সাকিবের যত অপকাণ্ড
প্রকাশিত : ১০:১০, ১২ জুন ২০২১
লাথি মেরে স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন সাকিব আল হাসান।
শুক্রবার (১১ জুন) ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুরের শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ডিপিএলের হাই ভোল্টেজ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ঢাকা আবাহনী ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। যে ম্যাচে বৃষ্টি আইনে ৩১ রানে জয় পায় মোহামেডান। তবে মাঠের খেলা ছাপিয়ে ম্যাচে আলোচনায় উঠে আসে আম্পায়ার ও আবাহনীর কর্মকর্তাদের সাথে সাকিবের দ্বন্দ্ব ও অসৌজন্যমূলক আচরণ।
যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটীয় আইন ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি হিসেবে নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানা উভয়ই পেতে পারেন সাকিব।
ঘটনাটি ঘটে আবাহনীর ইনিংসের পঞ্চম ওভারের শেষ বলে। ১৪৫ রান তাড়া করতে নেমে ৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল আবাহনী। তখন প্রথমবারের মতো আক্রমণে আসেন সাকিব। তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে মুশফিক চার ও ছয় মারার পর শেষ বলটি মুশফিকের প্যাডে আঘাত হানলে জোরালো আবেদন করেন সাকিব।
কিন্তু সে আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দিলে রাগে ক্ষোভে লাথি মেরে বোলিং প্রান্তের স্ট্যাম্প ভেঙে ফেলেন সময়ের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার। আম্পায়ারের সাথে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করার পর সাকিবকে সরিয়ে নেন সতীর্থরা। এরপর বৃষ্টি নামার আগেই খেলা বন্ধ করায় আম্পায়ারের সামনেই স্ট্যাম্পগুলো তুলে আছাড় মারেন সাকিব। পরে বিবাদে জড়ান আবাহনীর কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনের সাথেও। এ সময় আবাহনীর দর্শক ও কর্মকর্তাদের উদ্দেশে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ সাকিবের বিরুদ্ধে।
চলতি ডিপিএলে এর আগেও বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন সাকিব। জৈব সুরক্ষা বলয়ের নিয়ম ভেঙে অনুশীলনে বাইরের বোলার এনে ছিলেন তিনি। আর তাই এবার অসৌজন্যমূলক আচরণ বা আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ফেঁসে যাচ্ছেন সাকিব। ম্যাচ শেষে আম্পায়াররা ম্যাচ রেফারি মোর্শেদুল আলমের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেছেন। সাকিবের দোষের মাত্রা বিবেচনা করে তাকে শাস্তি দেবেন ম্যাচ রেফারি।
সাকিব অবশ্য তার অশোভন আচরণের জন্য খেলা শেষে ম্যাচ অফিসিয়ালদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। আবাহনীর ড্রেসিংরুমে গিয়ে ক্ষমাও চেয়েছেন সুজনসহ অন্যদের কাছে।
বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্ব
তবে সাকিবের এমন দৃষ্টি কটু আচরণ বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন নয়। যা নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাথে বেশ কয়েকবার মুখোমুখি অবস্থানে ছিলেন সাকিব। ইতিহাস বলছে, সাকিব আল হাসানের সাথে বোর্ডের দ্বন্দ্বও নিয়মিত ঘটনা।
ক্রিকেটারদের দেনাপাওনা ইস্যুতে ২০১৯ সালে যে ধর্মঘট হলো, সেখানে ক্রিকেটারদের নেতৃত্ব দেন সাকিব, ফলে নেতা হিসেবে এই দ্বন্দ্বে ক্রিকেট বোর্ডের মুখোমুখি হতে হয় সাকিবকেই।
কারণ দর্শাও নোটিশ
এর পরই বোর্ডের কাছ থেকে কারণ দর্শাও নোটিশ পেয়েছেন সাকিব। অভিযোগ, শর্ত ভঙ্গ করে একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানের সাথে বিজ্ঞাপনের চুক্তি করেছেন সাকিব।
কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠেছে ক্রিকেট মহলে, যেহেতু সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের একজন নিয়মিত মুখ, সেহেতু এর আগে কি এমন ঘটনা ঘটেনি? চলুন জেনে নিই, এরকম আরও কিছু ঘটনা:
ফটোসেশনে অংশ না নেয়া
বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরুর আগে যে আনুষ্ঠানিক ছবি তোলার আয়োজন করা হয় সেখানে অংশ নেননি সাকিব আল হাসান। ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল ঢাকায় মিরপুর শের-এ-বাংলা স্টেডিয়ামে এই আয়োজন হয়, যেখানে সাকিব স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ফটোসেশনে অংশ না নিয়ে বেরিয়ে যান।
