মাদক, যৌনতা, সাফল্য- এক নজরে শেন ওয়ার্ন
প্রকাশিত : ১৭:৪৭, ৫ মার্চ ২০২২
শেন ওয়ার্ন (১৯৬৯-২০২২)
বিশ্ব ক্রিকেটের বাঘা বাঘা নামজাদা ব্যাটারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন শেন ওয়ার্ন। বেশ কয়েকবার অবশ্য নিজেরও রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল তাঁর। পুরো ক্রিকেট জীবনে বিতর্ক যেমন পিছু ছাড়েনি। তেমনি অবসরের পরেও নাম জড়িয়েছে একাধিক কেলেঙ্কারিতে। শুক্রবার হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ওয়ার্ন। সঙ্গে ইতি পড়ল বিতর্কেও!
দুটি ভিন্ন রঙের চোখ থাকা ওয়ার্নের প্রথম বিয়ে হয় ১৯৯৫ সালে, সিমোনে কাল্লাহানের সঙ্গে। তিন সন্তানের বাবা-মা তাঁরা। ওয়ার্নের সঙ্গে সিমোনের বিবাহবিচ্ছেদ হয় ২০০৫ সালে। কিন্তু তাদের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল ৫ বছর আগেই। ২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব কেড়ে নেয়া হয় ওয়ার্নের। কারণ এক ব্রিটিশ নার্সকে যৌনইঙ্গিত পূর্ণ বার্তা পাঠিয়েছিলেন অজি তারকা।
ব্যাপক হারে সিগারেট খেতেন ওয়ার্ন। তারই একটি ছবি তুলে নিয়েছিল একটি ছেলে। সেই ‘অপরাধে’ ছেলেটিকে মারধরও করেন ওয়ার্ন। যার গুগলি ব্যাটারদের উইকেট ভেঙে দিত অনায়াসেই, শতাব্দীর সেরা বল করেছিলেন যে বোলার, সেই ওয়ার্ন যেন এই সময় অন্য এক চরিত্র। যেন অন্য এক মানুষ।
ওয়ার্নের সিগারেট প্রেমের কথা জানা যায় তারই এক সময়ের সতীর্থ মাইকেল ক্লার্কের কাছ থেকে। ২০০৬ সালে অ্যাশেজ সিরিজের আগে এক অনুশীলন ক্যাম্পে যাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া দল। সেই সময় শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য কিছু সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায় নিষেধ ছিল। তবে ওয়ার্ন বেছে নিয়েছিলেন সিগারেট!
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ওয়ার্ন সিগারেট খেতে পছন্দ করে। ও সেই ক্যাম্পে যাওয়ার আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, সিগারেট ছাড়া যাবে না। ওয়ার্ন তিন জোড়া অন্তর্বাস এবং মোজার বদলে সিগারেট নিয়ে গিয়েছিল।”
ক্লার্ক বলেন, “অন্ধকারের মধ্যে সবাই তখন স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে। শুধু একটা জায়গায় কমলা রঙের একটা আলো। স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে থেকেই ধূমপান করছে ওয়ার্ন।’’
১৯৯৭ সালে লন্ডনে অ্যাশেজ খেলতে গিয়েও সিগারেট খেতে দেখা গিয়েছিল ওয়ার্নকে। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ২২ বছরের ক্রিকেট জীবনে সিগারেট ছাড়েননি ওয়ার্ন। এক ‘তামাক বিরোধী’ সংস্থার সঙ্গে চুক্তিও করেছিলেন তিনি। সিগারেট ছেড়ে দেয়ার চুক্তি ছিল তাদের মধ্যে। যার ফলে স্থায়ী হয়নি সেই চুক্তি। মাত্র চার মাসের মধ্যেই ভেঙে যায়। কারণ ওই সময় বার্বাডোজে গিয়ে সিগারেট খেতে দেখা গিয়েছিল ওয়ার্নকে।
২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় অস্ট্রেলিয়া। সেই সময় ফের বিতর্কের শিরোনামে ওয়ার্ন। অভিযোগ ওঠে, আবারও এক নারীকে যৌনবার্তা পাঠিয়েছেন তিনি। কিন্তু যে নারী এই অভিযোগ করেন, তার বিরুদ্ধে সে দেশে অবৈধভাবে টাকা নেয়ার মামলাও ছিল।
এদিকে, সিমোনের সঙ্গে ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক ফের জোড়া লাগতে শুরু করে ২০০৭ সালে। ইংল্যান্ডে একসঙ্গে গিয়েছিলেনও তারা। কিন্তু হঠাৎই বিপত্তি। ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফেরেন সিমোনে। অপর এক নারীকে নিষিদ্ধ বার্তা পাঠাতে গিয়ে ভুল করে তা সিমোনের কাছে চলে যায়। আর তাতেই ফের ভেঙে যায় তাদের সম্পর্ক।
২০১০ সালে আবারও শিরোনামে ওয়ার্ন। ইংলিশ অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লেকে চুমু খেতে দেখা যায় অজি স্পিনারকে। সেই ঘটনা ফাঁস হতেই টুইট করে ওয়ার্ন জানান, ‘সিমোনের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে।’ যদিও সে খবর জানতেন শুধুই তাঁর পরিবার এবং কাছের বন্ধুরা।
এদিকে, অভিনেত্রী হার্লের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার সময়ও মেলবোর্নের এক বিবাহিত নারী ব্যবসায়ীকে ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পাঠানোর খবর আসে সামনে। কিন্তু ঘটা করেই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে ওয়ার্নের বাড়িতে থাকতে আসেন হার্লে। ২০১১ সালে তাদের বাগদান হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, ওয়ার্ন বিতর্কে জড়িয়েছেন তাঁর কর্মজীবনেও। ১৯৯৮ সালে জানা যায়, তিন বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে শ্রীলঙ্কার এক ব্যক্তিকে টাকার বিনিময়ে পিচ এবং আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিলেন ওয়ার্ন। নিজের আত্মজীবনীতেও সেই কথা উল্লেখ করেন তিনি।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগে দু’ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধও করা হয় ওয়ার্নকে। সংবাদমাধ্যমে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার নামে কটু কথা বলেন তিনি। সেই কারণেই আইসিসি দু’ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল ওয়ার্নকে।
এরপর ২০০৩ বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিন তো বাড়িতেই পাঠিয়ে দেয়া হয় ওয়ার্নকে। ডোপ নেয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। যদিও ওয়ার্ন বলেছিলেন তিনি ভুল করে মায়ের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই অপরাধে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে।
২০১৩ সালে বিগ ব্যাশ লিগে খেলার সময়ও এক ক্রিকেটারকে কটু কথা বলা, তাঁর শরীরে অশ্লীলভাবে হাত দেয়ার অভিযোগ ওঠে ওয়ার্নের বিরুদ্ধে। যে কারণে এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ এবং ৪ হাজার ৫০০ ডলার জরিমানাও দিতে হয় ওয়ার্নকে।
৫২ বছরের গোটা জীবনেই বিতর্ক সঙ্গী ছিল ওয়ার্নের। যদিও তাতে তার ক্রিকেট জীবনে কোনো ছাপ পড়েনি। ১৪৫ টেস্টে ৭০৮টি উইকেট নেন এই লেগ স্পিনার। আর ১৯৪টি একদিনের ম্যাচ খেলে তার সংগ্রহ ২৯৩ উইকেট। অবশ্য আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি না খেললেও আইপিএল ও বিগ ব্যাশে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল ওয়ার্নের।
আইপিএলে তো প্রথম শিরোপাজয়ী অধিনায়ক হিসেবেই নাম লেখান কিংবদন্তী এই স্পিনার। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের অধিনায়ক হিসাবে খেতাব অর্জন করেন শেন ওয়ার্ন।
আইপিএলের চার আসরে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ৫৫টি ম্যাচ খেলেছিলেন শেন ওয়ার্ন। ৫৭টি উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ১৯৮ রানও করেন তিনি। তবে আজ সবটাই অতীত।
শুক্রবার থাইল্যান্ডে নিজের বাংলোয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওয়ার্ন। অজি কিংবদন্তীর অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। আবেগঘন সব বার্তায় ওয়ার্নের অবদান ও কৃতিত্বের স্মৃতিচারণা করে তাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানায় রাজস্থান রয়্যালসসহ তাবৎ সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব।
এনএস//