‘নারীর সবটুকু অগ্রগতি নিজেদের মেধা-শ্রমে’
প্রকাশিত : ১১:২৮, ৮ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১১:৫৭, ৮ মার্চ ২০১৮
সালমা খাতুন
নারীর ক্ষমতায়নের কেন্দ্রবিন্দু পরিবার হলেও বর্তমানে নারী ক্ষমতায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে পরিবার। নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিতে নারীশিক্ষা, জেন্ডার সমতা ও প্রজননস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ সবক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমেই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন বাংলাদেশের প্রথম রেলচালক ছালমা খাতুন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একুশে টিভি অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাতাকার নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান।
ছালমা খাতুনের কথায় উঠে আসে, নারী ক্ষমতায়, নারী শিক্ষা বিকাশ, নারীর গ্রগতী, অর্থনীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিছিয়ে থাকার কারণসহ বিভিন্ন দিক। তিনি বলেন, নারীর যতটুকু অগ্রগতি তার সবটুকুই নিজেদের চেষ্টা ও মেধা-শ্রমের মাধ্যমে। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-
একুশে টিভি অনলাইন : নারী ক্ষমতায়নে মূল বাধা কোথায় ?
ছালমা খাতুন : নারী ক্ষমতায়নে মূলবাধা পরিবার। নারী কোনো কাজ শুরু করতে চাইলে প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকে। এখনও অনেক পরিবার আছে তারা চায় না তাদের মেয়ে সন্তান ও স্ত্রী ঘরের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করুক। অনেক পরিবার সমর্থন করলেই পুরোপরি সমর্থন করে না নারীর কর্মসংস্থান ঘরের বাহিরে হোক। সাহসিকতার সঙ্গে যারা ঘরের বাইরে পা রাখে তাদেরকে অন্য চোখে দেখা হয়। আমাদের দেশে নারী যতটুকু এগিয়ে তার সবটুকুই নিজেদের মেধা-শ্রমের মাধ্যমে।
একুশে টিভি অনলাইন : আপনি কেন ব্যতিক্রম এই পেশায় এসেছেন। এখানে কি কি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
ছালমা খাতুন : আমার ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল ব্যতিক্রম কোনো পেশায় কাজ করব। সেই সুবাধে আমার ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি নারী ট্রেন চালক নিয়োগ দেওয়া হবে। সেখানে আমিসহ আরও অনেক নারী পরীক্ষায় অংশ নিই। এখানে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে টিকতে হয়। তারপর মুখোমুখি হতে হয় ভাইভার। অবশেষে নিয়োগ দেওয়া হয় আমাকে। ২০০৪ সালে কর্মজীবনের সূচনা হয় সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে। ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে সহকারী চালক হিসেবে কাজে করতে গেলে কিংবা কোনো এলাকায় ট্রেনিংয়ে গেলে স্থানীয়রা খুব উৎসুক হয়ে আমাকে দেখতে আসতো।
এছাড়া নারী চালকদের জন্য সরকারিভাবে কোনো থাকার ব্যবস্থা না থাকায় পরিচিত কারো বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। সেই সময় আশপাশের মানুষ আমাকে ফায়ারম্যান হিসেবে সম্বোধন করতো, যা আমার ভালো লাগার একটা বিষয় ছিল।
একুশে টিভি অনলাইন : পরিবার থেকে কোনো বাধা আসেনি?
ছালমা খাতুন : কাজ করতে এসে আমার পরিবার থেকে তেমন কোনো বাধা আসেনি। অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। প্রথমে আমি সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে নিয়োগ পেলেও এখন পদোন্নতি হয়ে লোকোমাস্টার হয়েছি। এখন একটি ট্রেনের সার্বিক দায়িত্ব আমার উপরে থাকে। আমি এ পেশায় এলেও প্রথমে কেউ ভাল চোখে দেখেনি। ধীরে ধীরে সবার মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে।
একুশে টিভি অনলাইন : সমাজ সভ্যতার বিকাশে নারীর অনন্য অবদান সত্ত্বেও তারা এখনও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, এর কারণ কি ?
ছালমা খাতুন: নারী বঞ্চনার মূল কারণ আমি মনে করি, নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে নিজেরাই সচেতন নয়। নিজেরা তাদের অধিকার আদায় করে নিতে পারে না। পুরুষ শত অন্যায় করলেও নারীরা মুখ বুঝে মেনে নেয়। নারীর অধিকার নারীকে আদায় করে নিতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে। পরিবার, সমাজ জাতিকে সচেতন করতে হবে। সমাজ পরিবর্তনে নারীকেই বড় ভূমিকা রাখতে হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: নারীর বিভিন্ন ক্ষেতে অগ্রগতি হলেও মানসম্মত ও নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সমাজ ব্যর্থ এর কারণ কি ?
ছালমা খাতুন : নারীর নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও সমান ভূমিকা রাখতে হবে। সবাইকে বুঝাতে হবে নারী পুরুষ সমান। আমার নিজের কর্মসংস্থানের কথা বলি। আমি যখন নতুন কর্মসংস্থান যোগ দিয়েছিলাম তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। অনেকেই অন্য চোখে দেখতন। অনেকেই বলতেন মেয়ে মানুষ ঘরের মধ্যে থাকবে এমন কোনো পেশায় আসবে। মাঝে মাঝে রেলে কোনো সমস্যা হলেও আমার ওপর দোষ চাপানো হতো। এছাড়া আমাদের সমাজের মানুষের একটা ধারণা আছে নারী অনেক দুর্বল। সমাজের মানুষের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্য আমি নারী রেলচালক হিসাবে গোটা নারী সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছি।
একুশে টিভি অনলাইন: এ পেশায় দিন রাত কাজ করতে হয় আপনাকে, নারী হিসেবে এখানে সামাজিক নিরাপত্তা কেমন ?
ছালমা খাতুন: আমি যতটুকু গণ্ডির মধ্যে কাজ করি তা দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। আমি যে এলাকায় কাজ করি সেই ‘শেডে’আমার সহকর্মীরা শুরু থেকেই সহযোগিতা করছেন। তারা সব সময় বলেন, সালমা খুব ভালো। তা না হলে এতোগুলো ছেলের মধ্যে নারী হয়ে টিকে আছে কী করে।
একুশে টিভি অনলাইন: এ পর্যন্ত আসতে কী ধরনের বাধা ডিঙিয়ে আসতে হয়েছে আপনাকে ?
ছালমা খাতুন: আমার পরিবার আমাকে সহযোগিতা করে। সকালে ডিউটি থাকলে আমার স্বামী স্টেশনে পৌঁছে দেন। আমি যেহেতু ট্রেন চালাই, তাই পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে ভাবে। এতোদিন আমি শুধু কমলাপুর স্টেশনের গণ্ডির মধ্যে ট্রেন চালিয়েছি, আগে মূল চালকের পাশে বসে সহকারী চালকের দায়িত্ব পালন করতাম। এখন সরাসরি ট্রেন চালানোর কাজ করছি।
একুশে টিভি অনলাইন: নারী শিক্ষায় হার বাড়াতে কি কি পদক্ষেপ দেওয়া যেতে পারে?
ছালমা খাতুন: নারী শিক্ষা বৃদ্ধিতে পরিবারকে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া সরকারকে বিভিন্ন ধরনের পদেক্ষপ গ্রহণ করতে হবে। নারী শিক্ষা বৃদ্ধির জন্য সমাজের মানুষকে সচেতন করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নারী শিক্ষা বৃদ্ধিতে গ্রামের বিভিন্ন ধরনের সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, নাটিকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
একুশে টিভি অনলাইন: সমাজ-রাষ্ট্রীয় জীবনে নারীর অগ্রগতি কতটা হয়েছে বলে আপনার মূল্যায়ন।
ছালমা খাতুন : বর্তমান বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি অনেক হয়েছে। কিছু প্রতিবন্ধতা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি উদ্যোগ তৈরিতে নারী ভূমিকা রাখছে। আরও নিজেদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে অনেক সংগ্রামী হতে হবে। নিজেকে দক্ষতার মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: সংসার, ঘরের বাইরে বা কর্মস্থলে নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর পেছনে কী কারণ ?
ছালমা খাতুন : নারীরা আগের চেয়ে বেশি ঘরের বাইরে কাজ করছেন। তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা কাজে লাগিয়ে কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করছেন দ্রুত। ফলে নারীদের সফলতা ঈর্ষণীয়। এতে কিছু কিছু পুরুষ হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারেন। এ কারণে নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতন বাড়তে পারে। নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতনের পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পাশাপাশি দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও কুসংস্কার দায়ী। পারিবারিক ক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ রয়েছে। তবে পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরে বা কর্মক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশে কোনো আইন নেই। শিক্ষা, চাকরি ও রাজনীতিতে নারী যখন নিজ মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নেতিবাচক মানসিকতার কারণে নারীরা নানা নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন। নারীর প্রতি বৈষম্য, নিষ্ঠুরতা, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নসহ সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ না করলে সমাজ থেকে নারী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা এই নারী সমাজকে পিছিয়ে রেখে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। তবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্নমুখী উদ্যোগের ফলে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। ফলে মানুষ, বিশেষত নারীরা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এটাও ঠিক, নারীদের একটা বড় অংশ এখনো তাঁদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন।
একুশে টিভি অনলাইন: নারীরা এখন মুজরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, এর কারণ কি বলে মনে করেন?
ছালমা খাতুন: মানুষের এখনও ভ্রান্তধারণা রয়েছে নারীরা পুরুষের তুলনায় কম কাজ করে। এ কারণে অনেকেই নারীদের মজুরি কম দেয়। মেয়েরা কম কাজ করে। মেয়েরা কিছুই পরে না। এমন মানুসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। সমাজের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারলে নারীরা আরও এগিয়ে যাবে।
একুশে টিভি অনলাইন: আপনার মূল্যবান সময় দেওয়া জন্য ধন্যবাদ।
ছালমা খাতুন: একুশে টিভি অনলাইন পরিবারকেও ধন্যবাদ।
‘‘সালমা খাতুন জন্ম গ্রহণ করেন ১ জুন, ১৯৮৩ সালে। অর্জুনা মুহসীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি (২০০০) এবং কুমুদিনী সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন ( ২০০২)। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানে স্নাতক করেন। কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে ২০১৫ সালে মাস্টার্স করেন সালমা। ২০০৪ সালে তার কর্মজীবনের সূচনা হয় সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে। এখন পূর্ণাঙ্গ চালক হিসেবে কাজ করছেন। দেশের প্রথম নারী ট্রেন চালক তিনি।’’
আরও পড়ুন