ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

যে নামে দাবা’র সূচনা হয় ভারতবর্ষে 

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ১৬:০৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ০৮:১৬, ৫ জানুয়ারি ২০২০

দাবা খেলার উৎপত্তি যে নামে উৎপত্তি

দাবা খেলার উৎপত্তি যে নামে উৎপত্তি

বর্তমানে একুশে টেলিভিশন’র নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি নিউএইজ, এনটিভি’র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭’তে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আসমত আলীর অনশন’ প্রকাশিত হয়। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

সবারই পরিচিত আর অনেকেরই প্রিয় একটা খেলা। নাম তার দাবা। এ খেলাতে জিততে শারীরিক পরিশ্রম না হলেও প্রয়োজন হয় প্রখর বুদ্ধি ও মনোযোগের। 

দাবা একটি জনপ্রিয় খেলা যা বোর্ডের উপর খেলা হয়। দাবা খেলার সর্বপ্রথম সূচনা হয় ভারতবর্ষে। যিনি দাবা খেলেন তিনি দাবাড়ু হিসেবে আখ্যায়িত। দাবায় দু’জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেন। দাবা খেলায় জিততে হলে বোর্ডের ওপর ঘুঁটি সরিয়ে বা চাল দিয়ে বিপক্ষের রাজাকে ফাঁদে ফেলে ‘খেতে’ বা নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়, দাবার পরিভাষায় একে বলে ‘কিস্তিমাত’।

দাবার ইতিহাস প্রায় ১৫০০ বছরের পুরনো। ষষ্ঠ শতাব্দীর আগেই ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে এ খেলাটির উৎপত্তি হয়। ভারত থেকে এ খেলাটি ছড়িয়ে পড়ে ইরানে। আরবরা ইরান দখল করলে খেলাটির সঙ্গে পরিচিত হয়। এরপর মুসলিমদের হাত ধরেই দাবা খেলা চলে আসে দক্ষিণ ইউরোপে। এরপর ইউরোপ থেকেই প্রাচীন দাবা মূলত আজকের দাবায় রূপ নেয়। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাবা খেলার নিয়ম-কানুনে যেমন এসেছে পরিবর্তন, তেমনি এসেছে এর নামেও। ভারতে খেলাটি যখন উৎপত্তি লাভ করে তখন এর নাম ছিল ‘চতুরঙ্গ’। ইরানে দাবা পরিচিতি পায় ‘শতরঞ্জ’ নামে। দাবা খেলোয়াড়দের তারা বলতে শুরু করে ‘শাহ’। 

আজ আমাদের কাছে যেটা ‘চেকমেট’ নামে পরিচিত সেটা তখন পরিচিতি লাভ করে ‘শাহ মাত’ নামে। অনেক স্থানে যোদ্ধাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দাবা খেলার প্রচলন ছিল। মূলত ১২০০ থেকে ১৪৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময়েই দাবার নিয়ম-কানুনে মূল পরিবর্তন আসে। 

ভারতের সঙ্গে প্রাচীনকালে পারস্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল বেশ ভালো। পারস্যের বণিকরা ভারতে এই মজার খেলা খেলতে দেখেছিল। তাদের কাছেও খেলাটা ভালো লেগে যায়।

এসব বণিকদের হাত ধরে চতুরঙ্গ একসময় পারস্যে চলে যায়। সেখানে এর নতুন নাম হয় ‘শতরঞ্জ’। সেটা খ্রিস্টীয় ৬০০ সালের দিকের ঘটনা। এখানে দাবা খেলার নিয়ম কানুন আরও উন্নত হয়। প্রায় একই সময় ভারত থেকে খেলাটা চীন দেশে যাত্রা করে। 

চীনারা এর নামকরণ করে জিয়ানকি (xiangqi)। তবে চীনাদের দাবি জিয়ানকি তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত খেলা। শুধু তাই নয়। তাদের দাবি, দাবা খেলা আসলে ভারতে নয়, চীনে উদ্ভাবিত হয়েছে।

প্রাচীন পারস্য বা আজকের ইরান এক সময় মুসলমানদের দখলে চলে আসে। ধীরে ধীরে দাবা মুসলমানদের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় স্পেনে ছিল মুসলমানদের শাসন। তাই পারস্য থেকে শতরঞ্জ এক সময় স্পেনে তার শক্ত আসন গড়ে নেয়। পারস্যের শতরঞ্জ স্পেনে এসে Ajedrez নাম ধারণ করে।
শুধু তাই নয় পারস্য থেকে শতরঞ্জ আরও নানাভাবে ইউরোপে প্রবেশ করে। খ্রিস্টীয় দশম থেকে ১২ শতকে পারস্যে সালাউদ্দিনের শাসনামলে ইউরোপের ক্রুসেডাররা জেরুজালেম রক্ষার জন্য দলে দলে ভিড় জমায় পারস্যে। দীর্ঘদিন পারস্যে থাকতে থাকতে তারা পারস্যের অনেক কিছুই আমদানি করতে থাকে ইউরোপে।

এভাবে শতরঞ্জও এই সময় ইউরোপে ও রাশিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখানেও সে নতুন নাম পায় ‘চেজ’। যা পুরাতন ফরাসি ভাষা ‘echec’ (অর্থ চেক) থেকে উদ্ভুত। শুধু নামেই নয়, খেলাটার আরও অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়। ইউরোপেই দাবায় প্রথম বিশপ (হাতি) যুক্ত হয়। আরও পরে যোগ হয় রানি। 

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে টাকার জন্য দাবা খেলার পরিমাণ এত বেড়ে যায় যে ১২৫৪ সালে নবম লুইস এর বিরুদ্ধে একটা অধ্যাদেশ জারি করেন। আধুনিক দাবার প্রথম টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় ১৮৫১ সালে। লন্ডনে অনুষ্ঠিত এ টুর্নামেন্টটি আয়োজন করেন ব্রিটিশ দাবাড়ু হাওয়ার্ড স্ট্যাউনটন। জিতে নেন জার্মানির অ্যাডলফ অ্যান্ডারসেন। বিংশ শতাব্দীতে গঠিত হয় ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশন বা সংক্ষেপে এফআইডিই। একবিংশ শতাব্দীতে দাবায় কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭০ সালে প্রথম কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা একটি গেইম বাজারে ছাড়া হয়। এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার পর অনলাইনে দাবা খেলা শুরু হয় ১৯০০ সালের মধ্যভাগে।

বাংলাদেশে দাবার ইতিহাসে পথিকৃৎ হিসেবে যিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি জ্ঞানতাপস ড. কাজী মোতাহার হোসেন। জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের জ্ঞানচর্চার বাইরেও বাংলাদেশ জুড়ে স্পোর্টসম্যান হিসেবে খ্যাতি ছিল। 

১৬টি করে ঘুঁটি দ্বারা ৬৪ বর্গক্ষেত্রের একটি বোর্ডে দুইজন খেলোয়াড়ের খেলা। এ ১৬টি ঘুঁটির ১টি রাজা, ১টি মন্ত্রী, ২টি ঘোড়া, ২টি হাতি, ২টি নৌকা ও ৮টি বোড়ে (সৈন্য) থাকে। এ খেলা সম্ভবত ভারতেই প্রথম প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে খেলাটি পারস্যে যায় এবং মুসলমানদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রচলিত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে এ খেলা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় পাশা খেলার সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন নিয়মে খেলাটি প্রচলিত ছিল। ইউরোপে গত একশ বছরে দাবার বিভিন্ন আইনকানুনের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে এ খেলাকে সর্বসাধারণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তোলা হয়। এ বিবর্তনের পথ ধরে দাবাকে ঘিরে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা যার প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থার সদস্য এবং তারা খেলার আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন মেনে চলে।

দাবা মূলত রাজার খেলা বা রাজায় রাজায় যুদ্ধের খেলা। এ খেলা হয়ে থাকে দুই দলের রাজার মধ্যে। এক রাজাকে কিস্তি দেওয়া বা আক্রমণ করাই অন্য রাজার উদ্দেশ্য। অনেক স্থানে এ খেলাকে কিস্তিমাত খেলাও বলা হয়। যে কোনও উপায়ে রাজাকে বন্দি করাই হলো দাবা খেলার মূল লক্ষ্য। খেলতে খেলতে যে দলের রাজা কিস্তির ফাঁদে আটকা পড়ে বা বন্দি হয়ে যায় সেই রাজার দল পরাজিত হয়।

এই জনপ্রিয়তার কারণেই ১৯২৪ সালে ফান্সের প্যারিস শহরে ‘দ্য ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডেস চেস’ (এফআইডিই) গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি দাবা খেলার আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এই সংস্থা আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজক। দক্ষতার উপর নির্ভর করে এফআইডিই খেলোয়াড়দের ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার এবং গ্রান্ডমাস্টার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যেসব খেলোয়াড় প্রতিযোগিতায় সবার সেরা হয় তারাই গ্রান্ডমাস্টার। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫৯টি দেশ এফআইডিই-র সদস্য।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি