পিতামাতার অধিকার বনাম নারীর কর্মক্ষেত্র
প্রকাশিত : ১২:০৯, ৮ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১২:১১, ৮ মার্চ ২০১৮
মর্জিনা খাতুন
নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস তাদের মজুরিবৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশ এবং আরও নানা বৈষম্যের প্রতিবাদ দিয়ে শুরু হয়েছিল। প্রাথমিক সেই অবস্থা থেকে বর্তমান নারীদের অবস্থার অল্পবিস্তর উন্নতি হয়েছে বৈকি, তবে পিতামাতার অধিকারের সঙ্গে নারীর কর্ম পরিবেশের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনও। পিতামাতার অধিকারের ক্ষেত্রে মাতৃত্বের বিষয়টিকে বেশি জোর দিতে হবে, কারণ শিশু জন্মের সময় থেকে বেড়ে উঠার বেশির ভাগ কার্যক্রমের সঙ্গে মায়ের সংশ্লিষ্টতা অনেকাংশে বেশি। অধিকারের বিষয়টি সাধারণত অধিকার কর্তার কিছু প্রকৃত অথবা সম্ভাব্য স্বার্থকে রক্ষার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সেক্ষেত্রে পিতামাতার মঙ্গল বা স্বার্থে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের বিষয়টি পিতামাতার অধিকার হিসেবে দেখা যায়।
একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারে বসবাসকারী পিতামাতার সন্তানের প্রতি প্রকৃতিগতভাবে যে মমত্ববোধ থাকে সেটির কারণে তারা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে সন্তানের স্বার্থকে রক্ষা করা এবং তাদের কল্যাণ বৃদ্ধিতে কাজ করা পিতামাতার অধিকার ও কর্তব্য। সন্তানের প্রতি পিতামাতার এই অধিকারের ধারণা অতীত সময়ের থেকে বর্তমানে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন রোমে সন্তানদের পিতামাতার সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কারণ, সন্তানকে দাস হিসেবে বিক্রি করা, অপ্রত্যাশিত সন্তান বিশেষ করে কন্যাসন্তানকে হত্যা করা ইত্যাদি ব্যাপারে পিতামাতার পূর্ণ অধিকার ছিল। ইউরোপেও অতীতে সন্তানদের এবং তাদের মায়েদের সম্পত্তিতে অধিকার ছিল না।
এমনকি মা অভিভাবকত্বের মর্যাদাও পেয়েছে দীর্ঘদিন পর। বর্তমানে মানবাধিকার সম্পর্কে সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কারণে নারী অধিকার এবং সন্তানের প্রতি পিতামাতার অধিকারের ধারণাটির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সন্তান আর পিতামাতার সম্পত্তি নয় বরং সন্তানের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সকল মানবাধিকার সংস্থা ও সাধারণ জনগণ বদ্ধ পরিকর। শিশুদের স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার এবং সকল ধরণের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য পিতামাতা, শিক্ষক ও সমাজের বয়স্করা ভূমিকা পালন করবে। সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে পিতামাতার অধিকারের বিষয়টি সন্তানের স্বাধীনতা, কামনা-বাসনা সর্বোপরি সকল নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবে।
পিতামাতার অধিকারকে যদি আমরা ‘সন্তানের সর্বোচ্চ মঙ্গল বা কল্যাণ নিশ্চিত করা’ এই ধারণাটির সাথে যৌক্তিকভাবে সম্পর্কিত করতে চাই তাহলে নারীর কর্মপরিবেশকে যথোপযুক্ত করা সবচেয়ে জরুরি। আমরা জানি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং আমাদের সরকার জোরালোভাবে নারীর কর্মপরিবেশ নারীদের জন্য এবং তাদের সন্তানদের জন্য যথোপযুক্ত করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে সন্তানের কল্যাণ তথা বেড়ে ওঠার সুষ্ঠ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নারী তথা মায়েদের যে সুযোগ দেওয়া দরকার সেটি বাংলাদেশের কোন কর্মক্ষেত্রে সঠিকভাবে আছে বলে আমার জানা নেই।
মাতৃত্বের অধিকারের ব্যপ্তিকাল সন্তানগর্ভে থাকা অবস্থায় শুরু হয়। একজন কর্মজীবী মা তাই শুরু থেকেই কর্মপরিবেশে নানা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। কারণ গর্ভবতী মায়ের নানা স্বাস্থ্যজটিলতা, মানসিক বিষন্নতা থাকার কারণে তারা পূর্বের মতো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। ফলে, প্রতি মুহূর্তে সহকর্মীদের দ্বারা নানাভাবে বিব্রত হতে থাকেন। এখানে শুধু পুরুষ নয়, নারী সহকর্মীরাও কর্মজীবী মায়ের কাজে যথার্থ সহযোগিতা করেন না। কর্মজীবী মা তার কর্মস্থলে সবার কাছে বোঝার মতো হয়ে পড়েন এবং সন্তান জন্মদান ও লালনপালন কেবলমাত্র ঐ মায়েরই কর্তব্য বলে মনে করা হয়। একটি সন্তান জন্মদান ও বড় করা সামাজিক দায়িত্বের অংশবিশেষ নয় কি? তাহলে কেন কর্মপরিবেশে এই লাঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক মনোভাব প্রদর্শন করা হয়?
