সংগ্রামের জয়, অন্য এক বাংলাদেশ
প্রকাশিত : ২৩:৫৪, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০
অনূর্ধ্ব-১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপাজয়ী টিম বাংলাদেশ
অথর্ব আঙ্কোলেকরের বলটা মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে ব্যাট উঁচিয়ে ছুটতে শুরু করে দিলেন রাকিবুল হাসান। ডাগ আউট থেকে মাহমুদুল হাসান জয়, তৌহিদ হৃদয়রা ততক্ষণে মাঠের ভিতরে ঢুকে পড়েছেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল অবশেষে। ভারতের মতো প্রবল প্রতিপক্ষকে হারিয়ে প্রথম বার যুব বিশ্বকাপ জিতল বাংলাদেশ।
ওদিকে পোচেফস্ট্রুমের গ্যালারিতে বসে থাকা বাংলাদেশ সমর্থকদের উচ্ছ্বাস তখন বাঁধনহারা। ভিকট্রি ল্যাপ দেয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত তারা। সাকিব আল হাসান, মেহেদি হাসান মিরাজরা যা করে দেখাতে পারেননি, আকবর আলিররা সেটাই করে দেখালেন নেলসন ম্যান্ডেলার মাটিতে। ২৩ বল বাকি থাকতে তিন উইকেটে ভারতকে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। আইসিসি পেল নতুন চ্যাম্পিয়ন।
ভারতের রান তাড়া করতে নেমে এক সময়ে পায়ের পেশিতে টান ধরেছিল ওপেনার ইমনের। অসহ্য যন্ত্রণায় মাঠ থেকে উঠে গিয়েছিলেন তিনি। দল যখন একের পর এক উইকেট হারিয়ে বিপন্ন, তখন ব্যথা ভুলে ব্যাট হাতে নেমে পড়েছিলেন বাঁহাতি ইমন। দারুণ সামলালেন ভারতীয় বোলারদের। তার মরিয়া লড়াই দীর্ঘদিন মনে রাখবেন ক্রিকেটভক্তরা।
ম্যাচের শেষে সেই ইমন বলছিলেন, ‘দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। আমরা এখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে পায়ের ব্যথাও হয়তো তখনকার মতো ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে, বাংলাদেশে যখন হর্ষ-আনন্দ। ভারতের সাজঘরে তখন বিষাদের ছায়া। ভারত অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গ কোনওমতে নিজেকে সামলে বলছিলেন, ‘দিনটা আমাদের ছিল না। তবে ছেলেরা লড়ে গিয়েছে।’ রবি বিষ্ণোই, যশস্বী জয়সওয়ালদের লড়াই কাজে এলোনা রোববার।
বল করতে নেমে বিষ ঢেলেছিলেন বিষ্ণোই। একাই চার-চারটি উইকেট তুলে স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন তিনি। বিষ্ণোইয়ের আগে যশস্বীও ব্যাট হাতে শাসন করেছেন বাংলাদেশের বোলারদের। কিন্তু ফাইনালে ১৭৭ রানের পুঁজি নিয়ে লড়া যায় না। তার উপরে বল করার সময়ে একগাদা ওয়াইড-নো বল করে ফেললেন ভারতের বোলাররা। ভারত ২১০-২২০ রান করলে এই ম্যাচের চেহারাই যে বদলে যেত না, তা কে বলতে পারেন।
হারের পরে প্রিয়ম বললেন, টস না জেতা পার্থক্য গড়ে দিল। এই উইকেটে সাবলীলভাবে ব্যাট করা সম্ভব হচ্ছিল না ভারতের ব্যাটসম্যানদের পক্ষে। রানের গতি হয়ে গিয়েছিল মন্থর। যশস্বী একদিক কামড়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে থেকে একের পর উইকেট পড়ল। যশস্বী যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, ততক্ষণ বড় রানের আশা ছিল। তিনি ফিরতেই সব শেষ। পুরো ৫০ ওভারও ব্যাট করতে পারল না ভারত। ১৭৭ রানে শেষ হয়ে গেল যশস্বীদের ইনিংস। শেষ সাত উইকেট পড়ল মাত্র ২১ রানে।
রান তাড়া করতে নেমে শুরুটা বেশ ভালই করেছিলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার ইমন ও তানজিদ। খুব সহজেই কার্তিক-আকাশদের সামলাচ্ছিলেন তারা। স্কোর বোর্ডে ৫০ রান তোলার পরে প্রথম উইকেট যায় বাংলাদেশের। রবি বিষ্ণোইকে মারতে গিয়েই ফেরেন তানজিদ (১৭)।
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে মাহমুদুল হাসান জয় সেঞ্চুরি করে ফাইনালে তুলেছিলেন দলকে। কিন্তু এ দিন ব্যর্থ জয়। রবি বিষ্ণোইয়ের গুগলিতে বোল্ড হয়ে গেলেন জয় (৮)। তৌহিদ হৃদয়কেও এলবিডব্লিউ করেন বিষ্ণোই। শাহদাত হোসেনও বুঝতে পারলেন না বিষ্ণোইয়ের স্পিন। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ উইকেটের (১৭টি) মালিক এই ভারতীয়।
পরে সুশান্ত মিশ্রর বলে যশস্বীর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরতে হয় শামিম হোসেনকে (৭)। সেই সুশান্তর বল চালাতে গিয়ে অভিষেক দাস ক্যাচ দিলেন কার্তিক ত্যাগীর হাতে। হঠাৎই ম্যাচে ফিরে আসে ভারত। একমাত্র উইকেট ফেলতে পারলেই ম্যাচ বের করা যাবে। এছাড়া আর অন্য কোনও উপায় খোলা ছিল না ভারতের হাতে।
মরিয়া প্রিয়ম অবশ্য হাতের সব ক’টা তাস ফেলে দিয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা বিষ্ণোইয়ের দশ ওভার আগেই শেষ করে দেন তিনি। মারাত্মক চাপে থাকা বাংলাদেশকে বাঁচানোর জন্য তখন নেমে পড়েন চোট পাওয়া ইমন। পাশে পান বরফ শীতল মস্তিষ্কের অধিকারী অধিনায়ক আকবর আলিকে। চাপটা সামাল দেন তারা। ইমন ও আকবর বাকি ভারতীয় বোলারদের সামলে দেন ঠান্ডা মাথায়। ইমন ফেরেন ৪৭ রান করে।
১৪৩ রানে সপ্তম উইকেট হিসেবে ইমন যখন আউট হন, রকিবুলকে নিয়ে বাকি পথটুকু পাড়ি দেন আকবর। টুর্নামেন্টে এর আগে খুব একটা ব্যাটিংয়ের প্রয়োজন হয়নি অধিনায়কের। যখন প্রয়োজন হলো লড়াই করলেন বুক চিতিয়ে। হারের মুখ থেকে দলকে নিয়ে গেলেন বিজয়ের মঞ্চে।
এরপর, জেতার জন্য বাংলাদেশের যখন দরকার ৫৪ বলে ১৫, তখনই বৃষ্টি নামে পোচেস্ট্রুমে। বৃষ্টির পরে খেলা শুরু হলে বাংলাদেশের জেতার সমীকরণ দাঁড়ায় ৩০ বলে ৭ রান। যা মাত্র ৭ বল খেলেই টপকে যায় রাকিবুল-আকবর আলিরা। ফলে ২৩ বল বাকি থাকতে ফাইনাল জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল বাংলাদেশ।
ভারতীয় দল এর আগে চার বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে যুব বিশ্বকাপে। এদিন সুযোগ ছিল পঞ্চমবারের জন্য চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। এই রেকর্ড কোনও দলের ছিল না। সেটা করতে পারলেন না প্রিয়মরা। তাদের মাঠ ছাড়তে হল মাথা নীচু করেই।
জয়ের কাছে গিয়ে হারের স্মৃতি কম নেই বাংলাদেশের। সিনিয়র ক্রিকেটে একের পর এক ফাইনালে হার দেখেছে বাংলাদেশ। যুব ক্রিকেটেও হয়েছে তীরে এসে তরী ডোবার অভিজ্ঞতা। সবশেষ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেই বাংলাদেশ জয়ের দুয়ারে গিয়ে হেরেছিল ভারতের কাছে।
এবার কোনও ভুল করেনি বাংলাদেশ। ঠাণ্ডা মাথায় দলকে বন্দরে নিয়ে গেছেন আকবর আলী। পেয়েছেন পারভেজ হোসেন ও রকিবুল হাসানের দারুণ সহায়তা। বাংলাদেশের সংগ্রামের কাছেই পরাজিত হলো ভারত। এ যেন অন্য এক বাংলাদেশ।
এনএস/