কে অধিনায়ক, কে কোচ ‘পাপন দ্য বস’!
প্রকাশিত : ১৭:১২, ২৪ আগস্ট ২০২২ | আপডেট: ১৭:১৫, ২৪ আগস্ট ২০২২
সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন
তিনি চাইলে খেলতে না চাওয়া ক্রিকেটারকেও খেলতে বাধ্য করেন। তিনি চাইলে দেশের অধিনায়কও পাল্টে যেতে পারে। তিনি চাইলে এশিয়া কাপের মতো প্রতিযোগিতায় কোচ ছাড়াই যেতে পারে দল। বাংলাদেশ ক্রিকেটে কান পাতলে শোনা যায়, সবই তার ইচ্ছা। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। বোর্ড প্রেসিডেন্টের বিশ্বাস, সাকিব থাকলে দলে কোনও কোচের প্রয়োজন নেই।
পাপন বলেন, “একটা জিনিস মনে রাখা দরকার। সাকিব অধিনায়ক হলে কে কোচ হলো বা না হলো- সেটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। ও সেরা একাদশ বেছে নেবে। সকলের জানা উচিৎ, দলের প্রথম একাদশ সাকিবই বেছে নেয়। অবশ্যই ও কোচের পরামর্শ নেয়। কিন্তু কোচও সেই একাদশই মেনে নেয়, যেটা অধিনায়ক চায়। আমাদের দলে কোচ নেই, কিন্তু খালেদ মাহমুদ (টিম ডিরেক্টর) এবং জালাল ইউনুস (বোর্ডের ক্রিকেট অপারেশন চেয়ারম্যান) আছে। আমি আছি। আর কাকে প্রয়োজন?”
এখন সাকিবের ওপর অগাধ বিশ্বাস দেখাচ্ছেন নাজমুল হাসান পাপন। কিন্তু এ বছরের মার্চেই ছিল তার গলায় উল্টো সুর। সেই সময় দেশের হয়ে খেলতেই চাইছিলেন না সাকিব। অথচ আইপিএলের নিলামে নিজের নাম দিয়েছিলেন। আর তাতেই রেগে যান পাপন। সাকিবের দায়বদ্ধতা নিয়ে সেই সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
পাপন বলেছিলেন, “সাকিবের যদি শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকে, তাহলে আইপিএলে নাম নথিভুক্ত কেন করলো, তা নিয়ে ভাবা উচিৎ। যদি আইপিএলে সে দল পেত, তা হলে কী একই কথা বলত? সাকিব যদি বাংলাদেশের হয়ে খেলতে না চায়, তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই।”
বিসিবি বস এসময় আরও বলেন, “সাকিব তো বলে দিতে পারে না যে, এই ম্যাচ খেলব, ওই ম্যাচ খেলব না। আমরা যাদের ভালোবাসি, তাদের প্রতি সব সময়ই নমনীয় থাকি। কিন্তু তাদেরও পেশাদার হতে হবে। না হলে আমাদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেটা পছন্দ না-ও হতে পারে।”
এর পাঁচ মাসের মধ্যেই বদলে গেল সাকিবের প্রতি নাজমুল হাসানের দৃষ্টিভঙ্গি। এর মাঝেও অবশ্য সাকিব একাধিকবার অমুক সিরিজ খেলবেন না, তমুক সিরিজের বাছাই করা ম্যাচ খেলবেন বলে সুর তুলেছেন। জুয়া সংস্থার সঙ্গে চুক্তিও করেছেন। বোর্ডের চাপে সরেও গেছেন। তারপরেও সেই সাকিবের হাতেই তুলে দেয়া হয়েছে দলের নেতৃত্ব। ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ ক্রিকেটারের উপরই হঠাৎ কেন এতো আস্থা বোর্ড প্রধানের!
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান কর্তা নাজমুল হাসান পাপনের ইচ্ছাই যে শেষ কথা, ক্রিকেটাররাও সেটা জানেন। ২০১৬ সাল থেকে দল নির্বাচনে নাকি পাপনের ‘সম্মতি’ প্রয়োজন হয়। বোর্ড প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা না করে প্রথম একাদশ বাছাই করার জন্য সকলের সামনেই নাকি টিম ম্যানেজমেন্টের সমালোচনা করতে পারেন পাপন।
বড় প্রতিযোগিতার দু’সপ্তাহ আগে দলের কোচিং বিভাগে পরিবর্তনও নাকি করে দিতে পারেন তিনি। এমনকি পাপন চাইলে কোনও ক্রিকেটারকে বাধ্য করতে পারেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সিরিজে খেলতেও। তিনি না চাইলে কোনও ক্রিকেটার অবসরও নাকি নিতে পারেন না!
সিরিজ চলার মাঝেই দলের পারফরম্যান্স নিয়ে বিষোদগার করতে পারেন পাপন। দলের বৈঠকেও ঢুকে পড়তে পারেন তিনি। নিজের বাড়িতে ক্রিকেটার, কোচদের ডেকে আলোচনাও করতে পারেন। সে সব নিয়ে নিঃসঙ্কোচে মিডিয়ার সামনে কথাও বলতে পারেন। এটাই নাজমুল হাসান পাপন। তার নির্দেশেই নাকি চলে বাংলাদেশ ক্রিকেট।
২০১৩ সাল থেকে বোর্ডের মাথায় বসে আছেন পাপন। ২০২১ সালে তৃতীয়বারের জন্য বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সদস্য পাপন একজন পার্লামেন্ট সদস্যও।
সম্প্রতি এশিয়া কাপে তিনি আশ্বাস রেখেছেন সাকিবের ওপর। সেই চাপ কতটা কাজ করছে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কের ওপর?
সোমবার সাকিব বলেন, “আমাদের দল হোক, টি-টোয়েন্টি লিগের দল হোক বা অন্য কোনও ক্রিকেট বোর্ড হোক— চ্যালেঞ্জ সব জায়গাতেই আছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই চ্যালেঞ্জ কত বড় তা নির্ভর করে।”
গা বাঁচিয়ে কথা বললেন সাকিব? তা তো বলতেই হবে। বোর্ড (পাপন) যেভাবে দলের অধিনায়কদের সঙ্গে ব্যবহার করছেন, তাতে সেটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের অন্যতম সফল অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা। ২০১৭ সালে টি-টোয়েন্টি দল থেকেই তাকে ছেঁটে ফেলা হয়। ২০২০ সালে সরিয়ে দেয়া হয় একদিনের দল থেকেও। আইসিসি সাকিবকে এক বছরের জন্য নির্বাসিত করলে বাংলাদেশের নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয়েছিল মাহমুদুল্লাহর হাতে। গত মাসে তার নেতৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়।
একটি জুয়া সংস্থার সঙ্গে সাকিব যখন চুক্তি করেছিলেন, সেই সময় আবার অধিনায়ক হওয়ার দৌড়ে পাপনের পছন্দের তালিকায় ছিলেন মাহমুদুল্লাহ। সাকিব তখন ব্যাকফুটে। এখন আবার তিনিই অধিনায়ক।
মোমিনুল হক ছিলেন টেস্ট অধিনায়ক। কিন্তু সেই চাপ তিনি নিতে পারছিলেন না। মাঠে রান পাচ্ছিলেন না। মাঠের বাইরে সাংবাদিক বৈঠকে তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়ার আগের দিন নেতৃত্ব ছেড়ে দেন মোমিনুল।
এসব কিছুর মাঝেও অধিনায়ক হিসেবে স্বস্তিতে আছেন একমাত্র তামিম ইকবাল। এক দিনের ক্রিকেটে তার নেতৃত্বে ভালো খেলছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ সুপার লিগে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে টাইগাররা। লিগের ছ’টি সিরিজের মধ্যে পাঁচটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। নিয়মিত রানও পাচ্ছেন তামিম।
কিন্তু তিনিও জানেন, যে কোনও সময় বদলে যেতে পারে পরিস্থিতি। মাশরাফির থেকে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ভালো খেলছে তার দল। যদিও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১-২ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছে তামিমের দল। তবে সেটা সুপার লিগের অংশ নয় বলে সমালোচনা হয়নি।
যাইহোক, আগামী কয়েক মাসের পরিস্থিতি আলাদা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অন্তত ছ’টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। এই সময় খারাপ খেললে শুধু সমর্থকরা দুঃখ পাবেন তা-ই নয়, সাকিবের ওপরও চাপ বাড়বে।
এদিকে, এশিয়া কাপের দলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছেন পাপনও। বাংলাদেশ ক্রিকেটের খবর পাওয়ার দিক থেকে কোনও চিন্তা থাকার কথা নয়। কারণ, প্রতিটি ম্যাচ নিয়েই সাংবাদিক বৈঠক করতে ভালোবাসেন তিনি।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো খারাপ ফল হলে বাংলাদেশ শিবিরের পরিস্থিতি কেমন হবে, তা আন্দাজ করাই যায়। সেইসঙ্গে অধিনায়ক সাকিবের ওপরেও বাড়বে চাপ। আর ক্রিকেটারদের তো প্রশ্ন করার কোনও অধিকারই নেই।
অভিজ্ঞ সাকিব চাইবেন ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে। তিনি মাঠের বাইরে বোর্ড প্রধান, ডিরেক্টরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখারও চেষ্টা করবেন। সেইসঙ্গে মাঠের মধ্যে দলের লক্ষ্য ঠিক রাখার দায়িত্বও তার। এমন টালমাটাল পরিস্থিতির পরও ভালো ফল করতে চাইবেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
পারলে সাকিবের উপহার হবে বোর্ডের শান্ত পরিবেশ। কিছু দিনের জন্য নিশ্চিন্ত পরিস্থিতি। নইলে ‘পাপন রাজা’ কী পদক্ষেপ নেবেন- তা আন্দাজ করাও মুশকিল। সূত্র- ক্রিকইনফো ও আনন্দবাজার পত্রিকা।
এনএস//