সন্তানের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা পিতামাতার অধিকার হলে সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া সবচেয়ে জরুরি। আমাদের দেশে কতটুকু সময় পিতামাতা তাদের সন্তানদের জন্য দিতে পারেন? সন্তান বড় হয় গৃহপরিচারিকার কাছে। বিশেষত: শহরে বিদ্যালয়েও শিশুদের খেলাধূলার সুব্যবস্থা নেই। কর্মক্ষেত্রে শিশুদের দেখাশুনার সুব্যবস্থা থাকলে কাজের ফাঁকে মাতা কিংবা পিতা সন্তানের সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটাতে পারতেন। সন্তানের সুস্থ্য মানসিক বিকাশের জন্য শৈশব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবী মায়েরা সন্তানের সাথে সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যদি কোন সহায়ক ভূমিকা পালন করতে না পারেন তাহলে পিতামাতার অধিকারের ধারণার কোন অস্তিত্ব থাকে না। পিতামাতা যদিও সন্তানের ভবিষ্যতের জন্যই অর্থ উপার্জন করে থাকেন, কিন্তু সন্তানকে মানুষ করার জন্য অর্থই মূল বিষয় নয়। বিশেষত: শহরে সন্তানদের শৈশব বলতে কিছুই নেই এবং পিতামাতার সান্নিধ্য থেকেও তারা বেশিরভাগ সময় দূরে থাকে। সন্তানের অধিকার সংরক্ষণ করতে গিয়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্য ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। পারিবারিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখাও নারীদের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নারীদের কর্মঘন্টা শেষ করে পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবার, পোষাকাদিসহ অন্যান্য বিষয়গুলোর প্রতি তাদেরকেই বেশি নজর দিতে হয়। দীর্ঘ সময় কর্মঘন্টা শেষ করে নারীরা সন্তান ও পারিবারিক স্বাস্থের প্রতি মনোযোগী না হতে পারলে পরিবারের সদস্য এমনকি স্বামীর দ্বারাও মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। নারী পোষাকশ্রমিক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তরের নারী কর্মজীবীদেরকে এই বৈষম্য ও নির্যাতন থেকে প্রতিকারের সুব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।
নারীরা তাদের মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দ্বারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো কর্মজীবী মা হিসেবে ভূমিকা পালন করা। এই সময়ে তিনি কর্মক্ষেত্রে অনেকভাবে পিছিয়ে পড়েন। কর্মজীবী মায়েরা যেন মাতৃত্বের অধিকার যথার্থভাবে পালন করতে পারেন এজন্য কর্মক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতার মনোভাব যেমন তৈরি করতে হবে তেমনি প্রত্যেকটি কর্মক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের দেখাশুনার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মজীবী মা সন্তানের সুস্বাস্থের নিশ্চয়তা পেলে কর্মক্ষেত্রে অধিক মনোযোগী হতে পারবে। যাতে দেশ উপকৃত হবে এবং নারী হিসেবে সে বৈষম্য থেকে রক্ষা পাবে।
কর্মজীবী নারী কিংবা পুরুষ তাদের পিতামাতা হিসেবে অধিকার পালন করতে পারবে যদি যতদূর সম্ভব পিতা ও মাতার কর্মক্ষেত্র পাশাপাশি রাখার সুযোগ তৈরি করা যায়। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর কর্মক্ষেত্র একই উপজেলায় করার সুযোগ থাকলেও সেটি করা হয় না। কর্মক্ষেত্রের অবস্থানের কারণে স্বামী স্ত্রীকে পৃথক থাকতে হয়, যার প্রভাব সন্তানের উপর এসে পড়ে। স্বভাবতই সন্তান মায়ের কাছেই অবস্থান করার কারণে মাকে কর্মক্ষেত্র ও সন্তানের উপর অধিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও কর্মস্থল ও পরিবারে নানা বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়। পারিবারিক স্বাস্থ্য ও সন্তানের সুস্বাস্থ্য একারণে আমাদের দেশে বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হুমকির মুখে। আবার অনেক নারী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কঠোর পরিশ্রম করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার পরও চাকরি ছেড়ে দিতে হচ্ছে সন্তানের কথা চিন্তা করে কিংবা স্বামীর সাথে অবস্থান করার জন্য।
নারী অধিকার সংরক্ষণ ও একইসাথে পিতামাতার অধিকার রক্ষার জন্য নারীর কর্মপরিবেশকে যথোপযুক্ত করা সবচেয়ে জরুরি। বর্তমানে আমরা অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত নানা দিকে ব্যাপকভাবে এগিয়ে গেলেও তরুণ প্রজন্ম তাদের জীবনের স্বরূপ সম্পর্কে জানে না, জীবন সম্পর্কে তারা হতাশ। একইসাথে নানা অসামাজিক কাজের সাথেও তারা জড়িত হয়ে পড়ছে। তরুণ প্রজন্মকে শারীরিকভাবে ও চিন্তা চেতনায় বলিষ্ট, দৃঢ় ও বিচক্ষণ করে তুলতে না পারলে আমাদের সমাজের অগ্রগতি একপেশে হয়ে যাবে। ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ণের জন্য নতুন ও তরুন প্রজন্মকে যথোপযুক্ত পরিবেশে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে হবে।
পিতামাতার অধিকার ও নারীর সুষ্ঠ কর্মপরিবেশ বাস্তবায়নে কতকগুলো প্রস্তাবনা হতে পারে -
(ক) নারীদেরকে অনেক বেশি কর্মমূখী করে তুলতে হলে তাদের জন্য বৈষম্যহীন ও সুষ্ঠ কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে।
(খ) কর্মজীবী মায়েদের প্রতি কর্মক্ষেত্রে সবার সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করতে হবে।
(গ) কর্মজীবী নারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি পরিবার ও কর্মস্থলের সকলের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।
(ঘ) নারীদের কর্মক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের রাখার সুব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে মায়েরা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় তাদের সন্তানদের সাথে কাটাতে পারেন।
(ঙ) নারীদের কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে এভাবে যে, ৮ ঘন্টায় তার উপর অর্পিত কাজ যদি সুষ্টভাবে তিনি ৫ ঘন্টায় সম্পন্ন করতে পারেন তাহলে তাকে বাকি সময় পরিবারের সাথে কাটানোর অনুমতি দিতে হবে।
(চ) নারীর স্বাস্থ্যগত কিংবা সন্তানের স্বাস্থ্যগত কারণে মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করা। উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটির সুযোগ তারা এমনিতেই সীমিত করে রেখেছেন।
(ছ) স্বামী-স্ত্রীর কর্মক্ষেত্র যতদূর সম্ভব একই এলাকায় রাখার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে সচেষ্ট হতে হবে।
(জ) মাতৃত্বকালীন সময় ও সন্তান বেড়ে ওঠার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নারীদের সাপ্তাহিক ছুটি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে, পিতা বেশি সক্রিয় হলে পিতার ক্ষেত্রেও একই সুযোগ প্রদান করা যেতে পারে। কারণ পিতামাতার সমান ভূমিকা সন্তান বেড়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে সহায়ক।
(ঝ) পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা করলে পিতামাতার অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভবপর হবে।
কর্মজীবী নারীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির জন্য সর্বত্র এই সুযোগসমূহ সৃষ্টির প্রচারণা চালানো উচিত। আমাদের সমাজে যে সংখ্যক নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন তার সংখ্যা আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় এখনও অনেক কম। নারীরা যদি সার্বিক উন্নয়ণে অংশগ্রহণ করে তাহলেই কেবল আমরা পরিপূর্ণতা পাব। আমাদের নারী শ্রমিকদের প্রতি মনোভাবেরও পরিবর্তন ঘটবে যদি প্রত্যেক পরিবারের নারীরা কোন না কোন ভাবে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হন। নারীদের কর্মক্ষেত্রে ছুটি বৃদ্ধি, মজুরী বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব পুরুষের মধ্যে, এমনকি কর্মজীবী নন এমন নারীদের মধ্যেও রয়েছে সেগুলো দূর হবে নারীদের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারলে। নারীদের বৈষম্যহীন কর্মপরিবেশ, কর্মজীবী মায়েদের অধিকার নিশ্চিত করে অধিকহারে নারী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলেই আমাদের দেশ হবে উন্নত, সুখী সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : সহকারি অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন