চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল ও একজন বিদ্যুৎ বড়ুয়া
প্রকাশিত : ১২:১৩, ১৬ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১২:১৮, ১৬ এপ্রিল ২০২০
বিদ্যুৎ বড়ুয়া
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এর একটি কথা মনে হলে ধাঁধায় পড়ে যাই। সব সময় আমরা বলি সাহস থাকলে যুদ্ধ জয় করা সম্ভব। কিন্তু তিনি তার পুরো উল্টো কথা বলেছেন। ‘সাহস সম্মুখে যাওয়ার শক্তি রাখে না। আর যখন সাহস থাকে না শক্তি নিজে থেকেই চলতে থাকে’। এ কথাটি আমার কাছে এতোদিন ধাঁধার মতোই ছিলো। কিন্তু পুরো বিশ্বময় জালবিস্তারি করোনাভাইরাস আমাকে এ কথার মর্মার্থ বুঝতে সহায়তা করলো। পুরো বিশ্ব মানব সভ্যতা অদৃশ্য এক ভাইরাসের কাছে মাথানত করে বসে আছে। কোথায় অস্ত্র চালাবে, বোমা ফেলবে কোথায়? শত্রুতো দেখা যায় না। তাবৎ বিশ্বের যুদ্ধবাজ দেশগুলো হাত গুঁটিয়ে বসে আছে।
আত্মরক্ষায় অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো কত শত পন্থা অবলম্বনে ব্যস্ত সবাই। কিন্তু করোনা খুব চতুর সন্ত্রাসী। কিভাবে শরীরে প্রবেশ করে সব কলকব্জা বিকল করে দেয় তাও টের পাওয়া যায় না। যখন জানা যায় তখন সব শেষ। মানুষের সাহস দেখানোর কোন জায়গা নেই। মানুষ এখন সাগর সাতরে কুলে উঠার চেষ্টায় মত্ত। সাহস দিয়ে কিছু আর হচ্ছে না। সবাই হাত গুঁটিয়ে লকডাউনে। বিশ্বের দু’শটি রাষ্ট্র করোনাভাইরাস ঠেকানো নয় মূলত আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। এর জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ডাক্তার এবং নার্স। শত্রু যখন দেখা যায় না সাহস কোথায় দেখাবে?
তাই শক্তি নিজে থেকেই সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। নেপোলিয়ান কি এমন কোন পরিস্থিতি ইঙ্গিত করেই কি কথাটি বলেছিলেন? হয়তোবা। বিশ্বের মহা শক্তিধর দেশগুলো করোনার কাছে পরাস্ত। সেখানে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের দাঁড়াবার জায়গা কোথায়? কেবল চিকিৎসা নয় এই পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়বে অর্থনীতি। যা না হলে একটি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষগুলো অসম্ভব প্রাণসম্পন্ন। কত প্রাকৃতিক দুর্যোগইতো বছর বছর সামাল দিচ্ছে তারা।
করোনার থাবা যখন বাংলাদেশে বিস্তার হতে শুরু হলো তা মোকাবেলায় ওই যে সাহস নয় শক্তি নিয়েই সরকারের সাথে কিছু ব্যক্তি মানুষ বুক টান টান করে দাঁড়াচ্ছেন। তারা চিকিৎসক, তারা নার্স, তারা স্বাস্থ্যকর্মী। উন্নত বিশ্বে করোনা রোগী চিকিৎসায় রাতারাতি তৈরি হয়েছে অসংখ্য ফিল্ড হাসপাতাল। কারণ তাদের অর্থের সংকট নেই। বাংলাদেশেও অনেকেই এই উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম তরুণ চিকিৎসক বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তিনি কোন ধনকুবের নন। বড় ব্যবসায়ীও নন। তাতে কী। মানুষকে বাঁচাতে হবে। তার জন্য চট্টগ্রামে ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করে দিলেন তিনি।
অর্থ আসবে কোত্থেকে? বললেন, প্রতিটি মানুষ একশ টাকা করে দিলে হাসপাতাল হয়ে যাবে। হলোও তাই। একশ টাকা একশ টাকা করে তহবিল তৈরি হতে শুরু করলো। একই সাথে কাজ চলতে থাকলো। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার সলিমপুরে আফতাব আটোমোবাইল স্থান দিয়ে সহায়তা করলো। কেউ কেউ আরো বেশি অর্থ সাহায্য নিয়ে উপস্থিত হলেন। এখন প্রায় কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে। চিকিৎসা সরঞ্জাম উঠে গেছে প্রায়। অনেকে চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবী নিজে থেকে এসেই যোগ দিচ্ছেন ফিল্ড হাসপাতালে। ডাক্তার বিদ্যুৎ বড়ুয়া এমন একটি উদ্যোগ না নিয়ে কোন একটি হাসপাতালে রোগী সেবা দিয়েও এই সংকটে মহানুভবতার পরিচয় দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে দায়িত্বকে যথেষ্ঠ মনে করলেন না। ভাবলেন, মহামারী থেকে মানুষ বাঁচাতে হলে জরুরি সেবা এবং সময়োপযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজন বাড়তি স্থান এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম। তিনি তাই করলেন।
আমার জানা মতে, তিনি ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বসবাস করতেন। করোনা সংকটে তিনি ছুটে গেছেন দেশে। মাতৃভূমি এবং তার মানুষের সেবায় তিনি জীবনকে পরোপকারে নিয়োজিত করা জরুরি মনে করলেন। এখন তিনি রাতদিন সময় দিচ্ছেন ফিল্ড হাসপাতালের কাজ সম্পন্ন করার জন্য। ৬০ বেডের এই হাসপাতাল এই নিদেনকালে নুহের তরীর মতো কাজ করবে বলে আমি মনে করি। আমি দূর থেকে সামাজিক মাধ্যমে দেখি এই হাসপাতালের কর্মকান্ড। প্রতিদিন বিপুল কর্মসম্পাদন হচ্ছে। শীগগিরই চিকিৎসা সেবা দেয়াও শুরু হবে নিশ্চয়।
আমাদের সমাজে অনেক ধনী আছে। রয়েছে রাজনীতিক, পেশাজীবী। এই করোনাকালে কেউ কেউ উদ্যোগী হচ্ছেন। আকিজ গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ উদ্যোগ নিয়েছিল, সেই কাজ এখনও চলমান। কিন্তু একজন চিকিৎসক বিদ্যুৎ বড়ুয়া বিপুল শক্তিতে ধাবমান। একজন মানুষের মধ্যে দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা না থাকলে এ কাজ সম্ভব নয়। যুগে যুগে বিদ্যুৎ বড়ুয়ারা ছিলেন এবং আছেন বলে অর্থ নয় বুকের শক্তিতেই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে মানব সমাজে। এ কাজটি করতে গিয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়া সরকারের সহায়তা পেয়েছেন নিশ্চয়। অন্য কেউ এমন উদ্যোগ নিলে তাকেও সরকার সহযোগিতা করবে। কারণ চলমান করোনা সংকট মোকাবেলা করতে হলে বাংলাদেশে বিপুল পরিমান ফিল্ড হসপিটাল স্থাপন জরুরি। মডেলতো বিদ্যুৎ বড়ুয়া দাঁড় করিয়ে দিলেন। এই প্রকল্পটিকে মডেল ধরে অন্যরাও কাজ শুরু করতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার মতো মানুষ খুব প্রয়োজন। বিশেষ করে রাজনীতিতে আমাদের সঠিক মানুষ নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সময় এটি। বাংলাদেশের রাজনীতি প্রচন্ড রকম মেধাশূন্যতায় ভূগছে বলে আমি মনে করি। যার ফলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশ খুঁড়িযে খুঁড়িয়ে হাটছে। এই অচলায়তন ভাঙতে বিদ্যুৎ বড়ুয়াদের দরকার। তারা জাতীয় দুর্যোগে দিশা হয়ে দাঁড়াবেন। ফিল্ড হাসপাতালের কাজ অবলোকন করতে গিযে আমি বিদ্যুৎ বড়ুয়া সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করেছি। দেখলাম তুখোড় মেধাবি তরুণ স্কুল জীবনের পরীক্ষায় প্রথম হয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন বারবার।
মেট্টিক পাশ করেছেন ১৯৯০ সালে। স্কুল জীবনে দেশের প্রতি মমত্ববোধ রোভার স্কাউটসহ শিশু সংগঠন করেছেন। এরপর ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে ১৯৯২ সালে এইচএসসি পাশ করেন। সেখান থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক এবং সেবামূলক সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে নিজেকে মানবিক কাজে সংযুক্ত রেখেছিলেন সব সময়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদ্যুৎ বড়ুয়া
১৯৯৮ সালে দেশব্যাপী বন্যায় সাধারণ মানুষের জন্য রুটি ও ওরস্যালাইন বানানোর অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে। সেই সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতির পরিবারে বেড়ে ওঠা বিদ্যুৎ বড়ুয়া, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত হন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রচার সম্পাদক ৯৬ , ছাত্রসংসদ ( ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদ ) এর সাহিত্য সম্পাদক ৯৭ , বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর আহ্বায়ক ৯৮, ছাত্রসংসদ (ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদ) ৯৯-২০০০ এর ভিপি নির্বাচিত হন।
২০০০ সালে ভিপি নির্বাচিত হয়ে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন। ২০০১ সালে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে অত্যাচারীত হয়েছেন অনেকবার। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে স্বাচিপ আয়োজিত হেলথ ক্যাম্পে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার সময় স্টেডিয়াম এলাকায় উপস্থিত ছিলেন, ভাগ্যকারণে বেঁচে যান।
২০০৬ সালে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আহত নিহত সকল কর্মীদের পাশে ছিলেন সবসময়। পরবর্তীতে পাবলিক হেলথ বিষয়ে সুইডেনের বিখ্যাত কারোলিন্সকা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ডি ও এম পি এইচ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবতীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ এসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া ডেনমার্কের অরহুস বিশ্ববিদ্যালয়েও রিসার্চ এসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন। পেশাজীবনে জনস্বাস্থ্য বিষেশজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। প্রবাসে থাকা কালীন ডেনমার্ক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন নিষ্ঠার সাথে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
বর্তমানে পাবলিক হেলথ ফ্যাকাল্টি হিসাবে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে কাজ করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জনক। বাবা অ্যাডভোকেট সুনীল কান্তি বড়ুয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী। মা- গৃহিনী। একমাত্র ভাই ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া- বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক।
এই হলো বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তিনি আজ যে কাজ শুরু করেছেন। তা করবার জন্য যে শক্তি তা তিনি আগেই সঞ্চয় করেছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই রয়েছে তার সাংগঠনিক দক্ষতা। রযেছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। আমি মনে করি এই মানুষগুলোকেই রাজনীতিতে সম্মুখে নিযে আসা উচিত। জাতীর সংকটে যিনি জীবন বাজি রাখতে পারেন তিনিই তো প্রকৃত রাজনীতিক, তিনিইতো মানুষের বন্ধু। আমরা আশা করি ফিল্ড হাসপাতালের মাধ্যমে ডাক্তার বিদ্যুৎ বড়ুয়া নিজের কাজ সম্পর্কে দেশ ও জনগণকে ধারণা দিতে পারবেন। এই কাজই তাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাবে।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক
e-mail.milton.rahman07@gmail.com
এমবি//