ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন স্মৃতি সুখের, দুঃখেরও

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত : ১৪:১৭, ১৭ মে ২০২০

মনে হয় এই তো সেদিন। অথচ উনচল্লিশ বছর পার। আকাশ জুড়ে ঘোর কৃষ্ণবর্ণের মেঘের ঘন জটলা। ঝোড়ো বাতাস, অঝোর বৃষ্টি, ঘনঘন একি বিদ্যুত্ জ্বলে! বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডির বত্রিশ যেন জনসমুদ্র। রাষ্ট্রের ডাইনে বামে অদৃশ্য কাঁটাতার। বর্ধমান ফণীমনসার বন। চারদিকে গোয়েন্দাদের অবাধ আস্তানা, সাপের হিসহিস শব্দ। বিপর্যস্ত গোলাপের বাগান। ঘোর মরীচিকায় চতুর্দিকে ভয় ধরানো কাঁপাকাঁপি। এই পরিস্থিতির মধ্যে দেশে ফিরলেন পিতা বঙ্গবন্ধুর যথার্থ উত্তরসূরি অসমসাহসী শেখ হাসিনা। তারিখটা মে মাসের সতেরো, উনিশ শ একাশি সাল। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তার অসাধারণ কবিতা ‘ইলেক্ট্রার গান’— ‘আজ যে শুধুই স্মৃতি, বেদনার মতো বয়ে যায় আমার শিরায়।’

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি উনচল্লিশ বছর ধরে নানাভাবে পালিত হয়েছে। গুণীজনেরা পত্রপত্রিকায় অজস্র কলাম লিখেছেন, কবিরা কবিতা রচনা করেছেন। আঁকা হয়েছে ছবি, সৃষ্টি হয়েছে গান। কেউ কেউ শেখ হাসিনার নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটির মিল খুঁজে পেয়েছেন। লিখেছেন উভয় দিনের জনস্রোতের কথা, আনন্দোল্লাসের কথা। এই আনন্দোল্লাসের বেলাতেই বোধহয় একটু ফারাক আছে। বঙ্গবন্ধু যেদিন তার আরাধ্য স্বাধীন স্বদেশে ফিরেছিলেন, সেদিন সত্যি সত্যিই আনন্দোল্লাস হয়েছিল। আর শেখ হাসিনা যেদিন তার প্রিয় বাসভূমে ফিরেছিলেন সেদিন আনন্দ ছিল না, উল্লাস ছিল না। উনিশ শ একাশি সালের সতেরোই মে রাজপথে ঢল নামা জনস্রোতের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমার মনে হয়েছিল আনন্দ প্রকাশের আড়ালে একটা গোপন চিনচিনে ব্যথা ছিল। রাতের সব তারা যেমন দিনের আলোর গভীরে লুকিয়ে থাকে, তেমনি একটা গোপন কান্না গুমরে মরছিল সবার বুকের গভীরে। বিশ্বাস করি, এই গোপন কান্না সংক্রমিত হচ্ছিল আরো অনেকের অন্তরে। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকূপের গভীর অমানিশা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরেছিলেন তার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ, প্রিয় দেশবাসীর কাছে। ফিরেছিলেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যার অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে তার সুখী গৃহকোণে। স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে।

আর তারই বুকে আগলে রাখা আদরের সন্তান ফিরলেন একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। যেখানে বাবা নাই, মা নাই, স্নেহের ভাইয়েরা নাই, ভ্রাতৃবধূরা নাই। সবচেয়ে নিদারুণ যা তা হলো আদরের ছোট্ট ভাইটি রাসেল দৌড়ে এসে তার প্রিয় হাসুপার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। এ যে রূপকথার সব হারানো রাজকন্যার গল্পকেও হার মানায়।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট যারা নৃশংসতম ঘটনা ঘটিয়েছিল এবং যারা তাদের নেতা অর্থাত্ মোশতাক ও জিয়া চেয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশটাকে মিনি পাকিস্তান বানাতে— যেখানে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর চিত্রটি থাকবে না, স্বাধীনতার নামগন্ধও চিরতরে মুছে দেওয়া হবে। সবকিছু সে রকমভাবেই চলছিল। হত্যা, নির্যাতন, ক্যু-এর পর ক্যু, চিহ্নিত রাজাকারদের সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসন, প্রথমে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ ভোট এবং পরে প্রহসনের নির্বাচন, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, ইনডেমনিটি বিল পাশ, দিনের পর দিন সান্ধ্য আইন জারি, ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশটাকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রাখা ইত্যাদি মিলিয়ে সে সময়কার বাংলাদেশটা শেখ হাসিনার কাছে ছিল ভীষণ অচেনা। প্রতিদিন সকাল ছিল রাতের চেয়েও অন্ধকারময়।

রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণকারী সুবিধাবাদীর দলও তখন ভীষণ কর্মতত্পর। কেউ-বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় মহা ব্যস্ত, কেউ-বা বঙ্গবন্ধুর বিশাল ভাবমূর্তিকে খাটো করে রাজাকারের ভাবমূর্তি বড়ো করার উদ্দেশ্যে নাটক ও সাংস্কৃতিক দল নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক নেতারা স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আপস-ফর্মুলায় গিয়ে ততদিনে রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ নিয়ে চাটাচাটি করছেন। ‘হিযবুল যাহার’ জাহাজে সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করিয়ে মেধাবী তরুণদের মগজ ধোলাই হয়ে গ্যাছে ততদিনে। শেখ হাসিনার স্বদেশে ফিরে আসার সময়টা সুখের তো ছিলই না, স্বস্তিরও ছিল না।

তাছাড়া নিজ দল আওয়ামী লীগের অবস্থাও তখন নড়বড়ে। নেতাদের কোন্দল, বিশৃঙ্খলা, গোপন আপসকামিতা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কাছ থেকে সুবিধাভোগ সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের তখন ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল অবস্থা। একাশির সেই টালমাটাল সময় আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কয়জন দেখিয়েছেন আমার জানা নাই। সেই অর্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভুবনে তিমির হননের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার আবির্ভাব গুরুত্বপূর্ণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

দলের নেতারা যে যা-ই করুক, সুখের বিষয়, আওয়ামী লীগ এবং প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ছিল তৃণমূলে কোটি কোটি নিঃস্বার্থ সমর্থক। শেখ হাসিনার সত্যিকার শক্তি ছিল এসব তৃণমূল ভক্ত। উদার অভ্যুদয়ের নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে যেমন সকল কর্মপ্রেরণা, সাহস ও লক্ষ্যজয়ের প্রাণশক্তি ছিল এসব মাটির কাছাকাছি থাকা নাম-না-জানা অসংখ্য মানুষ, তেমনি এসব মানুষও ছয় বছর কান পেতে ছিলেন শেখ হাসিনার মতো নেতার ডাক শোনার অপেক্ষায়। পঁচাত্তরের শোকাঘাতের পর তারা যে অনাথ হয়ে পড়েছিলেন। কত নির্যাতন, কত দুঃসহ অসম্মান সয়ে সয়ে তারা কেবল মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন শেখ হাসিনার মতো একজন যথার্থ নেতার অপেক্ষায়। এরপরের অধ্যায় তো সকলের জানা।

দুঃসহ শোক বুকে বয়ে এরপর শেখ হাসিনা সামনে এগোলেন। কত ষড়যন্ত্র, বারবার বর্বর আঘাত, একের পর এক বাধা পেরিয়ে তিনি অবিচল থাকলেন। বলতে গেলে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো। লক্ষ্য একটাই, দেশটাকে বাঁচাতে হবে দানবের হাত থেকে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। পিতার খুনিদের বিচার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগিয়ে তুলতে হবে জাতিকে। আর, বাংলাদেশকে বিশ্বমাঝে বসাতে হবে সম্মান ও সম্ভ্রমের আসনে। স্রোতের বিরুদ্ধে এগিয়ে ভগ্ন তরিকে তিনি আজ পৌঁছে দিয়েছেন সুবর্ণবন্দরে। একদিন যাকে অধরা মনে হয়েছিল।

লেখক : আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
একে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি