‘অক্টোবরে তফসিল, ডিসেম্বরে নির্বাচন, জানুয়ারিতে নতুন সরকার’
প্রকাশিত : ১৬:০৩, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

অক্টোবরের দিকে তফসিল ঘোষণা, ডিসেম্বরে নির্বাচন এবং জানুয়ারির মধ্যে নতুন সরকার গঠন হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ-পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দেশের একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা জানান।
সাক্ষাতকারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, পোশাক শ্রমিকদের পরিস্থিতি, নির্বাচন ও বর্তমানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।
দেশ এখন কোন দিকে যাচ্ছে?, এমন এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকারের সব কাজে একজন উপদেষ্টার সম্পৃক্ততা থাকে না। আমি যদি এই প্রশ্নের মূল বিষয় বুঝে থাকি, তাহলে বলতে পারি, নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তারা কাজ করছে। আমি যদি খুব ভুল না করে থাকি, তাহলে অক্টোবরের দিকে তফসিল ঘোষণা, ডিসেম্বরে নির্বাচন এবং জানুয়ারির মধ্যে নতুন সরকার গঠন হতে পারে—এমন সংকেত পাচ্ছি।
এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, জরুরি সংস্কার শেষে নির্বাচনে যেতে চাইলে এ বছরের শেষের দিকে এবং বিস্তৃত সংস্কার চাইলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন এসেছে। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। আমরা মনে করি, সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কার টিকবে না।
তিনি আরও বলেন, আমি যা বলছি, এগুলো সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত। প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া টাইমলাইন অনুযায়ী ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, কিছু বিষয়ে মৌলিক সিদ্ধান্তে না এসে নির্বাচনে যাওয়া উচিত নয়। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ের মধ্যে সেটা সম্ভব।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার চালিয়ে নেবে। এটা আশাব্যঞ্জক বলে মনে করি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি যখন এ ধরণের বক্তব্য রাখেন, তখন আশ্বস্ত হওয়ার মতো কারণ আছে।
তবে, অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না থাকায় অনেকের মধ্যে সংশয় কাজ করে। কারণ, রাজনৈতিক দলে একজন নেতাই সব নন। তার দলে আরও অনেকে আছেন। এর বাইরে অন্যান্য দলও সংসদে যাবে। তারা কী চাইবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
আস্থা ফেরানোর আলাদা কোনো ফর্মুলা নেই। যারা দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের বুঝতে হবে কাদের সঙ্গে কথা বললে হবে, কাদেরকে চায়ের দাওয়াত দিতে হবে।
বাংলাদেশে নির্বাচন কি নির্বাচন কমিশন করে নাকি সরকার, এমন এক প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পৃথিবীর কোথাও নির্বাচন কমিশন একা নির্বাচন করতে পারে না। ছয়-সাত লাখ মানুষকে কাজ করতে হয়। পুলিশ, প্রিসাইডিং অফিসারসহ বেশিরভাগ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে হয়। এতে দোষের কিছু নেই। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী।
যেমন, গত তিনটি নির্বাচনে সরকার চেয়েছে তাকে জিততে হবে, পরে অন্য কিছু। এটা করতে গিয়ে তারা প্রথমবার বিরোধীদল ছাড়া নির্বাচন করলো, দ্বিতীয়বার রাতের নির্বাচন করলো এবং তৃতীয়বার ডামি নির্বাচন করলো।
পৃথিবীতে এমন মডেলে নির্বাচন আর কোথাও দেখা যায়নি। এমনকি আমাদের দেশে এরশাদের আমলেও এমন ঘটনা ঘটেনি। জেলা প্রশাসকরা বেছে বেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের লোকজনকে প্রিসাইডিং অফিসার বানিয়েছিল।
আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা? মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে কিনা? জানতে চাইলে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এখনো আসেনি। নির্বাচন কমিশনের উপরের দিকে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন নিয়ে গত এক দশকের বেশি সময়ে হওয়া অনিয়মের বিষয়ে মানুষের আস্থা রাতারাতি ফেরানো সম্ভব নয়। তাই অনাস্থার জায়গাটা এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করি। মানুষের আস্থা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচন কমিশনকে বলবো, এটা কোনো আমলাতান্ত্রিক দায়িত্ব নয়। এটা অনেক কঠিন দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের আপনাদের ওপর বিশ্বাস থাকতে হবে। যেমন: আমরা (যখন নির্বাচন কমিশনার ছিলাম) খারাপ-ভালো যাই করি, আমাদের ওপর মানুষের একটা বিশ্বাস ছিল।
নির্বাচনে কমিশনকে সরকারের সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের সরকার থেকে এরই মধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ফেরাতে হবে। আমরা যখন দায়িত্ব পালন করেছি তখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি।
নির্বাচন কমিশন কীভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এর আলাদা কোনো ফর্মুলা নেই। যারা দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের বুঝতে হবে কাদের সঙ্গে কথা বললে হবে, কাদেরকে চায়ের দাওয়াত দিতে হবে। নিজেদের মতো কাজ করতে হবে।
কারখানা বন্ধ, শ্রমিক বেকার প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকার কোনো কারখানা বন্ধ করেনি। কারখানা বন্ধ হচ্ছে, কারণ এসব কোম্পানি ব্যাংক ঋণ নিয়ে সাব-কন্ট্রাক্টে চলছিল। এখন ব্যাংক আর ঋণ দিচ্ছে না, কারখানাও চলতে পারছে না। ব্যাংক কোথা থেকে ঋণ দেবে? কোম্পানিগুলো তো ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।
বেক্সিমকোতে ২৭ হাজার শ্রমিকের হিসাব আমরা পেয়েছি। কিন্তু বেক্সিমকো যেসব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১৬টির হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ এসব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে, শ্রমিক দেখানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে হদিস নেই।
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বেক্সিমকো ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এটা ভাবা যায়? অন্যান্য ব্যাংক মিলিয়ে বেক্সিমকো মোট ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব টাকা নিয়ে কী করেছে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গত সরকারের আমলে এত এত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কেউ টাকা দেশে আনেনি। রাষ্ট্রের অবস্থা বুঝতেই তিন মাস লেগেছে। ব্যাংকগুলো লুট করা হয়েছে, রিজার্ভের অবস্থা ছিল শোচনীয়, অর্থনীতি নিয়ে সরকার অসম্ভব চ্যালেঞ্জে ছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বলতে কিছুই ছিল না, তারপরও অল্প সময়ের মধ্যে অসাধারণ উন্নতি হয়েছে।
সরকারের ছয় মাসকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে রাষ্ট্রটা ব্যর্থ হয়ে যায়নি, রাষ্ট্র ফাংশন করছে। যদিও পরিস্থিতি আরও ভালো হলে খুশি হতাম। এর জন্য সবচেয়ে বড় ক্রেডিট হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের।
একটি লিডারলেস আন্দোলনের পর কী হয় তার উদাহরণ ইরাক, লিবিয়াতে আমরা দেখছি। বাংলাদেশে একটি সরকার হঠাৎ হওয়া আন্দোলনে সব ছেড়ে পালিয়েছে। জাতীয় সংসদে বিরোধী দল পর্যন্ত নেই যারা হাল ধরবে। ঠিক তখন আমাদের সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। অনেকে চেয়েছে দেশটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ুক, এখনো অনেকে চাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে।
এই সরকার নিয়ে ভবিষ্যতে মানুষ কীভাবে মূল্যায়ন করবে বলে মনে করেন? এর উত্তরে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিদায়ের পর গালিও খাবো, ভালো কথাও শুনবো।
এসএস//
আরও পড়ুন