ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৭ নভেম্বর ২০২৪

কর্মক্ষম নারীর ৬৪ শতাংশ-ই বেকার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৩১, ৮ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৩৪, ৮ মার্চ ২০১৮

নাজনীন আহমেদ

নাজনীন আহমেদ

নারীর কাজের আর্থিক মূল্য চিহ্নিত হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর যুক্তিসঙ্গত ইচ্ছা, স্বপ্ন ও মত প্রকাশের স্বীকৃতি পদদলিত হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধিনিষেধ নারী পুরুষের গভীর ব্যবধান তৈরি করেছে, তৈরি করেছে বৈষম্য। নারীর প্রতি বৈষম্য বলতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনো পার্থক্য, বঞ্চনা অথবা বিধিনিষেধকে বোঝায়। এর ফলে নারীকে  ‍পুরুষের তুলনায় অধ:স্তন বা ছোট করে দেখা হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক, পারিবারিক সবক্ষেত্রে নারীর অধিকার লঙ্ঘন করা হয়।

অথচ মানব সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নে যুগে যুগে নারী যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছেন, তার যথাযথ স্বীকৃতি দিতেও নারাজ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এসব বিষয় নিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পক্ষে স্বাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইয়াসির আরাফাত রিপন

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অর্থনীতিতে নারীর অবদান কতটুকু?

নাজনীন আহমেদ: আমরা সবাই জনসংখ্যার দিক দিয়ে জানি, দেশে নারী-পুরুষ সমানে সমান। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে কর্মক্ষম নারী যাদের বয়স ১৫ থেকে বেশি তাদের মধ্য থেকে মাত্র ৩৬ শতাংশ নারী শ্রম বাজারে আছেন। বাকিরা শ্রমবাজারে নাই। তার মানে এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ কর্মক্ষম নারীর ৬৪ শতাংশই শ্রমবাজারে নেই। শিশু এবং বৃদ্ধদের বাদ দিয়ে সম্পদের এই বিরাট একটা অংশের অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকে ৮২ শতাংশ কর্মক্ষম পুরুষ মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত আছেন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীকে গৃহকর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এখনও। এটাকে কিভাবে দেখছেন আপনি?

নাজনীন আহমেদ: দেশের বেশিরভাগ নারী-ই গৃহকর্মে নিযুক্ত আছেন। গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকা আর অর্থনীতিতে অবদান রাখা এক কথা নয়। তারা পারিবারিক সামাজিকসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। নারীরা শুধু গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন কেন? এখানে পুরুষদেরও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। এছাড়া সংসার তো নারী-পুরুষ দুজনের, দুজনকেই কাজ ভাগাভাগি করে নিতে হবে। কারণ গৃহের কাজকে আমরা বলি ‘আনপেইড ওয়ার্ক’। এটার জন্য কেউ কাউকে অর্থ দেয় না। তাই নারী-পুরুষ উভয়কেই ঘরের এবং বাইরের কাজ করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমাজে নারীর কর্মকাণ্ড নাই, যেখানে একজন পুরুষের অর্থনৈতিক ভিত্তিটা শক্তিশালি। এর কারণ কি?

নাজনীন আহমেদ: নারীরা কোনোভাবে অর্থ পায় না, আর অর্থ না পেলে সত্যিকার অর্থে কেউ অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে না। এছাড়া নানা কারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। নারীর একদিকে অর্থ নাই, অন্যদিকে তার সম্পদ নাই। এই দুই কারণে নারীর ভিত্তিটাই দুর্বল। আবার ধর্মীয়ভাবেও নারীকে সম্পদের দিক থেকে সমানাধিকার দেওয়া হয়নি। সম্পদে যেহেতু নারীর সমানাধিকার নেই তাই তার ক্ষমতা কোথা থেকে আসবে? হয় তার সম্পদ থাকবে, না হয় তার রেগুলার আয় থাকতে হবে। তার সম্পদও নাই আবার আয়ও নাই। সুতরাং তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নাই। ফলে নারীর ভিত্তিটা হয়েছে অনেক দুর্বল। অপরদিকে কর্মক্ষম পুরুষের ৮২ ভাগই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালি। তারা শ্রম বাজারে আছে। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিটা মজবুত।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: গৃহের কাজ কি শুধু নারীরা করবে, নাকি দুজনের মতামতের ভিত্তিতে করা উচিত?

নাজনীন আহমেদ: সমাজে পুরুষের সঙ্গে নারীর তুলনা করা যাবে না। মূল কথা হলো নারী-পুরুষ যাই হোক তাদের কর্মক্ষমের মধ্যে থাকা উচিত। এছাড়া আনপেইড ফ্যামেলি ওয়ার্কগুলো সমানভাবে করতে হবে। এক্ষেত্রে একজন পুরুষও গৃহের সব কাজ করতে পারেন নারীর মতামতের ভিত্তিতে। আবার পুরুষকে যদি বলি গৃহসহ আপনাকে বাইরের কাজ করতে হবে। তাহলে পুরুষরা ভাববে তাদের একটা বন্ধনের মধ্যে রাখতে চাচ্ছি আমরা। আমরা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলি কিন্তু আমরা এটা ভুলে যায় যে ছেলেদেরকেও একটা বন্ধনের মধ্যে ফেলে দিয়েছি।

আবার পুরুষকে বলছি তোমাকে উপার্জন করতেই হবে। আর মেয়েকে বলছি তোমাকে উপার্জন না করলেও চলবে, বাসায় থাকলেও চলবে। এই দু’টিই ঠিক না। পুরুষেরও স্বাধীনতা থাকতে হবে। সে চাইলে পুরো ঘরের কাজটা নিতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল হলো নারী-পুরুষ আলোচনা, সমঝোতার ভিত্তিতে গৃহকর্ম আর বাইরের কাজের সিদ্ধান্ত নেবে।

নারীদের যারা কর্মক্ষম তারা রাষ্ট্রের সম্পদ। তারা দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন, যদি তাদের কাজে লাগানো যায়। এতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শ্রমবাজারে যেসব নারী এসেছেন তাদের কৃষিতে অবদান কেমন?

নাজনীন আহমেদ: নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে খুব কম সংখ্যেই শ্রমবাজারে এসে যুক্ত হয়েছেন। শ্রমবাজারে যেসব নারী এসেছেন তাদের ৬৫ শতাংশের বেশি কৃষিতে আছেন। কৃষিতে তারা এমনভাবে আছেন, সেখানে যে তারা একটা ডায়নামিক পজিশনে আছেন, তা কিন্তু না। কৃষিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা নিজের জমি বা অন্যের জমিতে কাজ করছে। একটা কৃষি খামার করা বা এ ধরণের কাজ কিন্তু খুবই কম। সব মিলিয়ে আমরা দেখি ম্যানফ্যাচারিং সেক্টর বা ট্রেডিং-এ নারীরা কম আসছেন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীদের ফরমাল জবে না আসার কারণ কি?

নাজনীন আহমেদ: এটা সত্য যে, নারীরা ফরমাল জবে খুব কম আসছেন। আবার ফরমাল জব যদি বলি এর মধ্যে বেশির ভাগই আছেন গার্মেন্টস সেক্টরে। সরকারি চাকরি যেমন ডাক্টারসহ অন্যান্য জবে মোট ৫ শতাংশ নারী আছেন। এখানে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলি মনে করি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারী কর্মক্ষেত্রে আসতে চায় না। এর কাণটা যদি বলেন?

নাজনীন আহমেদ: এখন এটা ঠিক উচ্চ শিক্ষিত না হয়েও কর্মক্ষেত্রে যেতে পারে। ৮ম বা১০ম শ্রেণী পর্যন্ত যারা পড়েছেন তারা কর্মক্ষেত্রে নাই। এর মধ্যে অনেকে আছেন যারা কর্মক্ষেত্রে আসতে চান। কিন্তু তারপরও তারা আসতে পারছে না। তাদের মধ্যে জেন্ডার রুল এমনভাবে ঢুকে গেছে যে আমি বাইরের কাজ করব না। গৃহাস্থলির কাজেই থাকবে। কেউ যদি সব সুযোগ পেয়েও গৃহে থাকে আমি মনে করি এটা তার চয়েজ। তবে এই চয়েজটা শুধু নারীর না একজন পুরষেরও থাকা উচিত।

আমাদের সমাজে কিছু নারী অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হতে চান সেক্ষেত্রে তারা সুযোগ পান না। আরেকটা হলো শিক্ষার সুযোগ পায় কিন্তু শিক্ষার সুযোগ নেওয়ার পর তারা উচ্চ শিক্ষায় যেতে পারেন না। আরেকটি অংশ আছে যারা শিক্ষা যতটুকু করেছে, কিন্তু শিক্ষাটাকে কাজে লাগিয়ে তারা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যেতে পারছেন বা চাচ্ছেন না। এ জন্য দরকার সচেতন করে তোলা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী ঝরে পড়ে, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় এখনও নারীরা পিছিয়ে। এ বিষয়ে আপনার মাতমত জানতে চাই।

নাজনীন আহমেদ: নারীদের আমরা শিক্ষিত করছি। এন্ট্রি পয়েন্টে আমরা শতভাগ মেয়ে, শতভাগ ছেলে স্কুলে ভর্তি করায়। প্রথম পর্যায়ে আমরা নারী-পুরুষ সমানে সমান স্কুলে ভর্তি হতে দেখি। এরপর যত উপর ক্লাসে উঠতে থাকে তত তারা ঝরে পড়ে। আবার নারীদের জন্য আমরা বৃত্তির ব্যবস্থা করছি। কলেজ লেবেল পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিচ্ছি। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে যেতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত থাকে না।

এক্ষেত্রে তারা স্থানীয় পর্যায়ে যখন স্কুলে যায় তখন নানা ভাবে ইভজটিজিং-এর শিকার হন। আবার পরিবারকভাবে সমান সুযোগ দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে পরিবারকে সমান সুযোগবান্ধর হতে হবে। ছেলেকে যেমন সাপোর্ট দিবে মেয়েকেও শিক্ষায় সুযোগ দিতে হবে। তবে এখন সচেতনতা এসেছে স্কুল পর্যায়ে তবে কলেজ পর্যায়ে গেলে ইভটিজিং-এর সম্বাবনা থাকে। এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা হলে নারীদের আমরা উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারব।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: লেখাপড়া জানা মেয়ে কর্মক্ষেত্রে আসতে চায় না। এর কারণ কি?

নাজনীন আহমেদ: শিক্ষা নিয়েছেন এরপরও নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসতে চাই না। এ জন্য তাদের সচেতন করতে হবে। এটা হতে হবে বইপত্রের মাধ্যমে, পাড়া ক্লাবের মাধ্যমে, গণমাধ্যমের মাধ্য, সেখানে জেন্ডার বিষয়ে বোঝোতে হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী-পুরুষ ঘরের এবং বাইরের কাজ করবেন। সেইটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আসতে হবে।

যারা ডাক্টার বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন, বিশ্বিবিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়বেন এখানে বিরাট একটা বিনিয়োগ বাবা-মার এবং সরকারের। এরপরও যদি তারা কর্মক্ষেত্রে না আসে তাহলে তাদের ফিছনে যে টাকা খরচ হয়েছে সেগুলো ফেরত নেওয়া উচিত। কারণ একটা মেয়ে ডাক্টার হওয়ার জন্য সুযোগ-সুবিধা নিল কিন্তু কর্মক্ষেত্রে আসলো না, ওখানে একটা ছেলে হলে সে ভালো সেবা দিতে পারত। আমাদের এখানে অনেককে ডাক্টারি পড়ার সুযোগ দিতে পারছিনা, এরপরও তারা সেই সুযোগ নেওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে আসেনা। দেশে ডাক্টার নাই অনেক অনেক রোগি আছে। আগেই ঘোষণা দেওয়া উচিত যে, যারা ডাক্টারি পড়বে তাদের কমপক্ষে ৫ বছর বা ১০ বছর সামজে সেবা দিতে হবে।

এই উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম সিট থাকে, কম্পিটিশন বেশি থাকে। এই ধরণের পড়াশেনার পরও যারা সেবা দেন না তারা সমাজের খারাপ উদাহারণ। কেউ যদি মনে করেন আমি কর্মক্ষেত্রে অতোদুর যাব না, তাহলে তাদের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। অতো যাওয়ার দরকতার নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সংসারে আসার দরকার নেই। সংসারের জন্য উচ্চ ডিগ্রি লাগে না।

আবার মেয়েরা গার্হস্থ কলেজে পড়বে ছেলেরা পড়বে কৃষি শিক্ষা নিয়ে। এই বিভাজন কেন সমাজে? ছেলে গার্হস্থ কলেজে পড়তে পারবে আবার মেয়েও কৃষি নিয়ে পড়তে পারবে। আমাদের বিভাজনের এই মানুষিকতা থেকে বের হতে হবে।

আবার ছেলেরা রান্না করতে পারে না, ঘর মোছার কাজ করতে পারেনা, কেনো। এটা হতে পারেনা এটা তাকে জানতে হবে। আবার মেয়েকেও বাজারে যেতে হবে, ব্যাংকে যেতে হবে, রান্না করতে হবে। ছেলেরা ডিম ভাজতে পারেনা এটা বিদেশিরা শুনলে হাসবে। দেশের ছেলেরা গর্ব করে বলে আমি এটা করতে পারিনা। মধ্য আয়ের দেশের ছেলে একটা ডিম ভাজতে পারে না মানা যায় না।

আবার মেয়েদের পরিবার সামলিয়ে চাকরি করতে হবে, ছেলেদের ক্ষেত্রে কেন নয়। সে আরামে অফিসে যাবে এটা হতে পারেনা। পরিবার দুজনের। নারীকে বলা হচ্ছে পরিবার সামলায়ে চাকরি করতে পারলে কর, তাকে একটা বোঝা দেওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে ঘরে বসে থাকা অনেক ভাল। এক্ষেত্রে অবশ্যই সমঝোতা থাকতে হবে নারী-পুরুষের।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা একেবারেই কম। এর কারণটা যদি বলেন?

নাজনীন আহমেদ: ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে মেয়েকে কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। খুব অল্প পরিসরে বাবার ব্যবসার একটা অংশের ডিরেক্টর রাখা হয় মেয়েকে। কিন্তু একটা নতুন একটা ব্যবসায় রিস্ক নিয়ে ছেলেকে দেওয়া হয়, মেয়েকে কিন্তু দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ভাইয়ের চেয়ে মেয়েটা যোগ্য ছিল কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি। কারণ সে মেয়ে তাকে বিয়ে দেওয়া হবে অন্যের ঘরে। তাই এটা দেওয়া হয় না। এখনও আমাদের সমাজে এই প্রথার প্রচলন আছে যে, বাবা অর্থ উপার্জন করবে আর মা সন্তানের লালন-পালন করবেন। কিন্তু এটা কেনো বাবা-মা দুজনের আদর স্নেহ থাকতে হবে সন্তানের লালন-পালনে। এক্ষেত্রে মাও অর্থ দেবেন, স্নেহ দেবে, ভালবাসা দেবে।

এজন্য অবশ্যই ডে-কেয়ার সেন্টার করা দরকার। বেসকারি খাতে আরও বেশি বেশি ডে-কেয়ার সেন্টার হচ্ছে। এটা হলে একজন মা সন্তানের লালন-পালন করতে পারেন এবং অর্থ উপার্জনও করতে পারেন। ডে-কেয়ার সুযোগটা খুব বেশি জরুরি।  এ ব্যাপারে প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীদের বিভিন্নভাবে সমাজ বা চলার পথে ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ জানতে চাই।

নাজনীন আহমেদ: আমাদের অবশ্যই নারীদের সম্মান করতে হবে। এখনও নারীদের ইভটিজিং-এর শিকার হতে হয়। হাটে-ঘাটে যদি নারী নিরাপত্তা না পায় তাহলে কেনো সে যাবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। আর সমাজে জেন্ডারের ভিত্তিতে সমতা আনতে হবে। সুযোগের সমতা যদি আসে তাহলে নারী-পুরুষের সমতা আসবে। এখানে সমান মানে নারী-পুরষের সব বিষয়ে সমান সুযোগ থাকতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে নারীর অবদান কতটুকু?

নাজনীন আহমেদ: রাষ্ট্রের প্রধান যখন নারী হন, তখন তিনি সেটা দেখেন, এগিয়ে নেন। রাষ্ট্রে নারীর অবদান আরও বেশি হতে পারত যদি আমরা সক্ষম প্রতিভাবান নারীদেরকে কর্মক্ষেত্রে আনতে পারতাম। আজ পোশাক খাতে বেশির ভাগ শ্রমিকই নারী। সেই নারী শ্রমিকের বানানো পোশাকের ৮০ ভাগ রফতানি আসছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: উদ্যোক্তা তৈরিতে চেম্বারগুলোর অবদান কেমন?

নাজনীন আহমেদ: উইমেন চেম্বার এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখছেন। তারা উদ্যোক্তা তৈরি করতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। বিভিন্ন ফান্ডের মাধ্যমে ট্রেনিং হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। উইমেন চেম্বার, এসএমই ফাউন্ডেশন উদ্যোক্তা তৈরিতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখছে। আগে অনেক কম হয়েছে এখন অনেকটা ভালো হচ্ছে। আপনি শুধু সেলাই মেশিনে সেলাই শিখিয়ে দিলেই হবে না, ব্যবসার বিষয়েও ট্রেনিং দরকার। সেক্ষেত্রে তারা সেটাই করছে। আবার এসএমই ফাউন্ডেশনও অনেক কাজ করছে। এতো দিনে ট্রেইনাররা বুঝতে পেরেছেন তাই তারা অনেক ভাল কাজ করছেন। নারী উদ্যোক্ত তৈরি এবং উদ্যোক্তা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে করতে উইমেন চেম্বাররের ভালো ভূমিকা আছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এখনও নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে রাখা হয়, এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

নাজনীন আহমেদ: নারীকে অর্থনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে রাখা হয়। আগেই তাকে বলা হয় তুমিতো বোঝই না, এভাবে তাকে থামিয়ে দেয়। কর্মক্ষেত্রে নারীর সংযোগ যদি না ঘটানো হয় তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষমাতায়ন হবে না। আবার এমনও অনেক নারী আছে যে, পত্রিকা পড়তে পারে না, ঘরের বাইরে যেতে পারে না সে কিভাবে সিদ্ধান্ত দেবে? এজন্য তাকে ঘরের বাইরে গিয়ে জ্ঞান নিতে হবে। পড়ালেখা জানতে হবে এবং পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে অবদান রাখতে হবে।  

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এবং নারী দিবসের শুভেচ্ছা রইল।

নাজনীন আহমেদ: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

আর / এআর                                                                    

 

নারীর কাজের আর্থিক মূল্য চিহ্নিত হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর যুক্তিসঙ্গত ইচ্ছা, স্বপ্ন ও মত প্রকাশের স্বীকৃতি পদদলিত হয়।সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধিনিষেধ নারী পুরুষের গভীর ব্যবধান তৈরি করেছে, তৈরি করেছে বৈষম্য। নারীর প্রতি বৈষম্য বলতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনো পার্থক্য, বঞ্চনা অথবা বিধিনিষেধকে বোঝায়। এর ফলে নারীকে পরুষের তুলনায় অধস্তন বা ছোট করে দেখা হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাস্কৃতিক, নাগরিক, পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়।

অথচ মানব সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নে যুগে যুগে নারী যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে, তার যথাযথ স্বীকৃতি দিতেও নারাজ আমাদের পরুষতান্ত্রিক সমাজ। এসব বিষয় নিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পক্ষে স্বাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইয়াসির আরাফাত রিপন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অর্থনীতিতে নারীর অবদান কতটুকু?

নাজনীন আহমেদ: আমরা সবাই জনসংখ্যার দিক দিয়ে জানি, দেশে নারী-পুরুষ সমানে সমান। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে কর্মক্ষম নারী যাদের বয়স ১৫ থেকে বেশি তাদের মধ্যে থেকে মাত্র ৩৬ শতাংশ নারী শ্রম বাজারে আছেন। অর্থাৎ তারা কর্মের সাথে সংযুক্ত আছেন। বাকিরা শ্রমবাজারে নাই। তার মানে এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠি অর্থাৎ কর্মক্ষম নারীর ৬৪ শতাংশই শ্রমবাজারে নাই। শিশু এবং বৃদ্ধদের বাদ দিয়ে সম্পদের এই বিরাট একটা অংশের অপচয় হচ্ছে। আবার পুরুষের মধ্য থেকে আমরা যদি দেখি দেখব তাদের ৮২ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে আছেন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীকে গৃহের কর্মী হিসেবে দেখা হয় এখনও। এটাকে বিভাবে দেখছেন আপনি?

নাজনীন আহমেদ: দেশের বেশির ভাগ নারীরাই গৃহকর্মে নিযুক্ত আছেন। কিন্তু গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকাটা অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখে না। তারা পারিবারিক সামাজিকসহ বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত থাকতে পারেন। নারীরা শুধু গৃহ কর্মের সাথে যুক্ত থাকবেন কেন। এখানে পুরুষদেরও এ কাজের সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে। তাছাড়া সংসারতো নারী পুরুষ দুজনের, তাই দুজনকেই এখানে কাজ ভাগাভাগি করে নিতে হবে। কারণ গৃহের কাজকে আমরা বলি ‘আনপেইড ওয়ার্ক’ এটার জন্য কেউ কাউকে অর্থ দেয় না। তাই নারী-পুরুষ উভয়কেই ঘরের এবং বাইরের কাজ করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমাজে নারীর কর্মকান্ড নাই, যেখানে একজন পুরুষের অর্থনৈতিক ভিত্তিটা শক্তিশালি। এর কারণ কি?

নাজনীন আহমেদ: নারীরা কোনোভাবে অর্থ পায়না, আর অর্থ না পেলে সত্যিকার অর্থে কেউ অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে না। তাছাড়া নানা কারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। নারীর একদিকে অর্থ নাই, অন্য দিকে তার সম্পদ নাই। এই দুই কারণে নারীর ভিত্তিটাই দুর্বল।

আবার ধর্মীয়ভাবেও নারীকে সম্পদের দিক থেকে সমানিধিকার দেওয়া হয়নি। সম্পদের যেহেতু নারীর সমানাধিকার নেই তাই তার ক্ষমতা কোথা থেকে আসবে। হয় তার সম্পদ থাকবে না হয় তার রেগুলার আয় থাকতে হবে। তার সম্পদও নাই আবার আয়ও নাই সুতরাং তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নাই। ফলে নারীর ভিত্তিটা হয়েছে অনেক দুর্বল। অপর দিকে কর্মক্ষম পুরুষের ৮২ ভাগই অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালি। তারা শ্রম বাজারে আছে। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিটা মজবুত।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমাজে গৃহের কাজ কি শুধু নারীরা করবে নাকি দুজনের মতামতের ভিত্তি করা উচিত। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাইব।

নাজনীন আহমেদ: সমাজে পুরুষের সাথে নারীদের তুলনা করা যাবে না। মূল কথা হলো নারী-পুরুষ যাই হোক তাদের কর্মক্ষমের মধ্যে থাকা উচিত। তাছাড়া আনপেইড ফ্যামেলী ওয়ার্কগুলো সমানভাবে করতে হবে। এক্ষেত্রে একজন পুরুষও গৃহের সব কাজ করতে পারেন মতামতের ভিত্তিতে। আবার পুরুষকে যদি বলি গৃহসহ আপনাকে বাইরের কাজ করতে হবে। তাহলে বলতে পারি পুরুষকেউ একটা বন্ধনের মধ্যে রাখতে চাচ্ছি আমরা। আমরা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলি কিন্তু আমরা এটা ভুলে যায় যে ছেলেদেরকেও একটা বন্ধনের মধ্যে ফেলে দিয়েছি।

আবার পুরুষকে বলছি তোমাকে উপার্জন করতেই হবে। আর মেয়েকে বলছি তোমাকে উপার্জন না করলেও চলবে, বাসাই থাকলেও চলবে। এই দুইটাই ঠিক না। পুরুষেরও স্বাধীনতা থাকতে হবে। সে চাইলে পুরো ঘরের কাজটা নিতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল হলো নারী-পুরুষ আলোচনা, সমঝোতার ভিত্তিতে গৃহ কর্ম আর বাইরের কাজের সিদ্ধান্ত নেবে। নারীদের যারা কর্মক্ষম তারা রাষ্ট্রের সম্পদ। তারা দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন, যদি তাদের কাজে লাগানো যায়। এতে রাষ্ট্রিয় সম্পদের অপচয় হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শ্রমবাজারে যে সব নারী এসেছেন তাদের কৃষিতে অবদান কেমন?

নাজনীন আহমেদ: নারীর অর্থনীতিক ক্ষমতায়ণে খুব কম সংখ্যক শ্রমবাজারে এসেছেন। শ্রমবাজারে যে সব নারী এসেছেন তাদের ৬৫ শতাংশের বেশি কৃষিতে আছেন। কৃষিতে তারা এমনভাবে আছেন,, যেখানে যে একটা ডায়নামিক তা কিন্তু না। কৃষিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা নিজের জমি বা অন্যের জমিতে কাজ করছে। একটা কৃষি খামার করা বা এ ধরণের কাজ কিন্তু খুবই কম। সব মিলেয়ে আমরা দেখি ম্যানফ্যাচারিং সেক্টর বা ট্রেডিং-এ নারীরা কম আছেন। যেখানে ম্যানফ্যাচারিং সেক্টর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।

 

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীদের ফরমাল জবে না আসার কারণ কি?

নাজনীন আহমেদ: এটা সত্য যে, নারীরা ফরমাল জবে খুব কম আছেন। আবার ফরমাল জব যদি বলি এর মধ্যে বেশির ভাগই আছেন গার্মেন্টস সেক্টরে। সরকারি চাকরি যেমন ডাক্টারসহ অন্যান্য জবে মোট ৫ শতাংশ নারী আছেন। এখানে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলি মনে করি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারী কর্মক্ষেত্রে আসতে চায় না। এর কাণটা যদি বলেন?

নাজনীন আহমেদ: এখন এটা ঠিক উচ্চ শিক্ষিত না হয়েও কর্মক্ষেত্রে যেতে পারে। ৮ম বা১০ম শ্রেণী পর্যন্ত যারা পড়েছেন তারা কর্মক্ষেত্রে নাই। এর মধ্যে অনেকে আছেন যারা কর্মক্ষেত্রে আসতে চান। কিন্তু তারপরও তারা আসতে পারছে না। তাদের মধ্যে জেন্ডার রুল এমন ভাবে ঢুকে গেছে যে আমি বাইরের কাজ করব না। গৃহস্থলির কাজেই থাকবে। কেউ যদি সব সুযোগ পেয়েও গৃহে থাকে আমি মনে করি এটা তার চয়েজ। তবে এই চয়েজটা শুধু নারীর না একজন পুরষেরও থাকা উচিত।

আমাদের সমাজে কিছু নারী অর্থনৈতিক ভাবে সক্ষম হতে চান সেক্ষেত্রে তারা সুযোগ পান না। আরেকটা হলো শিক্ষার সুযোগ পায় কিন্তু শিক্ষার সুযোগ নেওয়ার পর তারা উচ্চ শিক্ষায় যেতে পারেন না। আরেকটি অংশ আছে যারা শিক্ষা যতটুকু করেছে, কিন্তু শিক্ষাটাকে কাজে লাগিয়ে তারা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যেতে পারছে না। এ জন্য তাদের সচেতন করা দরকার।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী ঝরে পড়ে, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় এখনও নারীরা পিছিয়ে। এ বিষয়ে আপনার মাতমত জানতে চাই।

নাজনীন আহমেদ: নারীদের আমরা শিক্ষিত করছি। এন্ট্রি পয়েন্টে আমরা শতভাগ মেয়ে, শতভাগ ছেলে স্কুলে ভর্তি করায়। প্রথম পর্যায়ে আমরা নারী-পুরুষ সমানে সমান স্কুলে ভর্তি হতে দেখি। এরপর যত উপর ক্লাসে উঠতে থাকে তত তারা ঝরে পড়ে। আবার নারীদের জন্য আমরা বৃত্তির ব্যবস্থা করছি। কলেজ লেবেল পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিচ্ছি। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে যেতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত থাকে না।

এক্ষেত্রে তারা স্থানীয় পর্যায়ে যখন স্কুলে যায় তখন নানা ভাবে ইভজটিজিং-এর শিকার হন। আবার পরিবারকভাবে সমান সুযোগ দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে পরিবারকে সমান সুযোগবান্ধর হতে হবে। ছেলেকে যেমন সাপোর্ট দিবে মেয়েকেও শিক্ষায় সুযোগ দিতে হবে। তবে এখন সচেতনতা এসেছে স্কুল পর্যায়ে তবে কলেজ পর্যায়ে গেলে ইভটিজিং-এর সম্বাবনা থাকে। এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা হলে নারীদের আমরা উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারব।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: লেখাপড়া জানা মেয়ে কর্মক্ষেত্রে আসতে চায় না। এর কারণ কি?

নাজনীন আহমেদ: শিক্ষা নিয়েছেন এরপরও নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসতে চাই না। এ জন্য তাদের সচেতন করতে হবে। এটা হতে হবে বইপত্রের মাধ্যমে, পাড়া ক্লাবের মাধ্যমে, গণমাধ্যমের মাধ্য, সেখানে জেন্ডার বিষয়ে বোঝোতে হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী-পুরুষ ঘরের এবং বাইরের কাজ করবেন। সেইটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আসতে হবে।

যারা ডাক্টার বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন, বিশ্বিবিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়বেন এখানে বিরাট একটা বিনিয়োগ বাবা-মার এবং সরকারের। এরপরও যদি তারা কর্মক্ষেত্রে না আসে তাহলে তাদের ফিছনে যে টাকা খরচ হয়েছে সেগুলো ফেরত নেওয়া উচিত। কারণ একটা মেয়ে ডাক্টার হওয়ার জন্য সুযোগ-সুবিধা নিল কিন্তু কর্মক্ষেত্রে আসলো না, ওখানে একটা ছেলে হলে সে ভালো সেবা দিতে পারত। আমাদের এখানে অনেককে ডাক্টারি পড়ার সুযোগ দিতে পারছিনা, এরপরও তারা সেই সুযোগ নেওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে আসেনা। দেশে ডাক্টার নাই অনেক অনেক রোগি আছে। আগেই ঘোষণা দেওয়া উচিত যে, যারা ডাক্টারি পড়বে তাদের কমপক্ষে ৫ বছর বা ১০ বছর সামজে সেবা দিতে হবে।

এই উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম সিট থাকে, কম্পিটিশন বেশি থাকে। এই ধরণের পড়াশেনার পরও যারা সেবা দেন না তারা সমাজের খারাপ উদাহারণ। কেউ যদি মনে করেন আমি কর্মক্ষেত্রে অতোদুর যাব না, তাহলে তাদের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। অতো যাওয়ার দরকতার নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সংসারে আসার দরকার নেই। সংসারের জন্য উচ্চ ডিগ্রি লাগে না।

আবার মেয়েরা গার্হস্থ কলেজে পড়বে ছেলেরা পড়বে কৃষি শিক্ষা নিয়ে। এই বিভাজন কেন সমাজে? ছেলে গার্হস্থ কলেজে পড়তে পারবে আবার মেয়েও কৃষি নিয়ে পড়তে পারবে। আমাদের বিভাজনের এই মানুষিকতা থেকে বের হতে হবে।

আবার ছেলেরা রান্না করতে পারে না, ঘর মোছার কাজ করতে পারেনা, কেনো। এটা হতে পারেনা এটা তাকে জানতে হবে। আবার মেয়েকেও বাজারে যেতে হবে, ব্যাংকে যেতে হবে, রান্না করতে হবে। ছেলেরা ডিম ভাজতে পারেনা এটা বিদেশিরা শুনলে হাসবে। দেশের ছেলেরা গর্ব করে বলে আমি এটা করতে পারিনা। মধ্য আয়ের দেশের ছেলে একটা ডিম ভাজতে পারে না মানা যায় না।

আবার মেয়েদের পরিবার সামলিয়ে চাকরি করতে হবে, ছেলেদের ক্ষেত্রে কেন নয়। সে আরামে অফিসে যাবে এটা হতে পারেনা। পরিবার দুজনের। নারীকে বলা হচ্ছে পরিবার সামলায়ে চাকরি করতে পারলে কর, তাকে একটা বোঝা দেওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে ঘরে বসে থাকা অনেক ভাল। এক্ষেত্রে অবশ্যই সমঝোতা থাকতে হবে নারী-পুরুষের।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ব্যবসার ক্ষেত্রে নারীর অবদান খুব কমই লক্ষ করা যায়। এর কাণটা যদি বলেন।

নাজনীন আহমেদ: ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে মেয়েকে কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। খুব অল্প পরিসরে বাবার ব্যবসার এটকা অংশের ডিরেক্টর রাখা হয় মেয়েকে। কিন্তু একটা নতুন একটা ব্যবসায় রিস্ক নিয়ে ছেলে দেওয়া হয়, মেয়েকে দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ভাইয়ের চেয়ে মেয়েটা যোগ্য ছিল কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি। কারণ সে মেয়ে তাকে বিয়ে দেওয়া হবে অন্যের ঘরে। তাই এটা দেওয়া হয় না। এখনও আমাদের সমাজে এই প্রথা প্রচলন আছে যে বাবা অর্থ উপার্জন করবে আর মা সন্তানের লালন-পালন করবেন। কিন্তু এটা কেনো বাবা-মা দুজনের আদর স্নৃহ থাকতে হবে সন্তানের লালন-পালনে। এক্ষেত্রে মাও অর্থ দিবে, স্নৃহ দিবে, ভালবাসা দিবে।

এজন্য অবশ্যই ডে-কেয়ার সেন্টার করা দরকার। বেসকারি খাতে আরো বেশি বেশি ডে-কেয়ার সেন্টার হচ্ছে। এটা হলে একজন মা সন্তানের লালন-পালন করতে পারেন এবং অর্থ উপার্জনও করতে পারেন। ডে-কেয়ার সুযোগটা খুব বেশি জরুরী।  এ ব্যাপারে প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীদের বিভিন্নভাবে সমাজ বা চলার পথে ইভটিজিং-এর শিকার হতে হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ জানতে চাই।

নাজনীন আহমেদ: আমাদের অবশ্যই নারীদের সম্মান করতে হবে। এখনও নারীদের ইভটিজিং-এর শিকার হতে হয়। হাটে-ঘাটে যদি নারী নিরাপত্তা না পায় তাহলে কেনো সে যাবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। আর সমাজে জেন্ডারের ভিত্তিতে সমতা আনতে হবে। সুযোগের সমতা যতি আসে তাহলে নারী-পুরুষের সমতা আসবে। এখানে সমান মানে নারী-পুরষের সব বিষয়ে সমান সুযোগ থাকতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অর্থনৈতিকভাবে নারী এখনও অসচ্ছর। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

নাজনীন আহমেদ: নারী কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেনা বলেই সে অসচ্ছল না। এখানে অসচ্ছলতার কারণে এটা নয়, বরং অসচ্ছলতার কারণে নারী উদ্যোক্তা হতে পারছে না। চাকরি করতে সমস্যা না। অর্থনৈতিকভাকবে ক্ষমতায়ন মানে জব করা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে নারীর অবদান কতটুকু:

নাজনীন আহমেদ: রাষ্ট্রের প্রধান যখন নারী হন, তখন তিনি সেটা দেখেন, এগিয়ে নেন। রাষ্ট্রে নারীর অবদান আরো হতে পারত যদি আমরা সক্ষম প্রতিভাবান নারীদেরকে কর্মক্ষেত্রে আনতে পারতাম। আজ পোশাক খাতে বেশির ভাগ শ্রমিকই নারী। সেই নারী শ্রমিকের বানানো পোশাকের ৮০ ভাগ রফতানি আসছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: উদ্যোক্তা তৈরিতে চেম্বারগুলোর অবদান কেমন?

নাজনীন আহমেদ: উইমেন চেম্বার এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল ভূমিকা রাখছেন। তার উদ্যোক্তা তৈরি করতে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করছে। বিভিন্ন ফান্ডের মাধ্যমে ট্রেনিং হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। উইমেন চেম্বার, এসএমই ফাউন্ডেশন উদ্যোক্তা তৈরিতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখছে। আগে অনেক কম হয়েছে এখন অনেকটা ভাল হচ্ছে। আপনি শুধু সেলাই মেশিনে সেলাই শিখিয়ে দিলেই হবে না, ব্যবসার বিষয়েও ট্রেনিং দরকার। সেক্ষেত্রে তারা সেটাই করছে। আবার এসএমই ফাউন্ডেশনও অনেক কাজ করছে। এতো দিনে ট্রেইনাররা বুঝতে পেরেছেন তাই তারা অনেক ভাল কাজ করছেন। নারী উদ্যোক্ত তৈরি এবং উদ্যোক্তা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে করতে উইমেন চেম্বাররের ভালো ভূমিকা আছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এখনও নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে রাখা হয়, এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

নাজনীন আহমেদ: নারীকে অর্থনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে রাখা হয়। আগেই তাকে বলা হয় তুমিতো বোঝই না, এভাবে তাকে থামিয়ে দেয়। কর্মক্ষেত্রে নারীর সংযোগ যদি না ঘটানো হয় তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষমাতায়ণ হবে না। আবার এমনও অনেক নারী আছে যে, পত্রিকা পড়তে পারেনা, ঘরের বাইরে যেতে পারে না সে কিভাবে সিদ্ধান্ত দিবে? এ জন্য তাকে ঘরের বাইরে যেয়ে জ্ঞান নিতে হবে। পড়াশোন জানতে হবে এবং পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে অবদান রাখতে হবে।  

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার মূল্যবান সময় দেওয়া জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এবং নারী দিবসের শুভেচ্ছা রইল।

নাজনীন আহমেদ: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

আর                                                                      


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি