যেখানে মেলে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি চিহ্ন
প্রকাশিত : ১৩:২২, ২ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৭:৫৮, ৩ মার্চ ২০২২
এদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে আছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙ্গালীর সংস্কৃতিজুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের পায়ের চিহ্ন। বাংলাদেশ ও ভারতের সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং উভয় দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলা হয়, কবিত্ব আসে প্রকৃতি থেকে। আর সেই প্রকৃতির টানে রবীন্দ্রনাথ ছুটেছেন পথে-প্রান্তরে, রণে-বনে-জঙ্গলে। যেখানেই গিয়েছেন কল্পনার রাজ্যে সৃষ্টি করেছেন এক অপার মহিমার রাজ্য। কালের বিবর্তনে সেই কল্পনার রাজ্যগুলো আজ স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেক জায়গার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে কবির স্মৃতিচিহ্ন। তাই এই বসন্তের কোলাহলে হৃদয় দোলাতে আপনজনদের নিয়ে ঘুরে আসুন রবীন্দ্র-স্মৃতিবিজড়িত এসব জায়গাগুলোতে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুঠিবাড়ি, শাহজাদপুর কাচারিবাড়ী, সিরাজগঞ্জের পতিসর, নওগার কুঠিবাড়ি ও খুলনার কুঠিবাড়ি শ্বশুরবাড়ী খুলনা।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি:
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ঐতিহাসিক কুঠিবাড়িটি কুষ্টিয়া শহড় থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে অবস্থিত।
১৮০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ রামলোচন ঠাকুরের উইল সূত্রে এ জমিদারির মালিকানা পান। এর অবস্থান ৯.৯৩ একর জমির উপর ।
অনুষ্ঠান কখন হয়- প্রতিবছর এখানে মেলা বসে ২৫ বৈশাখ ও ২২ শ্রাবণ ।
এ ছাড়া কুঠিবাড়ির বিভিন্ন কক্ষে কবির চেয়ার, টেবিল, খাট, আলমারি, সোফা ও পালকি, কবির আঁকা বেশকিছু দুর্লভ চিত্রকর্ম, পরিবারসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে তোলা আলোকচিত্র, মহাত্মা গান্ধীকে স্বহস্তে লেখা একটি চিঠিসহ আরো অনেক কিছু সাজানো রয়েছে। আরো রয়েছে কবির প্রিয় বকুল গাছ ও সানবাঁধানো কুয়া আর বাথটাব। তবে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে আরেক মাহাত্ম্য।
কবি ১৯১৩ সালে যে সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার পান সেই গীতাঞ্জলী’র অধিকাংশ কবিতাই রচনা করেছিলেন শিলাইদহে । এখানে থাকা অবস্থায় রচনা করেন কল্পনা, ক্ষণিকা, চৈতালী, সোনারতরী, চিত্রা, জীবন স্মৃতি, পঞ্চভূতের ডায়েরি, চিরকুমারসভা, ঘরে বাইরে, চোখের বালি, বলাকাছাড়াও অনেক প্রবন্ধ, উপন্যাস, গান ইত্যাদি রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে সর্বপ্রথম শিলাইদহে আসেন। জমিদারি পরিচালনা করেন ১৮৯১-১৯০১ সাল পর্যন্ত। পদ্মার ভাঙ্গনে কুঠিবাড়িটি ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলে নির্মান করা হয় নতুন কুঠিবাড়ি। বর্তমানে শিলাইদহ কুঠিবাড়িটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। আর কুঠিবাড়িতে প্রবেশে টিকিটের মূল্য ধরা হয়েছে জনপ্রতি ১৫ টাকা। বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্য টিকিটের মূল্য ১০০ টাকা আর সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীদের জন্য টিকিটের মূল্য পঞ্চাশ টাকা।
বন্ধ-খোলার সময়সূচী:
গ্রীষ্মকালে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। শীতকালে সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীত এবং গ্রীষ্মকালে দুপুর একটা থেকে ১ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বন্ধ থাকে। সারাবছরই শ্রক্রবারে জুম্মার নামাযেন জন্য সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার। তবে সোমবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে এটি।
শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি:
রবীন্দ্র কাচারী বড়িটি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার শাহজাদপুর বাজারের পাশেই অবস্থিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯০ সালে প্রথম শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে আসেন এবং ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত অনেকবার তিনি এখানে এসে থেকেছেন। এখানে থাকা অবস্থায় তিনি অনেক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন । বর্তমানে ভবনটি জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। শাহজাদপুর কাছারি বাড়িটি একটি দ্বিতল ভবন। এটি নির্মিত হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে। বাড়িটির ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার আর উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। ভবনটির প্রতি তলায় ৭টি করে কক্ষ রয়েছে এবং একটি করে সিড়ি ঘড় রয়েছে।
ভবনটিতে উত্তর ও দক্ষিণের বারান্দা দুটি একই প্রশস্তের। বারান্দার থাম গুলি গোলাকৃতির জোড়ামাপের এবং থামের উপরাংশে অলংকরণ। বড় আকারের দরজা, জানালা এবং ছাদের উপরে দেয়ালে আকর্ষনীয় পোড়ামাটির কাজ রয়েছে। জাদুঘরটির নিচতলায় পাশাপাশি তিনটি কক্ষের দেয়ালে লাগানো হয়েছে কবির আঁকা মূল্যবান ছবি ও আলোক চিত্র। তার মধ্যে নারী প্রতিকৃতি এবং কয়েকটি নৈসর্গিক চিত্র অন্যতম। দুটি কক্ষকে আকর্ষনীয় করেছে কবির তিনটি পান্ডুলিপি আর চারটি আলোকচিত্র। কবির জন্মদিনে মহাত্না গান্ধীর সঙ্গে বিশেষ মুহূর্তের ছবি, ইতালিতে এবং বিলেতের ছবিগুলো এখনো প্রানবন্ত রয়েছে।
১৯৬৯ সালে জড়াজীর্ণ অবস্থায় ভবনটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর । পুনঃনির্মাণ করা হয় একতলা ছাদ এবং দুতলা ছাদসহ আরো অনেক কিছু। এ বাড়িতে প্রাপ্ত আবসাবপত্র এবং রবীন্দ্র জীবনভিত্তিক আলোকচিত্র নিয়ে ভবনটিকে পরিণত করা হয় জাদুঘরে। এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার্য আসবাবপত্র, কবিগুরুর পিয়ানো,খাট,পাল্কি,চেয়ার,টেবিল পালংসহ আরও আনেক কিছু। অডিটরিয়াম তৈরি করা হয়েছে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি প্রঙ্গণে। সেখানেই রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দপ্তর। জমিদারি দেখাশোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত এই কাছারি বাড়িতে আসতেন এবং সাময়িতভাবে এই বাড়িতে থাকতেন। জমিদারি দেখাশুনা ছাড়াও অনেকবার তিনি এই বাড়িতে এসেছিলেন। এখানে থাকা অবস্থায় গান, কবিতা, ছোট গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে কাছারি বাড়িটিও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়।
টিকেট প্রাপ্তিস্থান:
জাদুঘরের গেটের পাশেই টিকেট কাউন্টার রয়েছে । টিকেট এর দাম জনপ্রতি বিশ টাকা। কিন্তু ৫ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের জন্য টিকেট প্রয়োজন হয় না। বিদেশীদের জন্য টিকিটের মূল্য ২০০ টাকা কিন্তু সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীদের জন্য টিকিটের মূল্য ১শত টাকা।
বন্ধ-খোলার সময়সূচীঃ
শীতকালে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। আর গ্রীষ্মখালে সকাল ১০টা খেকে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। শীত এবং গ্রীষ্ম সব সময়ই দুপুর ১টা থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত জাদুঘরটি বন্ধ থাকে। শীত ও গ্রীষ্ম সব সময়ই শুক্রবার জুম্বার নামাজের জন্য বারোটা থেকে ৩টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর সারবছরই রোববার সাধারন ছুটি। সরকারি যে কোন বিশেষ দিবসেও জাদুঘরটি খোলা থাকে।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা শহড়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে সিরাজগঞ্জ যাওয়ার জন্য বাস পাওয়া যায়। আর সিরাজগঞ্জ শহড়ে থেকে রবীন্দ্র কাচারী বাড়ির রিক্সা ভাড়া প্রায় ২০ টাকা। অনেকে হেঁটেই চলে যান কাছারী বাড়িতে। কাছারি বাড়িতে ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করাসহ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহন করা হয়।
পতিসর কুঠিবাড়ি:
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নাগর নদীর তীরে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথের পতিসর কুঠিবাড়ি। বাড়ীটির অন্যতম আকর্ষণ ‘সিংহ দরজা’। দরজাটি বৃহদাকার আর দরজার উপরে রয়েছে একজোড়া সিংহের মূর্তি। দুরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই ফাঁকা জায়গায় মেঝের উপরে রবীন্দ্রনাথের দণ্ডায়মাণ কংক্রিটের ভাস্কর্য। কবির ব্যবহৃত সামগ্রী ও ছবি রয়েছে বাড়ীর চারপাশের দেয়ালগুলোয় । কাচারিবাড়ীর সামনে রয়েছে রবীন্দ্র সরোবর, ফাঁকা মাঠ এবং মাঠের পাশেই রয়েছে নাগর নদী। উত্তর দিকে রয়েছে বিরাট দীঘি, দক্ষিণে কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট।
জানা যায়, ১৮৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ এ জমিদারি ক্রয় করেন। জবিদারি দেখাশোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম এখানে আসেন ১৮৯১ সালে। পতিসর কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০৫ সালে এবং কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৩ সালে। ১৯০৫ সালে তিনি পতিসর কৃষি ব্যাংক ও ১৯১৩ সালে কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২১ সালে জমিদারি ভাগ হলে পতিসর রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়লেও নানা কারণেই তিনি এখানে কম আসেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই তিনি পতিসর কুঠিবাড়ি থেকে বিদায় নেন। ১৯৮৬ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় রবীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ। এখানেই ১৯৩১ সালে বিখ্যাত সাহিত্যিক তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার প্রশাসক অন্নদা শংকর রায়ের সঙ্গে সাক্ষাত হয় রবীন্দ্রনাথের।
দক্ষিণডিহি শ্বশুরবাড়ি:
এ গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথের মা সারদা সুন্দরী, কাকী ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী ও স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ওরফে ভবতারিণী। জরাজীর্ণ দ্বিতল ভবনের সামনে স্থাপন করা হয় বিশ্বকবি ও মৃণালিনী দেবীর আবক্ষ মূর্তি এবং মৃণালিনী মঞ্চ। মঞ্চের অদূরে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফুলতলা উপজেলা সদর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে দক্ষিণডিহি গ্রাম। গ্রামের ঠিক মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিবিজড়িত একটি দোতলা ভবন। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ী।
এসব জায়গা ঘুরে হতে পারেন ইতিহাসের সাক্ষী। দেখতে পারেন প্রকৃতিকে। নিজের চোখে আবিষ্কার করতে পারেন রবীন্দ্র দর্শনকেজ। হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারেন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের যে গভীর চেতনা, তার মর্মবাণী।
এমজে/
আরও পড়ুন