কথার আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন!
প্রকাশিত : ১৭:১৪, ৩০ অক্টোবর ২০২১
বিশ্বকাপে টিম বাংলাদেশ
কথার লড়াইটা চলছে বেশ জোরেশোরেই। যেন এক মহাযুদ্ধ! যেন সবাই সবার প্রতিপক্ষ! বিসিবি প্রেসিডেন্ট ঢিল ছুড়ছেন তো অধিনায়ক থেকে সিনিয়র ক্রিকেটাররা ছুড়ছেন পালটা পাটকেল। স্বজনরাও কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন। আছে সামাজিক মাধ্যমে আমজনতার নিরন্তর কাটাছেঁড়াও।
এসবের ফাঁকে ক্রিকেটটাই কেবল মিইয়ে যাচ্ছে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। অথবা চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত ক্রিকেটটাই মিলছে বলেই এসব হচ্ছে কিনা, কে জানে?
বড় আশা নিয়ে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। বড় বড় কথা বলে; বড় স্বপ্নের মাদল বাজিয়ে! ক্রিকেট-মাদকতায় বুঁদ হয়ে থাকা ১৮ কোটির হৃদয়ে সেমিফাইনালের আশার রং ছড়িয়ে। কিন্তু প্রত্যাশার সঙ্গে পারফরম্যান্সের বিশ্বাসঘাতকতা হলো বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই! আততায়ী স্কটল্যান্ডের কাছে অতর্কিত পরাজয়ে।
ব্যস, পড়ল ঢোলে বাড়ি! বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন কাঠগড়ায় দাঁড় করান পুরো দলকেই। বিশেষত তিন সিনিয়র মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসানকে। জবাব দিতে তাঁরাও সময় নেননি মোটেও। না, মাঠের ক্রিকেটে না। মুখের কথার তুবড়িতেই। তাতে মিশে থাকে যাবতীয় যন্ত্রণা, হতাশা, কষ্ট ও ক্রোধ।
হোঁচটে শুরুর পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওমানের বিপক্ষে জয় বাংলাদেশের। বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ মানে মূল পর্বে ওঠাটাই তখন অনেক যদি-কিন্তুর সমীকরণে। সেমির স্বপ্ন বুঝি দূরের অলৌকিক অদেখা ভুবন। কিন্তু এ নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন করতেই সাকিব বলে ওঠেন, ‘স্বপ্ন কি প্রতিদিন বদলায় নাকি? আপনারা বললে বদলে ফেলব’- এমন উত্তরে মিশে থাকে ব্যঙ্গ, তাচ্ছিল্য।
পরের ম্যাচ শেষেই দেখা যায় অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহর আবেগের অগ্নুৎপাত। ক্রিকেটারদের ‘ছোটো’ করা, পরিবারের দুঃখগাঁথা, পেইনকিলারের ব্যথা- সব উঠে আসে তাঁর ব্যথাতুর শব্দবাক্যে। ত্রয়ীর তৃতীয়জন মুশফিকুর রহিম বাকি থাকবেন কেন? তিনি এরপর দেন আয়না-তত্ত্ব। সমালোচকদের আয়নায় মুখ দেখার পরামর্শ।
ক্রিকেটাররা এভাবেই প্রথমে ঠারেঠোরে, এরপর একরকম ঘোষণা দিয়ে প্রতিপক্ষ বানিয়ে তোলেন সবাইকে। বিসিবি প্রেসিডেন্ট, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বুঝ-অবুঝমান সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী, নির্বিশেষে সবাইকেই। স্ফূলিঙ্গ হয়ে ওঠে দাবানল। সমালোচনার দাউ দাউ আগুনে মোমের মতো পুড়তে থাকে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্বপ্ন!
এখানে অবশ্য সব পক্ষেরই দায় দেখছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের সবার দোষ। স্কটল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচ হারের পর বোর্ড সভাপতি যেভাবে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন, সেভাবে না বললেই হত। এটার প্রভাব সবার মধ্যেই পড়েছে।’
তাহলে, বোর্ড সভাপতির কথাতেই কি সাকিব-মুশফিক-মাহমুদুল্লাহদের অমন প্রতিক্রিয়া? আশরাফুল বলেন, ‘আমার কাছে তাই মনে হয়। এটা স্পষ্টই বোঝা গেছে। ওমানের সঙ্গে ম্যাচে সব ক্রিকেটারের চেহারা দেখে খুব টেনসড মনে হয়েছে। সবাই একদম ছোটো হয়ে ছিল। মাহমুদুল্লাহ, মুশফিককে সাত-আট নম্বরে পাঠানো...৷ টুর্নামেন্টের শুরুতে এই ধরনের বিষয়গুলোর একটা প্রভাব পড়েছে।’
কিন্তু মাঠে গিয়ে তো শেষপর্যন্ত ক্রিকেটাররাই খেলেন। তারা যদি অমন প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া না দেখাতেন, তাহলে কি তাদের জন্য আরেকটু নির্ভার হয়ে খেলাটা সম্ভব ছিল? নাকি নিজেদের হতাশা দূর করার জন্য এভাবে বলাটাও প্রয়োজন ছিল?
এ প্রসঙ্গে আশরাফুল তুলে আনেন অতীতের উদাহরণ। সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, ‘বোর্ড প্রেসিডেন্ট তো দীর্ঘ ৯ বছর ধরে আছেন। উনি সবসময়ই এমন করেই বলেন। ২০১৫ সালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে প্রথম ম্যাচে আমরা ১৬০ রানে অলআউট হয়ে গেলাম। উনি সবাইকে ডেকে কথা বললেন। এরপর আমরা সিরিজ জিতে গেলাম। আসলে এক-একজন এক-একভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান। তখন মাশরাফি অধিনায়ক ছিল; সে একভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে। তখন হাতুরাসিংহে কোচ থাকায় এবং সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ) দলের সঙ্গে থাকায় ব্যাপারটা ভালোভাবে সামলাতে পেরেছে। এখন ওই জায়গায় কেউ নেই বলেই হয়তো ক্রিকেটারদের প্রতিক্রিয়া একটু বেশি হয়েছে। তবে ক্রিকেটাররা এমনভাবে প্রতিক্রিয়া না দেখালে আরও একটু ভালো পারফর্ম করতে পারত৷’
তাহলে কি সামগ্রিকভাবে বোর্ডের সঙ্গে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের দূরত্বটাই মিডিয়ার সামনে বেরিয়ে এলো? আশরাফুলের তেমনটাই মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভিতরের খবর তো জানি না। বাইরে থেকে আমার কাছে তো তা-ই মনে হচ্ছে। বোর্ড প্রেসিডেন্ট এমন কথা নতুন বলছেন না। যখনই খারাপ হয়, তখনই বলেন। এরপর আমরা আবার সাফল্যও পেয়ে যাই। ক্রিকেটাররা ওভাবে রিঅ্যাক্ট না করে টুর্নামেন্টটা অন্তত ভালোভাবে শেষ করার কথা ভাবতে পারত। আসলে দু’দিকেই আছে। ক্রিকেটাররাও হয়তো ভেবেছে, যথেষ্ট হয়েছে। প্রতি সিরিজেই হয়তোবা এসব শুনতে আর ভালো লাগে না।’
এদিকে, বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক শাহরিয়ার নাফিস সামনে আনতে চান বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স। এসব কথা চালাচালির প্রভাবেই কি দল খারাপ খেলছে? এমন প্রশ্নের জবাবে নাফিস বলেন, ‘আমার মনে হয় উল্টোটা। দলের পারফরম্যান্স খারাপ হয়েছে বলেই এত কিছু হচ্ছে। পাপন ভাইয়ের সঙ্গে ক্রিকেটারদের সম্পর্কের ব্যাপারে তো আগে আমার খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কিন্তু এখন বোর্ডে কাজ করার সূত্রে সেটা জানি। বোর্ড প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ক্রিকেটারদের যেমন সম্পর্ক, তাতে এমন কিছু বলার অধিকার পাপন ভাইয়ের আছে। সাকিবও তো সেদিন বলল, পাপন ভাই যে কথা বলেন, সেগুলো মাঝেমধ্যে আমাদের কাজে লাগে। সবমিলিয়ে আমার মনে হয়, মাঠের ক্রিকেটে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না বলেই সবাই চাপ অনুভব করছে। আর সেই চাপ থেকেই এসব কিছু হচ্ছে।’
একইভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে ক্রিকেটারদের কথা বলার সময়ও আরও সতর্কতার প্রয়োজনীয়তাও দেখেন নাফিস। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি ক্রিকেটারদের পক্ষে যাচ্ছে না। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় ক্রিকেটারদের আরও অনেক সচেতন থাকা উচিত। হ্যাঁ, সামাজিক মাধ্যমে সবসময় যে রেসপন্সিবল বিহেভিয়ার হয়, তা আমি বলব না। এটি ঝোঁকের উপর চলে, নিয়ন্ত্রণের উপায় তো নেই। ক্রিকেটারদের সেদিকে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজনও আমি দেখি না। তবে মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় অবশ্যই ওদের আরো সতর্ক হওয়া উচিত। তাহলে শেষপর্যন্ত ওদেরই লাভ হবে।’
ক্রিকেটারদের লাভ-লস যাই হোক না কেন, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের লাভের খাতায় যে কিছু যোগ হচ্ছে না, সেটা ইতোমধ্যেই জানা হয়ে গেছে সবারই! তবে সব পক্ষ মিলে ফুঁ দিয়ে যে আগুন জ্বালিয়েছে, সেটা নেভাতে পারে কেবল মাঠের পারফরম্যান্সই। তা না হলে মাঠ ও মাঠের বাইরে বাংলাদেশ ক্রিকেট হয়ে উঠবে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড, যার আগুনের আঁচ এড়াতে পারবে কি কেউ? (ডয়চে ভেলে অবলম্বনে)।
এনএস//