বেজে উঠুক মুক্তির গান।’

এবং আমেরিকাকে মহান এক দেশ হতে হলে এটাই সত্য হতে হবে। তাই মুক্তি ধ্বনিত হোক নিউ হ্যাম্পশায়ারের বিপুল পাহাড়চূড়া থেকে। মুক্তি ধ্বনিত হোক নিউইয়র্কের শক্তিমান পাহাড়গুলো থেকে। মুক্তি ধ্বনিত হোক পেনসিলভানিয়ার ওই আকাশছোঁয়া আলেঘেনির শীর্ষ থেকে।

মুক্তি ধ্বনিত হোক কলোরাডোর তুষারমোড়া পাহাড় থেকে।
মুক্তি ধ্বনিত হোক ক্যালিফোর্নিয়ার বঙ্কিম চূড়া থেকে!
শুধু তা-ই নয়, মুক্তি ধ্বনিত হোক জর্জিয়ার স্টোন মাউন্টেইন থেকেও!
মুক্তি ধ্বনিত হোক টেনেসির লুকআউট পাহাড় থেকে!

মুক্তি ধ্বনিত হোক মিসিসিপির প্রতিটি টিলা ও পাহাড় থেকে। প্রতিটি পাহাড়ের খাঁজ থেকে বেজে উঠুক মুক্তির গান।

যখন আমরা মুক্তিকে ধ্বনিত হতে দেব; যখন প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি বসতি, প্রতিটি রাজ্য এবং শহরে বাজবে মুক্তির গান; তখন আমরা সেই দিনকে আরও কাছে নিয়ে আসতে পারব, যেদিন কালো মানুষ ও সাদা মানুষ, ইহুদি ও জেন্টাইল, প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক—সবাই হাতে হাত ধরে গাইবে সেই নিগ্রো মরমিসংগীত ‘এত দিনে আমরা মুক্ত হলাম! এত দিনে পেলাম মুক্তি! ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, তোমাকে ধন্যবাদ, আমরা আজ মুক্ত!’]

আসলেই তিনি সফল। তাঁর প্রচেষ্টা, একাগ্রতা ও লড়াই তাঁকে ইতিহাসে অমর করে দিয়েছে।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি