ঢাকা, রবিবার   ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

‘ঈশ্বরের হাত’র অপেক্ষায় আর্জেন্টিনা!

নাজমুশ শাহাদাৎ

প্রকাশিত : ১৮:০৫, ২১ নভেম্বর ২০২২ | আপডেট: ২০:৩১, ২১ নভেম্বর ২০২২

ফাইনালিসিমা জয়ী টিম আর্জেন্টিনা

ফাইনালিসিমা জয়ী টিম আর্জেন্টিনা

অপেক্ষাটা ৩৬ বছরের! সেই কবে ডিয়েগো ম্যারাডোনার কাঁধে চেপে বিশ্বকাপ নিয়ে ঘরে ফিরেছিল আর্জেন্টিনা। এরপর কেবল আশা নিয়ে যাওয়া এবং হতাশার চাদর মুড়িয়ে ফিরে আসা। 

বিশ্বকাপ জেতার স্মৃতিতে ধুলা জমেছে অনেক বছর হতে চলল। উত্তরসূরিদের হাতে বিশ্বকাপ দেখার অপেক্ষায় থেকে পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’খ্যাত ডিয়েগো ম্যারাডোনাও। তবু মানুষ তো আশায় বাঁচে। আর্জেন্টাইনরাও আরেকবার আশায় বুক বেঁধেছেন।

সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ খেলতে কাতারে আসা লিওনেল মেসির কাঁধেই আরেকবার সওয়ার হয়েছেন তারা। লক্ষ্য একটাই, বিশ্বকাপ জেতা। আর মেসিদের বিশ্বকাপ জেতার দৃশ্যটা স্বচক্ষে দেখতে সর্বস্ব বাজি ধরতেও প্রস্তুত আর্জেন্টাইনরা। ঈশ্বরের হাতের অপেক্ষায় তারা।

‘ঈশ্বরের হাত’ কথাটা উঠতেই চলে আসে ম্যারাডোনার দেয়া সেই আলোচিত গোলটির কথা। বিশ্বব্যাপী ফুটবল অঙ্গণের সবচেয়ে বিতর্কিত গোল, যা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। যে গোলটিকে ম্যারাডোনা ‘ঈশ্বরের হাত’ হিসেবে অবিহিত করেন। 

সেবার ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে যায় আর্জেন্টিনা। সে ম্যাচে আর্জেন্টিনার পক্ষে দুটি গোলই করেন ম্যারাডোনা। যার প্রথম গোলটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় বিশ্বজুড়ে।

আর ওই ঈশ্বরের হাতের গোলেই ৮৬ সালের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। আর সেরা খেলোয়াড় হন কিংবদন্তী ম্যারাডোনা।

এরপর ৯০-এর বিশ্বকাপেও ফাইনাল খেলে আকাশি-সাদারা। তবে সেবার আর পারেনি চ্যাম্পিয়ন হতে। তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় ম্যারাডোনার দল।

এরপর মাঝে কেটে যায় দুই যুগ, পাঁচটি বিশ্বকাপ। অবশেষে ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে আর্জেন্টিনা। তবে এবারও ভাগ্যের কাছে যায় মেসি-ডি মারিয়ারা। ২০১৮ আসরে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও মেসি বাহিনী এরপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে কোপা আমেরিকা ও 'ফাইনালিসিমা' নামক দুই দুটি আন্তর্জাতিক ট্রফি জেতায় আবারও আশায় বুক বেঁধেছেন আর্জেন্টাইনরা।

মেসিদের বিশ্বকাপ জেতার দৃশ্যটা স্বচক্ষে দেখতে সর্বস্ব বাজি ধরতেও প্রস্তুত তারা। এই যেমন এমিলিয়ানো মাতারেনগোলোর কথাই ধরা যাক। বুয়েনস আয়ার্সের ৩৯ বছর বয়সী এই বাসিন্দা কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে নিজের জমানো সব অর্থ খরচ করেছেন। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক পাস করলেও মেসির হাতে বিশ্বকাপ শিরোপাটা কাছ থেকে দেখার প্রত্যাশায় ব্যবসার কোনো সূত্রই মানেননি এই আর্জেন্টাইন।

এবার কাতার বিশ্বকাপ দেখতে জমানো অর্থ কিংবা ধনসম্পদ দেদারসে খরচ করা আর্জেন্টাইনদের তালিকায় মাতারেনগোলোর মতো আছেন আরও অনেকেই। বিশ্বকাপ দেখতে কাতারে পাড়ি জমাতে কীভাবে টাকা জমিয়েছেন, তা জানাতে গিয়ে মাতারেনগোলো বলেন, ‘চার বছর ধরে জমিয়েছি। স্বপ্ন সত্যি করার জন্য প্রতি মাসে কিছু টাকা জমা রেখেছি। এ জন্য গাড়ি-বাড়ি কেনাও বন্ধ রেখেছিলাম।’

কেন এমন সিদ্ধান্ত- এমন প্রশ্নে মাতারেনগোলোর ব্যাখ্যা, ‘এটা স্বপ্ন, এটা এক ধরনের মোহ। অনেক মানুষ বলে, সে বাড়ির জন্য টাকা না রেখে কাতার যাওয়ার জন্য টাকা খরচ করছে। হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যে বাড়ি ভালো ব্যাপার। তবে আমি বিশ্বকাপ দেখতেই যাব।’

বিশ্বকাপের জন্য এবার অবশ্য দারুণভাবে প্রস্তুত হয়েছে আর্জেন্টিনা। টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার দারুণ রেকর্ডকে সঙ্গী করেই কাতার পা রাখেন মেসিরা। মরুর বুকে পৌঁছেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে ল্যাতিন আমেরিকার এই ফুটবল পরাশক্তি। আরব আমিরাতকে গোল বন্যায় ভাসিয়ে টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপে আরেকটি রেকর্ড গড়ার অপেক্ষায় মেসির দল।

এর আগে গত বছর (২০২১) কোপা আমেরিকা ও ফাইনালিসিমা জেতার সাফল্যও আর্জেন্টিনাকে বাড়তি অনুপ্রেরণা জোগাবে। শুধু আর্জেন্টিনা থেকেই নয়, মেসির হাতে শিরোপা দেখার প্রত্যাশায় ইংল্যান্ড-জাপান থেকেও কাতারে গিয়েছেন সমর্থকেরা।

বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মূল ভরসা হবেন মেসি। আর স্বর্গ থেকে তাদের আত্মবিশ্বাস ও সাহস দেবেন ম্যারাডোনা। এই তো কদিন আগে সারমিনেটো পার্কে ভক্তদের জড়ো হয়ে গাইতে দেখা গেছে, ‘মাঠে আমাদের মেসি এবং স্বর্গে খেলবেন ডিয়েগো (ম্যারাডোনা)।’

বিশ্বকাপ নিয়ে আর্জেন্টাইনদের উন্মাদনা ভুলিয়ে দিচ্ছে দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকটকেও। যে ধারাবাহিকতায় বেড়েছে দেশের বাইরে যাওয়ার খরচও। তবে কোনো কিছুই যেন রুখতে পারছে না আর্জেন্টাইনদের স্বপ্নকে।

জোনাথন লুনা নামে ৩২ বছর বয়সী এক আর্জেন্টাইন বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আর্জেন্টিনা এখন কিছু সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে প্রতি মাসে সবকিছুর দাম বেড়েই চলেছে। তবে এক রাতে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি বিশ্বকাপ দেখতে যাব। কারণ, আমি জাতীয় দলকে ভালোবাসি। আমি আর্জেন্টিনা দলকে সব জায়গাতেই ছায়াসঙ্গী হয়ে অনুসরণ করি। এটা আমার প্রথম বিশ্বকাপ এবং যখন আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, দু’চোখ তখন পানিতে ভরে গেল।’

তবে কাতারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত লুনার মতো হাজারো আর্জেন্টাইনকে যে অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সেই ব্যাখ্যাও দেন লুনা। তিনি বলেন, ‘আমি জানি যখন আমি ফিরে আসব, আমার জীবনের সেরা স্মৃতিগুলো সঙ্গে রয়ে যাবে। তবে এর বিনিময়ে হয়তো আমাকে সারাটা জীবন ভাড়া করে থাকতে হবে। তবে সেসব আমি পাত্তা দিচ্ছি না। দলকে সমর্থন দিতে আমাদের যেতেই হবে।’

মূলত ২০২১ সালে ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা শিরোপা ও ইতালিকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে ফাইনালিসিমা জয়ই এমন আবেগ আর বড় স্বপ্ন দেখাতে অনুপ্রাণিত করেছে আর্জেন্টাইনদের। যাতে অবশ্য চাপও বেড়েছে মেসিদের ওপর।

২০১৪-তে মারাকানায় যেটা হয়নি, ২০২২-এ কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামটা নিজের করতে পারবেন তো তিনি? সর্বশেষ অ্যাজটেকায় যেটা করেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ফুটবল ঈশ্বর যে অপেক্ষায় তার উত্তরসূরির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে!

এবারের বিশ্বকাপে সি গ্রুপে থাকা আর্জেন্টিনা তাদের প্রথম ম্যাচটি খেলবে সৌদি আরবের বিপক্ষে, ২২ নভেম্বর, বিকেল ৪টায়। মেসিরা গ্রুপের অপর দুটি দল মেক্সিকো ও পোলান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামবে যথাক্রমে ২৭ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর।

এনএস//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি