অনলাইনে ক্লাস: শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা কি পূরণ হচ্ছে?
প্রকাশিত : ১৯:৫৯, ১২ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২০:০৬, ১২ জুলাই ২০২০
মহামারি করোনায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতির কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইনে ক্লাস নিতে নির্দেশনা জারি করে।
ফলে দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস পর দেশের প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু হয়েছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। তবে, উপকরণের স্বল্পতা, নির্দিষ্ট নীতিমালা ও শিক্ষকদের অনেকটা কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুরু হয় এ কার্যক্রম। যা নিয়ে রয়েছে শিক্ষার্থীদের বিস্তর অভিযোগ। বিশেষ করে ডিভাইস ও মানসম্মত ইন্টারেন্ট সুবিধা না পাওয়ায় ক্লাস নিয়ে পড়ছেন নানা বিপাকে।
এপ্রিলের শেষ দিকে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়ার অনুমতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমন সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়ে ইউজিসি জানায়, অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার সক্ষমতা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই রয়েছে। এরপরই একে একে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু হয় অনলাইন ক্লাস। যা দেশের ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬টি বেসরকারি ও ৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
গত জুন থেকে অনলাইনে ক্লাস চালু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগে। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও আজ থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিকে ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিতি থাকলেও, ক্রমান্বয়ে তা কমছে। ফলে, শিক্ষার্থীদের মাঝে তা নিয়ে রয়েছে অস্থিরতা ও হতাশা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ক্লাস চালু হয়েছে গত জুন মাসে। যেখানে ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। কারণ হিসেবে স্মার্টফোন না থাকা, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও সাময়িক আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণকে দেখা হচ্ছে।
এই বিভাগেরই শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন। করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে অবস্থান করছেন। অনলাইনে ক্লাস শুরু হলে মহা বিপাকে পড়তে হয় তাকে। কারণ একটাই, ইন্টারনেটের গতি অত্যন্ত দুর্বল।
এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি কয়েকটা ক্লাস করেছি। কিন্তু নেটের গতি এতটাই দুর্বল যে স্যারের কথা ঠিকমতো শোনা যায় না। আবার মাঝপথে কেটে যায়। এতে খুবই খারাপ লাগে। উপায় না দেখে বাড়ির পাশে ফাঁকা মাঠে কিংবা গাছে উঠে ক্লাস করতে হচ্ছে।’
এছাড়া আছে খরচ। আগের চেয়ে বর্তমানে বিভিন্ন অপারেটরের দাম বেড়েছে। ফলে, এভাবে চললে মাসে হাজার টাকা যাবে ক্লাস করতে, বলেন জোবায়েদ।
এদিকে প্রায় একই অবস্থা জগন্নাথ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস-এর ২০১৯ সালের এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশে মাত্র ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ গৃহস্থলির ইন্টারনেট একসেস আছে। আর কম্পিউটার আছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশের বাড়িতে। চলতি বছর এসে খুব যে বেশি বেড়েছে তা নয়। বরং, করোনা সংকটে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মার্কেট বন্ধ থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
অন্যদিকে, গত মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর উপর একটি জরিপ চালায়। যেখানে বলা হয়, ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন রয়েছে।
কিন্তু যাদের ম্মার্টফোন নেই কিংবা থাকলেও নেটওয়ার্কের দুর্বলতা বা ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করার মতো অবস্থা নেই, তারা ক্লাস করতে না পারায় পিছিয়ে পড়বে বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষার্থীরা। আবার স্মার্টফোন থাকলেও ক্লাসে ভালভাবে অংশ নিতে পারবে না। কারণ অংকের মতো জটিল বিষয়গুলোর সমাধান করতে বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
এর ফলে অনলাইন ক্লাস নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল তা থেকে অনেকটাই দূরে। উল্টো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কিছু শিক্ষার্থী।
এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমি ক্লাস নেয়া শুরু করেছি। তবে শুরুতেই শিক্ষার্থীদের সমস্যা কিছুটা দেখতে পেয়েছি। এখনও শতভাগ মূল্যায়নের সময় আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘অনলাইন ক্লাস নেয়ার জন্য ইউজিসি ও বিশ্বিবিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে, বাস্তবতা বলছে আমাদের কাঠামোগত আরও অনেক উন্নতি দরকার। আমরা যদি সত্যিই প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতাম, তাহলে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস নিয়েই আলাদা একটি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রথম ক্লাসেই ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে আমার এক শিক্ষার্থীকে খোলা মাঠে গিয়ে ক্লাস করতে হয়েছে। সামনে হয়তো আরও সংকটে পড়তে হতে পারে। সব শিক্ষার্থীকে এ প্লাটফর্মে আনতে না পারলে তাদের সঙ্গে অনেকটা বৈষম্য করা হবে। সরকারের উচিত, এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া।’
দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে শুরু দিকে মনে করা হয়েছিল, গরম শেষ হলে নিয়ন্ত্রণে আসবে ভাইরাসটি। ফলে সেদিক বিবেচনা করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, সময় যত গড়িয়েছে অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়েছে। ফলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকল শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার। যা কবে খুলবে এখনও অজানা সবার।
এ কথাও সত্য যে আমাদের শিক্ষার্থীরা চলমান করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কিত। নিজেরাও বুঝতে পারছেন যে, করোনা সংকটকালে অনলাইন ক্লাসের বিকল্প আপাতত নেই।
তবে, ইউজিসির পরামর্শে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে অনলাইন ক্লাসে যেতে না রাজি হয়। এর কারণ সবারই জানা।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের সামাজিক বাস্তবতা অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর সাথে মেলালে চলবে না। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা বেশ। আমাদের দেশে অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। মুখে ফোরজির কথা বলা হলেও সেখানে টুজির একটু বেশি গতি সম্পন্ন আমাদের ইন্টারনেট।
অপরদিকে, আছে অপারেটর কোম্পানিগুলোর উচ্চ রেট। ফলে সবকিছু থমকে যাওয়া অবস্থায় চাহিদা শতভাগ পূরণ করা সত্যিই সরকারের পক্ষে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে এটিও সত্য, কাঙ্খিত না হলেও দেশ পূর্বের তুলনায় ডিজিটাল উন্নয়নে এগিয়েছে অনেক ধাপ। তবে, এমন একটি মহামারির জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও তেমন পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারেনি। তা করা গেলে চলমান সংকটাবস্থা থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসা যেত।
অন্যদিকে বৈশ্বিক এই ভাইরাসে গোটা বিশ্বই এখন আর্থিক ক্ষতির চরম দিন পার করছে। বাংলাদেশও তার বাহিরে নয়। এমন বাস্তবতায় তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জন্য হঠাৎ এই আমূল পরিবর্তন আনা কতখানি বহনযোগ্য, তা নিয়ে ভাববার রয়েছে অনেক কিছু।
তবে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরির কমিশন যদি অপারেটরদের সঙ্গে চলমান সংকটাবস্থার জন্য সাশ্রয়ী সেবাদানের একটি চুক্তি করতে সম্মত হতে পারে, তাহলে অনেকাংশে প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব। পাশাপাশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ প্রণোদনা তথা সাহায্যের মাধ্যমে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য এগিয়ে আসা যেতে পারে। এতে বৈষম্য দূর করে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আনা সহজ হবে।
এসি