ঢাকা, সোমবার   ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

রেনেসাঁ’র দেশে (তৃতীয় পর্ব)

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ০১:১৮, ২৪ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ০১:২৮, ২৪ জুলাই ২০২০

ফ্লোরেন্স শহরটি ছবির মতো সুন্দর। ইতালির একটি নান্দনিক শহর যা শিল্প স্থাপত্য ব্যাংকিং ও ইতিহাসের শহর হিসেবেই পরিচিত। শিল্প ও সাহিত্যের নামকরা ব্যাক্তিত্ব দাঁন্তে, লিওনার্দো, পেত্রাক মিকেলেঞ্জেলো, বোকাচ্চিও, এদের মতো বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গের জন্মের শহর। ১৪০০ শতাব্দীতে পুরো ইউরোপে শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে বিপ্লব এনে দিয়েছিল এই ফ্লোরেন্স শহর। মেডিসিদের মতো ধনী বণিকদের সহায়তায় ফ্লোরেন্স হয়ে উঠে শিল্প সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ আধার। এ জন্য ফ্লোরেন্সকে বলা হয় ‘রেনেসাঁ’র আতুড়ঘর’। ১৯৮২ তে ইউনেস্কো ফ্লোরেন্স শহরকে ঐতিহাসিক হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফোবর্সে ও বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহর হিসেবে এই শহর নিজের জায়গা করে নিয়েছে।


স্বামী আরফান আলীর সঙ্গে লেখক শামীম আরা খানম, মে ২০১২

ঘুম থেকে উঠেই দেখি বিকেল ৫.০০ টা বেজে গেছে আর ঠিক এটাই ছিল ফ্লোরেন্স এর বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল ‘সান্তা মারিয়া ডেল ফিয়েরে’(ছোট করে এটাকে ডুওমো বলা হয়) দেখতে দর্শনার্থীদের জন্য দেয়া শেষ সময়। এটা ফ্লোরেন্স এর আইকনিক ল্যান্ডমার্ক যেটা তৈরি করতে প্রায় ১৫০ বছর লেগেছিল। একসময় এই ডুওমো’র গম্বুজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গম্বুজ ছিল। একজন স্বর্ণকার এর নকশায় এটি তৈরি করা হয়েছিল কোন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করেই। 


ফ্লোরেন্স এর আইকনিক ভিউ, পিয়াৎজ্জালে মিকেল এঞ্জেলো

মিকেল এঞ্জেলো স্কয়ারে গাড়ি রেখে ব্রীজ পার হয়ে হুড়োহুড়ি করে সবাই ওপারে গেলাম ডুওমো দেখতে। কিন্তু হায় বিধিবাম! সব বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে থেকে ঘুরে দেখতে পেয়েছিলাম। প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম তখনও সময়মতো পৌঁছাতে পারিনি বলে দেখতে পারিনি এবারও হলো না। ইনশাআল্লাহ! আশাবাদী যে, পরের বার হবে। দান দান তিন দান!

এবার চেষ্টা করলাম ‘গ্যালারিয়া দেল একাদেমিয়া’ দেখার যেখানে মিকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘ডেভিড’ এর মর্মর মূর্তিটি রক্ষিত আছে যা পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে ধরা হয়। মাত্র ২৬ বছর বয়সে মিকেল এঞ্জেলো এই ভাস্কর্যটি তৈরি করেন। এখানেও হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। অবশেষে এই ভাস্কর্যের রেপ্লিকা দেখে মনকে প্রবোধ দিলাম এই ভেবে যে পরের বার এসে আগে এখানে যাব!


গ্যালারিয়া আকাদেমিয়ার সামনে স্বামী আরফান আলীর সঙ্গে লেখক, মে ২০১২

‘পিয়াজ্জা দেলা সিনোরিয়া’য় দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। এটা ফ্লোরেন্স এর বিখ্যাত একটি ল্যান্ডমার্ক। এটি একটি রাজনৈতিক চত্ত্বর। ফ্লোরেন্স এর সব বিখ্যাত স্থাপনাগুলোই এর চারদিকে অবস্থিত।


পালাতজ্জো ভেক্কিওতে পরিবারের সঙ্গে লেখক (২০১৫ সালে তোলা ছবি)

এরপর গেলাম ‘পালাতজ্জো ভেক্কিও’দেখতে। কিছু দূর হেঁটে যেতে হয়। এটা প্রাচীন মেডিসি পরিবারে বাসস্থান ছিল যারা এই শহরের মূল নিয়ন্তা ছিলেন। বর্তমানে এটি মিউজিয়াম ও টাউন হল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রথমবার গিয়ে এখানে বসে কফি পান করেছিলাম। পরেরবার শুধুই চোখের দেখা! 


মিউজিয়ামের সামনে লেখকের স্বামী আরফান আলী

পুরো রাস্তা বেশ উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো। এখানে হাঁটার একটা ছন্দ আছে। এখান থেকে হেঁটে এলাম সিটি প্যালেস দেখতে যা মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। এই বিল্ডিংটি তৎকালীন মেডিসিরা কিনে নিয়েছিল ব্যাংকার পিটিদের কাছ থেকে। দুই বিল্ডিংয়ে যাতায়াতের জন্য একটি করিডোর আছে যেটাকে স্থপতি ভাসার এর নামে ‘ভাসারি করিডোর’ বলা হয়।

‘উফিজি গ্যালারি’ যেটা প্রাচীন মেডিসিদের সরকারি অফিস ছিল বর্তমানে মেডিসিদের বিভিন্ন সংগ্রহে পরিপূর্ণ একটি জাদুঘর হিসেবে পরিণত হয়েছে। এটি প্রথমবারে দেখেছিলাম ঘুরে ঘুরে। পরেরবারও গিয়েছিলাম কিন্তু বন্ধ পেয়েছি। 


পন্টে ভেক্কিওতে স্বামী আরফান আলীর সঙ্গে লেখক , মে ২০১২

এবার এলাম ‘পন্টে ভেক্কিও’ দেখতে। ফ্লোরেন্স শহরের চারপাশেই আর্নো নদী। এই নদীর উপর নির্মিত সুন্দর একটি ব্রীজ যেটা সাতশো বছরের পুরোনো এটাই বিখ্যাত ‘পন্টে ভেক্কিও’। ডুওমোর মতো এটাও ফ্লোরেন্সের ল্যান্ডমার্ক। বিশাল চওড়া এই ব্রীজের উপর আগে ছিলো কসাইদের দোকান যেটা পরবর্তীতে স্বর্ণের বদলে দোকান গড়ে ওঠে। এই ব্রীজের উপর অনেক বাড়িঘর ও দোকানপাট আছে যেটা ইতিহাসে বিরল।


আর্নো নদীতে সূর্যাস্ত

মিকেল এঞ্জেলো স্কয়ার থেকে ওপারে ডুওমো স্কয়ারে পারাপারের জন্য আর্নো নদীর উপর অনেকগুলো ছোট ছোট সেতু আছে। একটি সেতুর উপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে হঠাৎই একটা মজার জিনিস চোখে পড়লো। পাশের একটি সেতুর উপর লোহার রেলিং ঘেরা ফুটপাতে অনেক হকার আর বাদ্যযন্ত্রীরা পসরা সাজিয়ে বসে আছে।


সেই সেতু যেখানে তালা লাগিয়ে চাবি নদীতে ফেলে দেয়

সেখানে একটা অংশে অনেকগুলো বন্ধ তালা ঝুলছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য ভালোবাসার কপোত-কপোতি এইখানে তালা লাগিয়ে চাবিটা আর্নো নদীতে ফেলে রেখে যায় যাতে তাদের প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সারাজীবন একত্রে থাকতে পারে! আমরাও দোয়া করি যেন ওদের এই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। 



তালা লাগিয়ে চাবি নদীতে ফেলে দেয়া সেতুর সামনে লেখক 

চলবে...

লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

এমবি//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি