ভুল পথে বাংলাদেশ ক্রিকেট, প্রমাণ করলো নিউজিল্যান্ড
প্রকাশিত : ১৫:১৫, ৩১ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ১৫:১৯, ৩১ মার্চ ২০২১
মঙ্গলবার রাতে ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠা সৌম্যের পিছনেই কিউই তারকা ডেভন কনওয়ে।
ডেভন কনওয়ে। এবারের নিউজিল্যান্ড সফরজুড়ে বাংলাদেশের জন্যে এই একটা নামই যেন মূর্তমান আতংক স্বরূপ। গোটা সিরিজেই এক কনওয়েই দলের জয়ে ডমিনেট করে আসছে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে। অথচ দেখুন, পুরো সিরিজজুড়েই বাংলাদেশী বোলারদের ঘাম ঝরানো অন্যতম এই কিউই ব্যাটসম্যানের কিন্তু এটা অভিষেক সিরিজ!
যদিও খেলা দেখে কিংবা শরীরী ভাষায় ঠিক বোঝার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের বিপক্ষে এই সিরিজ দিয়েই সবে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা পড়েছে ডেভনের। কতোটা স্বাচ্ছন্দে ও স্বাবলীলভাবেই না খেলে যাচ্ছেন বাংলাদেশী বোলারদের। স্পিন কিংবা পেস- দুই ধরণের বোলারদের বিপক্ষেই একেবারে মুড়ি মুড়কির মতো করেই পুরো সিরিজে উইলো চালিয়েছেন ডেভন কনওয়ে।
এবার যদি বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকানো হয়, তবেই সব হিসাব ঘুরে যায় ৯০ ডিগ্রী কোণে। বিসিবি বোর্ডকর্তাদের ভাষ্যে- প্রতিভায় টইটম্বুর লিটন, সৌম্য, মিঠুন, শান্তদের পারফরম্যান্সে অন্তত তা-ই মনে হয়।
কিউইদের ডেভন কনওয়ে কিংবা উইল ইয়ংদের দেখে যদি আপনার মনে হয়- নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের শ্রম, অর্থ ব্যয় কিংবা সকল ইনভেস্টমেন্টের অভেদ্য এক দীপ্ত প্রতিফলন। তবে বাংলাদেশের সৌম্য, লিটন কিংবা মিঠুন, শান্তদের দেখে আপনার মনে হতেই পারে- সঠিক পরিকল্পনার কিংবা সঠিক পরিচর্যার অভাবে ধুঁকতে থাকা আধমরা গাছ বুঝি বিসিবি ডিসপ্লে করছে আমাদের সামনে। যেই গাছ অঙ্কুরিত হওয়ার পর সজীব থাকলেও সময়ের চাকা যতো গড়িয়েছে গাছের পাতাগুলো যেন ততোই ঝিমিয়ে পড়েছে, যেমনি ফর্মহীনতায় সৌম্য-লিটন-শান্তরাও নিজেদের বারবার হারিয়ে খুঁজে ফেরে।
কনওয়ে কিংবা ইয়ংরা নিউজিল্যান্ডের কতোটা পরিকল্পনার কিংবা ইনভেস্টমেন্টের উদাহরণ তা বুঝতে হলে চলুন নজর দেই তার ক্যারিয়ারে। বর্তমানে কনওয়ের বয়স ২৯ বছর। এই বয়সটাকে আমাদের দেশের ক্রিকেটের সংস্কৃতিতে ধরে নেওয়া হয় বুড়িয়ে কিংবা ফুরিয়ে যাওয়ার সময়। কিংবা ক্যারিয়ারের বেলা এই বুঝি যাচ্ছে অস্তে।
সেখানে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড কনওয়ের অভিষেকটাই করিয়েছেন আমাদের দেশের হিসাবে ক্যারিয়ারের এই পড়ন্ত বেলাতেই। যার ফলও পেয়েছে হাতেনাতেই। এই সিরিজ দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করা কনওয়ে তিন ওয়ানডে খেলে একটি সেঞ্চুরি ও একটি ফিফটিতে ৭৫ গড়ে ২২৬ রান করেছেন। যেখানে তার সর্বোচ্চ ইনিংস ১২৬।
অন্যদিকে, গত বছরের ২৭ নভেম্বর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হওয়া কনওয়ে এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন ১৩টি। সেখানে ১১ ইনিংসে ৪টি ফিফটিতে ৫৯.১২ গড়ে তার রান ৪৭৩। সর্বোচ্চ ইনিংসে অপরাজিত ৯৯। রীতিমত চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্স।
কিন্তু তার আগে?
তার আগে কনওয়ের জীবনে রয়েছে রোমাঞ্চকর কিছু গল্প। পুরো নাম ডেভন ফিলিপ কনওয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গের ট্রান্সভালে জন্মানো এই ক্রিকেটার ২০১৭-২০১৮ মৌসুমে স্বপরিবারে পাড়ি জমান নিউজিল্যান্ড। সেখানে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। এই কয় বছরে কনয়ের ব্যাটে এসেছে ৪ হাজারের অধিক রান।
কিন্তু তারও আগে শুরু ২০০৯ সালে শুরু হয়েছে কনওয়ের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সেখানে রান করেছেন ৭ হাজারের অধিক। একবার নির্বাচিত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের বর্ষসেরা ডমেস্টিক ক্রিকেটার হিসেবেও।
যাইহোক, সেসব গল্প পরে একদিন হবে। এখন প্রসঙ্গে ফিরি। বাংলাদেশের সৌম্য, লিটন, মিঠুন- এদের বয়স মোটামুটি ২৬ থেকে ২৯ এর মধ্যেই। কিন্তু এদের খেলা আর কনওয়ের প্রতিটা শট সিলেকশন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখলে মনে হয়- এই ব্যাটসম্যান বুঝি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ৫-৬ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। অথচ আন্তর্জাতিক এরেনায় সবেই যাত্রা শুরু হলো তার।
অন্যদিকে বাংলাদেশের লিটন, সৌম্য, মুস্তাফিজ, মিঠুন, মেহেদী মিরাজদের ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উল্টোটা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ৫-৭ বছরে ধরে ক্রিকেট খেলেও এখনও জুনিয়র হিসেবেই দিব্যি পরিচয় পেয়েই যাচ্ছেন দেশের ক্রিকেটে। আর ক্রিকেট বোর্ড কর্তাদের কাছে প্রতিভাবান হিসেবে!
কিন্তু বাস্তবতা হলো- প্রতিভা আছে বলেই ক্ষণিকের ভালোর জন্যে এদের ক্যারিয়ার যেমনি ঠেলে দেওয়া হচ্ছে চরম অনিশ্চতার মধ্যে, তেমনি দেশের ক্রিকেটও যেন ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে তার নিজস্ব অরিজিনাল ফ্লেভার কিংবা রঙটাই।
রঙচটা এই দেশীয় ক্রিকেটে অভাবনীয় কিছু পরিবর্তন অতি শীঘ্রই না আনলে দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত নিয়ে আপনারা উদ্বেগে থাকুন। যদি এমন চলতে থাকে তবে দেশের ক্রিকেট হয়তো একদিন প্রতিভা দিয়েই আলো দেখবে, আর মাঠে নামলেই অন্ধকার ধেঁয়ে আসবে।
ঘরোয়া লীগের মান উন্নত করে যদি দেশের পাইপ লাইনের ক্রিকেটারদের সর্বোচ্চভাবে পরীক্ষায় পরীক্ষিত করে জাতীয় দলের অধীনে আনার প্রেসেসটা আরও উজ্জ্বল হয়, তাহলেই হয়তো কোনওদিন এদেশে কনওয়েদের মতো নতুন নতুন তারার দেখা মিলতেও পারে! নাহলে নতুন তারা আসবে-যাবে, থিতু হবেনা কেউই!
সুতরাং এখনই সময় নতুন করে ভাববার। এখনই সময় নতুন কিছু করার। তবে তা অবশ্যই চটকদার কিছু নয়। সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা প্রসূত কার্যকরী কর্মপরিকল্পনাই পারে স্থায়ী সাফল্য এনে দিতে।
এনএস/