এ বিষয়ে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন বলেন, "ফটোসেশনে সাকিবের অনুপস্থিতি সত্যিই দুঃখজনক। আমি স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় সাকিবকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায়? ও বললো, আমি তো ঢাকায় চলে এসেছি। আপনার বাসায় আসবো রাতে। আমি বললাম, কেন? এখনই তো দেখা হবে। ও বলল, না, আমি বেরিয়ে গেছি। আমি পরে জানতে পারলাম যে সাকিবকে আগেই বলা হয়েছিল আজ দলের ফটোসেশন হবে। জাতীয় দল বিশ্বকাপে যাচ্ছে, তাই সবার সঙ্গে সাকিবকেও ফটোসেশনে দেখার আশা করেছিলাম। কিন্তু সে ছিল না।"
টেস্ট খেলতে চান না সাকিব
আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে ও পরে সাকিব আল হাসান অধিনায়কত্ব নিয়ে অনীহা প্রকাশ করে বলেন, এই বিষয়ে বোর্ডের সাথে আলোচনা করার আছে। বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন তখন সাংবাদিকদের বলেন যে, টেস্ট খেলতে না চাওয়ার কারণেই সাকিব অধিনায়কত্ব নিয়ে অনীহা প্রকাশ করেন।
২০১৭ সালে সেপ্টেম্বরে টেস্ট থেকে বিশ্রাম নিতে ছয় মাসের ছুটি চেয়েছিলেন সাকিব। বিসিবি তখন তিন মাসের ছুটি মঞ্জুর করেছিল। এজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজ খেলা হয়নি সাকিবের।
অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির কারণে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ
২০১৪ সালেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিব আল হাসান টেলিভিশন ক্যামেরার দিকে একটি অঙ্গভঙ্গি করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। এরপর সাকিবকে ৩ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ও ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে বিসিবির ডিসিপ্লিনারি কমিটি।
২০১৪ সালে ছয় মাসের শাস্তি
বোর্ডের শৃঙ্খলাভঙ্গ ও আচরণগত সমস্যার অভিযোগে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই সাকিব আল হাসানকে ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক সব ধরণের ক্রিকেট থেকে ছয় মাসের জন্যে নিষিদ্ধ করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। এছাড়া শাস্তি হিসেবে পরবর্তী দেড় বছর দেশের বাইরে কোনো টুর্নামেন্টে খেলার জন্য এই অলরাউন্ডারকে অনাপত্তিপত্র না দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছিল বিসিবি।
এরপর আবেদনের প্রেক্ষিতে সাকিব আল হাসানের শাস্তি কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ড। এতে দেশের হয়ে জাতীয় দলে ও ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার ক্ষেত্রে সাকিবের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তিন মাস কমে যায়।
ভক্তের সাথে তর্ক
২০১৮ সালে আমেরিকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালীন সাকিব আল হাসান এক ভক্তের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সাকিব তার নিজ ফেসবুকে ব্যখ্যা দেন।
ভক্তের ফোন ছুড়ে ফেলা
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে সামনে দেখে ভক্তদের আবেগপ্রবণ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা, বড় বিজ্ঞাপন যে তিনিই। স্বাভাবিকভাবেই তাকে সামনে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি এক ভক্ত। সাকিবকে দেখে তাই দৌড়ে গিয়েছিলেন ছবি তুলতে। অনুমতি না নিয়ে মুখের সামনে সেলফির ভঙ্গিমায় ফোন তুলতেই রেগে যান সাকিব।
শুধু রেগেই যাননি, উগ্র মেজাজে সেই ভক্তের ফোন কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার! তার এমন আচরণে ব্যথিত, মর্মাহত, ক্ষুব্ধ শত শত ভক্ত। এই ঘটনায় বেনাপোলে সাকিবপ্রেমীদের মাঝে সৃষ্টি হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ঘটনাটি ঘটে গতবছর বেনাপোল চেকপোস্ট আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন ভবনে।
ফিক্সিংকাণ্ড
বাজিকরদের কাছ থেকে অফার পেয়ে তা গ্রহণ না করলেও, সেটা নিজ বোর্ড কিংবা আইসিসির কাছে না জানানোর অপরাধে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা ভোগ করতে হয়েছে সাকিব আল হাসানকে। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞামুক্ত হন সাকিব আল হাসান।
এনএস/