পুঁজিবাজার আর ক্রিকেট যেন একই সুতোয় গাঁথা!
প্রকাশিত : ০০:১০, ২৫ নভেম্বর ২০১৯
মাহমুদুল্লাহর আউটের দৃশ্য
বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ প্রশংসিত হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সাত শতাংশেরও বেশি। রপ্তানি আয় বাড়ছে, রিজার্ভও আছে সন্তোষজনক পর্যায়ে। মানুষের মাথাপিছু আয়ও যেমন বাড়ছে, দেশের অবকাঠামোগত উন্নতিও হচ্ছে। অর্থনীতির সব সূচকেই ইতিবাচক ধারা বিদ্যামান।
কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু পুঁজিবাজার। অর্থনীতির কোনও সূচকের সাথেই কোনও সামঞ্জস্য নেই পুঁজিবাজারের সূচকের। ক্রমাগত পতনে নেতিবাচক দেশের পুঁজিবাজার। যাতে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। মাঝে মাঝে নীতি নির্ধারকরা কিছু পদক্ষেপ নিলেও তাতে বিনিয়োগকারীদের লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না।
ঠিক একই রকম অবস্থা বাংলাদেশের ক্রিকেটেও। এই আছে, এই নেই। যেন একই সুতোয় গাঁথা দুটি ফুল। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে এখনও উঠে দাঁড়িয়ে স্থির হতে পারেনি ক্রিকেট। মাঝে মধ্যে একটু আধটু ঝলক দেখালেও ক্রমাগত পতনুন্মুখ দেশের ক্রিকেট। সাকিব-তামিম-মাশরাফিদের পাওয়া সে সব সাফল্যে দেশের ১৬ কোটি মানুষের আনন্দ-আবেগ যেন ৩২ কোটিতে রূপ নেয়।
রীতিমত দুঃসময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট, বিশেষ করে টেস্টে। মূলত বিশ্বকাপের পর থেকেই দুর্দশার চিত্রটা ফুটে ওঠে। যা সদ্য সমাপ্ত ভারত সিরিজে দেখা দেয় আরও প্রকটভাবে।
সম্প্রতি ভারত সফরে দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি বিরল কোনও ঘটনা নয়। অনেকটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
ভারতের বিপক্ষে গোলাপি বলে দিবা-রাত্রির টেস্ট ক্রিকেটের ম্যাচে বাংলাদেশ ইনিংস ও ৪৬ রানে হারের লজ্জা পেয়েছে। এর আগে ইন্দোরেও তিন দিনে হেরেছে ইনিংস ও ১৩০ রানের বিশাল ব্যবধানে। ১৯ বছরে ১১৭ টেস্ট বাংলাদেশ এ নিয়ে মোট ৮৮টি ম্যাচ হারল; যার মধ্যে ৪২টিই ইনিংস পরাজয়। জয় পেয়েছে মাত্র ১৩টিতে। যার ৬টি আবার দুর্বল জিম্বাবুয়ে এবং ৪টি হালের খর্বশক্তি উইন্ডিজের বিপক্ষে।
এই ১৯ বছরেরও কেউ হলফ করে বলতে পারবে না যে, বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মাঝে টেস্ট খেলার কোনও মানসিকতা রয়েছে!
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশ জিতেছে। কিন্তু বাংলাদেশের তো ঘরোয়া পর্যায়ের চারদিনের ক্রিকেট ততোটা শক্তিশালী নয়। এই মুহূর্তে ভারতকে হারানো অবশ্যই কঠিন। কারণ দলে নেই দুই অভিজ্ঞ পারফর্মার সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। তাদের ছাড়া বাকিরা বেশ দুর্বল হলেও মুমিনুল, ইমরুল, মাহমুদউল্লাহরা যেভাবে খেলেছেন তা ভারতের বিপক্ষে নিতান্তই কম হয়ে যায়।
দিবারাত্রির এই টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল সন্ধ্যায় ব্যাটসম্যানরা কেমন ব্যাট করে। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত টেকেনি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ১০৬ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। জবাবে বাংলাদেশ যখন বল করতে নামে, ভারত রান তোলে ৯ উইকেটে ৩৪৭। এরপর ইনিংস ঘোষণা করেন বিরাট কোহলি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই বিরাট কোহলি ও তার দলের মনোভাব পরিষ্কার হয়ে যায়, দুই দিনের মধ্যেই খেলা শেষ করতে চান তারা।
এই লক্ষ্যে ইশান্ত শর্মার আগ্রাসী বোলিংয়ে মাত্র ১৩ রানেই চারটি উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। এর ওপর আবার চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শুধু এই টেস্টেই বাংলাদেশের তিনজন ক্রিকেটার চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন। লিটন দাস, নাইম হাসান ও সর্বশেষ রিয়াদ।
যেমন আয়োজন দিয়ে শুরু হয়েছিল কলকাতা টেস্ট, মাঠের ক্রিকেটে সেটার প্রতিফলন ছিল না। বাংলাদেশের সব ব্যাটসম্যান ব্যর্থ। সাদমান ইসলাম অনিক যাকে বাংলাদেশের টেস্টে নিয়মিত দলে নেয়া হচ্ছে, তিনি ৪ ইনিংস মিলিয়ে রান তুলেছেন ৪১।
ইমরুল কায়েসকে দলে নেয়ার জন্য অনেক 'লড়াই-সংগ্রাম' হয়ে থাকে সব সময়। সেই অভিজ্ঞ ইমরুল ঘরোয়া ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলে ঢুকেছেন। কিন্তু ভারত সফরে ৪ ইনিংস মিলিয়ে তিনি তুলেছেন মাত্র ২১! রানের স্বল্পতার চেয়েও বড় ব্যাপার ইমরুল কায়েসকে কোনও ইনিংসেই আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি। বরং বোলারদের পরিকল্পনা মাফিকই ব্যাট চালিয়ে আউট হয়েছেন বারবার।
মুমিনুল হক দীর্ঘদিন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যানের তকমা নিয়ে আছেন। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে দুই ইনিংসেই 'ডাক' মারেন তিনি!
ভারতের বিপক্ষে 'ডাবল ডাক' পাওয়া প্রথম ক্রিকেট অধিনায়ক মুমিনুল হক। প্রথম টেস্টেও ব্যর্থ হন মুমিনুল হক, আউট হন ৩৭ ও ৭ রান করে। অর্থাৎ পুরো সিরিজে চার ইনিংস ব্যাট করে তিনি রান তুলেছেন ৪৩। ইন্দোর টেস্টের প্রথম ইনিংসে মুমিনুল হক অশ্বিনের অফ-স্টাম্প লাইনের বল ছেড়ে দেন। যেটা সোজা গিয়ে লাগে অফ-স্টাম্পেই। এরপরের তিন ইনিংসেই বোলারের গতির কাছে পরাস্ত হন মুমিনুল।
যদিও ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার একটা আভাস দিয়েছিলেন মুমিনুল হক। কিন্তু যত দেশের বাইরে খেলা শুরু হয়, ততই তার ব্যাটিংয়ের ভুল-ভ্রান্তি চোখে পড়তে থাকে।
পেস ও স্পিন দুই ধরণের বোলিংয়েই নির্দিষ্ট কিছু ডেলিভারি মুমিনুল হক বরাবরই খেলতে পারেননি। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি সিরিজ চলাকালীন বাংলাদেশের তৎকালীন কোচ হাথুরুসিংহে মুমিনুল হকের স্পিন বল খেলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হাথুরুসিংহে বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরের সিরিজেই মুমিনুল হক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই একই টেস্টে দুটো সেঞ্চুরি করেন, যার মধ্যে একটি ইনিংস ছিল ১৭৬ রানের। কিন্তু তারপরে বাংলাদেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ছাড়া বলার মতো রান নেই মুমিনুল হকের ব্যাটে। দেশের মাটিতে মুমিনুল হকের টেস্ট গড় ৫৫, দেশের বাইরে ২১।
মোহাম্মদ মিথুন, যিনি বাংলাদেশের হয়ে ৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন, তার টেস্ট গড় ২০। এই টেস্ট সিরিজে চার ইনিংস ব্যাট করে তিনি রান তুলেছেন ৩৭।
অন্যদিকে, এই সিরিজে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যান হলেন মুশফিকুর রহিম। যিনি চার ইনিংসে রান তুলেছেন ১৮১। দুটি হাফ-সেঞ্চুরিও করেছেন। তবে কলকাতা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ইনিংস পরাজয় এড়াতে ৫৪ রান প্রয়োজন, তখন ব্যক্তিগত ৭৪ রানে সামনে এগিয়ে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হন মুশফিক! যা নিয়ে রীতিমতো সমালোচনা হচ্ছে।
এদিকে গণমাধ্যমে ও সংবাদ সম্মেলনে একটা প্রশ্ন উঠেছে যে, মুশফিকুর রহিম কেনও চার নম্বরে নামছেন না। সরাসরি মুশফিকের পক্ষ থেকে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে ২০ গড়ের মোহাম্মদ মিথুন যখন চার নম্বরে খেলছেন সেটা গোটা দলের ব্যাটিংয়েই প্রভাব ফেলছে।
লিটন দাস ২ ম্যাচের ৩ ইনিংস ব্যাট করে ইডেনে আহত হয়ে মাঠ ছাড়েন। তিন ইনিংসে তার রান ৮০। তিনিই এই সিরিজে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সফলতম ব্যাটসম্যান। কলকাতা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন মাহমুদউল্লাহ। যিনি এই পুরো সিরিজ জুড়েই বাজে শট খেলে আউট হয়ে মাঠ ছেড়েছেন। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন ওয়ানডে খেলতে নেমেছেন!
এই যদি হয় টেস্টে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিত্র! তাহলে কিভাবে আসবে সাফল্য? কিভাবে হবে দেশের টেস্ট ক্রিকেটের উন্নতি! ইডেনের ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে অবশ্য এসব প্রশ্নের জবাবই দিয়ে গেলেন ভারতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি।
এমনকি বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এবং বোর্ড উভয়ই টেস্ট ক্রিকেটের গুরুত্বটাই বুঝতে চাইছে না বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি।
ভারত অধিনায়ক বলেন, ‘তারা যদি আরও টেস্ট খেলে তবে আরও অভিজ্ঞ হবে। যদি দুই টেস্ট খেলে মাঝে ছয় মাসের বিরতি পড়ে যায় তাহলে আপনি বুঝবেন না চাপ কীভাবে সামলাতে হয়। অথবা চাপের মধ্যে কিভাবে খেলতে হয়।
কোহলি আরও বলেন, দেখুন, তাদের স্কিল আছে। তাদের সামর্থ্য আছে বলেই তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে। তবে আরও ভালো করতে নিয়মিত ম্যাচ (টেস্ট) খেলতে হবে। তাদের খেলোয়াড় ও বোর্ডকে বুঝতে হবে টেস্টের গুরুত্ব কতটা। টেস্টে ভালো করার এটাই একমাত্র উপায়।’
কোহলির দেয়া এ পরামর্শগুলোই দেশের ক্রিকেটার এবং বোর্ড কর্তারা বুঝে নিয়ে সে মতে কাজ শুরু করলেই তবে এই দুর্দশা, এই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশের ক্রিকেট উঠে দাঁড়াতে পারবে বলেই মনে করেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা।
আর এজন্য ঘরোয়া ক্রিকেটকে আরও গুরুত্ববহ ও ফলপ্রসূ করতে হবে এবং টাইগারদের বেশি বেশি করে টেস্ট ম্যাচ খেলানোর ব্যবস্থা করতে হবে বোর্ডকেই। তবে এখন বোর্ড এ বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এনএস/