এক নজরে সাকিব আল হাসান
প্রকাশিত : ১৫:৫৯, ৩০ অক্টোবর ২০১৯
নাম তার ফয়সাল। পরিবারের সবার কাছে এখনো তিনি ফয়সাল হয়েই আছেন। অনেকেই হয়তো জানেন না বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ডাক নাম ফয়সাল।
এ মূহুর্তে বিশ্ব ক্রিকেট তথা বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনে আলোচিত ইস্যু সাকিবের দণ্ড। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট মানেই সাকিব আল হাসান। তাকে ছাড়া আন্তর্জাকিত ম্যাচে জয় লাভ অনেকটা অসম্ভবই হয়ে দাঁড়ায়। সেই সাকিব বিহীন ক্রিকেট দেখতে হবে দেশের ক্রিকেট প্রেমীদের। যদিও সময়টা অনেক দীর্ঘ নয়, তাই সবার প্রত্যাশা সাকিব তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে আবারও মাঠে ফিরে আসবেন।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সাকিবের অর্জন অনেক। যা অল্প কথায় লেখা সম্ভব নয়। তবে পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার ক্যারিয়ারের পেছনে কিছু গল্প তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।
১৯৮৭ সালের ২৩ মার্চ মাগুরায় জন্ম নেওয়া এ তারকা নিজের ক্যারিয়ারে অসংখ্য অর্জন নিয়ে বিশ্ব সেরা হয়েছেন কয়েকবার। সাকিবের বাবা মাশরুর রেজা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং মাতা শিরিন শারমিন একজন গৃহিণী। পারিবারিক বলয়ের কারণে ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল ছিলেন সাকিব। তবে সেই বলয়ের কারণে সাকিবের হওয়ার কথা ছিল ফুটবলার। সাকিবের বাবা খুলনা বিভাগের হয়ে এবং এক কাজিন বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতেন। কিন্তু সাকিবের গন্তব্য ছিল ভিন্ন দিকে। একজন ক্রিকেটার সারা বিশ্ব কাঁপানোর যে অদৃষ্টের লিখন ছিল, সাকিব সেদিকেই হাঁটছিলেন। সাকিবের বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ফুটবলার হোক। একটা সময় সাকিব নিজেও ফুটবলার হতে চাইতেন।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেলে সারা দেশে শুরু হওয়া ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত হলেন সাকিবও। তাই শেষ পর্যন্ত সাকিব ক্রিকেটকেই বেছে নিলেন।
২০০১ সালের দিকে ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন আলোকদিয়ার মাঠে সাকিব গিয়েছিলেন ভাড়ায় খেলতে। বিধ্বংসী ব্যাটিং আর পেস বোলিংয়ে নজর কাড়লেন সবার। শুরুর দিকে সাকিব আল হাসান পেসারই ছিলেন।
সাকিব ২০০১ সালে বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমে মাগুরা জেলা থেকে নড়াইল ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হন। নড়াইল ক্যাম্প থেকে ঢাকার বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য যে ২০ জন সুযোগ পেয়েছিল, সাকিব তাদেরই একজন। তখনই আসলে সাকিবের মূল ক্যারিয়ারের শুরু। বিকেএসপিতে ভর্তির পর বাংলাদেশের হয়ে বয়সভিত্তিক দলগুলোতে [অনূর্ধ-১৫-১৭-১৯] খেলার সুযোগ পান। আর সেখানেই মেধার স্বাক্ষর রাখেন সাকিব। পনেরো বছর বয়সে অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলা সাকিব আসলে তখনই জাতীয় দলে কড়া নাড়ছিলেন।
৬ আগস্ট ২০০৬, বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের পঞ্চম ওয়ানডে ম্যাচ। অভিষেক হলো এক তরুণ খেলোয়াড়ের, নাম সাকিব আল হাসান। বল হাতে ১০ ওভারে ৩৯ রানের বিনিময়ে এলটন চিগাম্বুরার উইকেট এবং ব্যাট হাতে ৪৯ বলে অপরাজিত ৩০ রানের একটি ইনিংস। এটি ছিল সিরিজের শেষ ম্যাচ যাতে জিম্বাবুয়ে ৩-২ ব্যবধানে জয়ী হয়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাকিব, ফরহাদ রেজা ও মেহরাব হোসেন জুনিয়র বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আয়োজিত ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন ১৫ জনের বাংলাদেশ স্কোয়াডে ডাক পান সাকিব। বাংলাদেশ সেবার টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্বে যেতে সক্ষম হয় এবং সপ্তম টিম হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষ করে। সেবার শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দেয়। টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচে তিনি ২৮.৮৫ গড়ে ২০২ রান করেন। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন মোহাম্মদ আশরাফুল (২১৬)। সাকিব ৪৩.১৪ গড়ে ৭টি উইকেটও নেন। সে বছরই মে মাসে দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডের এক সফরে ভারত বাংলাদেশে আসে। মে মাসের ১৮ তারিখ সাকিবের টেস্ট অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে। অভিষেকটা খুব একটা ভালো না হলেও ছন্দে ফিরতে সময় নেননি সাকিব। পরের গল্প কেবলই এগিয়ে চলার।
সাকিবের ক্যারিয়ারটা বেশ অদ্ভুত। শুরুর দিকে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে ঢোকেন সাকিব। এরপর দলে ঢোকার পর হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। মূলত একজন অলরাউন্ডার হিসেবে পারফর্ম করলেও ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড দলের বাংলাদেশ ট্যুরের আগ পর্যন্ত সাকিবকে বোলার নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেই গণ্য করা হতো। তখন টেস্টে সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামলেও ওয়ানডেতে কিন্তু প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যেই থাকতেন সাকিব। তখনকার কোচ জেমি সিডন্স হুট করে ঘোষণা দেন, সাকিবকে স্পেশালিস্ট বোলার হিসেবেই টেস্ট সিরিজ খেলানো হবে। কোচকে হতাশ করেননি সাকিব। উদ্বোধনী টেস্টের প্রথম ইনিংসেই তিনি ৩৭ রান দিয়ে তুলে নেন সাতটি উইকেট। তখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি বোলারের টেস্টে এটাই ছিল বেস্ট বোলিং ফিগার। বাংলাদেশ সিরিজ হারে ২-০ তে, কিন্তু সাকিব ১৭.৮০ গড়ে ১০টি উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটিতে বাংলাদেশ জয় পায়। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশ সিরিজ হারে ২-১ ব্যবধানে। সাকিব ৩ ম্যাচে ৫ উইকেট তুলে নেন।
পরের মাসেই বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায়। সাকিবের বোলিং পারফরম্যান্স এখানেও অব্যাহত থাকে। প্রথম টেস্টের প্রথম দিন সাকিব উইকেটশূন্য থাকলেও দ্বিতীয় দিনেই পাঁচ উইকেট তুলে নেন। দ্বিতীয় টেস্টে সাকিব আবারও এক ইনিংসে ৫ উইকেট তুলে নেন। সিরিজ শেষে সাকিবের ঝুলিতে জমা হয় ২০.৮১ গড়ে ১১টি উইকেট। ২০০৮ এর ডিসেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশে দুটি টেস্ট ও একটি ত্রিদেশীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট [অপর দলটি ছিল জিম্বাবুয়ে] খেলতে আসে। দুটো টেস্টই শ্রীলঙ্কা জিতে নেয়। সেই সঙ্গে ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালও। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিবের করা হার না মানা ৯২ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজের একমাত্র জয়ের স্বাদ এনে দেয়। সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন। ২২ জানুয়ারি, ২০০৯ সাকিব আইসিসির ওডিআই অল-রাউন্ডার র্যাংকিংয়ে ১ নম্বরে উঠে আসেন। ২০১১ সালে আইপিএলের নিলামে তাকে ৪ লাখ ২৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনে নেয়। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা কলকাতার হয়ে জিতেছেন ট্রফি। বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ মাতিয়েছেন বিশ্বের সেরা সব ক্রিকেটারের সঙ্গে। মোহাম্মদ আশরাফুলের পর মাশরাফিকে যখন অধিনায়ক করা হয়, তখন সাকিবকে ডেপুটি করা হয়। এরপর মাশরাফির ইনজুরিতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পান সাকিব। সেই সুযোগেই দলকে বিজয় এনে দেন।
এরপর স্থায়ীভাবে দলের দায়িত্ব নেন। আবার সেটি হারিয়েও ফেলেন। শৃঙ্খলাজনিত কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। এরপর আবার ফিরেও এলেন।
বিশ্বকাপ শুরুর আগেই দেখা গেল অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ে সবার উপরে আরেকবার ওঠে এলেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু এমন শীর্ষে ওঠা সাকিবের জন্য দুধ ভাত হয়ে গিয়েছিল।
সাকিবের এরপরের ইতিহাস বলতে গেলে দীর্ঘ সময় লাগবে।
তাই এবার টাইগার অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের কিছু রেকর্ড সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক -
- দ্রুততম সময়ে ওয়ানডেতে ৫০০০ রান ও ২৫০ উইকেটে ‘ডাবল’র কীর্তি।
- প্রথম অলরাউন্ডার হিসেবে র্যাংকিংয়ের শীর্ষে থেকে তিনটি বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ড।
- দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাট মিলে ১১ হাজার রানের মাইলফলক।
- ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা চার বিশ্বকাপ আসরে নিজেদের উদ্ধোধনী ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি করলেন বিশ্বের এই সেরা অলরাউন্ডার।
- মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ১৪২ রানের জুটি, যা বিশ্বকাপে যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি।
- বাংলাদেশের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ২০০তম ম্যাচ খেলার মাইলফলক স্পর্শ।
- তামিম ইকবালের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে ৬ হাজার রানের মাইলফলক।
- মাহমুদউল্লাহ’র পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সেঞ্চুরি।
- অলরাউন্ডার হিসেবে দ্রুততম সময়ে (২০২ ম্যাচে) ৬হাজার রান ও ২৫০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড।
- প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ১০০০ রান।
- একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে ১০০০ রান আর ৩০ উইকেটের কীর্তি।
- তৃতীয় অলরাউন্ডার হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। এর আগে ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব ও যুবরাজ সিং এই কীর্তি গড়েছিলেন।
- ভারতের যুবরাজ সিংয়ের (২০১১) পর বিশ্বকাপের এক ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেওয়া দ্বিতীয় ক্রিকেটার হওয়ার রেকর্ড।
- প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপ আসরে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি।
- প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের তিন জয়ের ম্যাচের সবকটিতেই ম্যাচ সেরা।
- বিশ্বকাপের এক আসরে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ৫০০ রান ও অন্তত ১০ উইকেট নেওয়ার বিশ্বরেকর্ড।
- চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে ৫ হাজার রান, ২৫০ উইকেট আর ৫০টি ক্যাচ নিয়ে অলরাউন্ডারদের অভিজাত তালিকায় যুক্ত হওয়া।
- শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, কুমার সাঙ্গাকারাদের মতো লিজেন্ডদের পাশে নাম লিখিয়ে বিশ্বকাপে সর্বেোচ্চ রান সংগ্রহের তালিকায় সেরা দশে প্রবেশ। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় সাকিব এখন নবম স্থানে। সাকিবের মোট রান ২৯ ম্যাচে ১১৪৬।
- প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে ৬০০ রান করার মাইলফলক। বিশ্বকাপের এক আসরে ৬০০ রান করার এই কীর্তি আছে শচীন টেন্ডুলকার (৬৭৩), ম্যাথু হেইডেন ৬৫৯), ডেভিড ওয়ার্নার (৬৪৭) ও রোহিত শর্মারও (৬৪৮)।
- প্রথম বাংলাদেশ হিসেবে এক আসরে ৫ ফিফটির পাশাপাশি ২ সেঞ্চুরির কীর্তি।
এসএ/