ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

অন্নছত্র, ক্ষুধার রাজ্যে সত্যিকারের পূর্ণিমার চাঁদ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৫৫, ২৭ জুলাই ২০১৭ | আপডেট: ১১:৫৫, ৩০ জুলাই ২০১৭

কংক্রিটের এ শহরের নিত্য ব্যস্ততায় পাশের ফ্লাটের খোঁজ না রাখাটাই স্বাভাবিক। সেখানে প্রতিদিন বিনামূল্যে খাবার দিবাস্বপ্ন। তবে এ স্বপ্ন ঢাকায় বাস্তব। শত শত মানুষ দুপুর বেলা পেটপুরে বিনামূল্যে খাবার পান। এখানে ধর্ম-জাত-পাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। ক্ষুর্ধাত অবস্থায় যিনি আসবেন, তিনিই খেতে পাবেন।

রাজধানী ঢাকার ১০৯ নবাবপুর রোডে নিয়মিতভাবে নীরবে, নিভৃতে আর্তমানবতার এই সেবা করে যাচ্ছে অন্নছত্র ট্রাস্ট। ক্ষুধার্তরা পেটে দেওয়ার মতো অন্ন পাবেন, নিরাশ্রয়ীরা পাবেন আশ্রয় - এই ভাবনা থেকেই পুরান ঢাকার এক জনদরদি মানুষ মদনমোহন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ ট্রাস্ট। মদনমোহন পাল আজ আর নেই। তবে তাঁর উত্তরসূরিরা এখনও সযত্নে আগলে রেখেছে ট্রাস্টটি। ক্ষুধার্ত কেউ হাজির হলে তার মুখে তারা সাধ্যমতো খাবার তুলে দেন।

প্রতিদিনই দুই থেকে আড়াইশো মানুষের জন্য রান্না হয় খাবার। এমনকি বিশেষ দিনে থাকে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও। গত ৯৩ বছর ধরে নিয়মটি পালন করছে তারা। কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক ক্ষুধার্ত মানুষ কোনো দিন হাজির না হলে ট্রাস্টের লোকজন আশপাশের এলাকা ঘুরে অভুক্ত মানুষ খুঁজে বের করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এক দিনের জন্যও অন্নছত্র স্ট্রাস্টের এ মহতী কাজ বন্ধ থাকেনি।

ট্রাস্টের ব্যবস্থাপক পরিমল ভট্টাচার্য জানান, অনেক সময় আর্থিক কারণে তারা অভুক্ত থেকেছেন। কিন্তু কখনও অনাহারীদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কাজ বন্ধ করেননি। এ জন্য তারা সরকার কিংবা সমাজ থেকে এক পয়সাও অনুদান গ্রহণ করেন না।

ট্রাস্টের শুরুর গল্পটা জানা গেল ব্যবস্থাপক পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি জানান, ১৯২৪ সালে ঢাকায় দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ খাদ্যাভাব। স্থানীয়দের কষ্ট দেখে মর্মাহত হন নবাবপুরের জমিদার মদনমোহন পালের তিন ছেলে রজনীকান্ত, মুরলীমোহন আর প্রিয়নাথ। ক্ষুধার্তদের বিনামূল্যে খাবার দিতে বাবার নামে খুলেন একটি অন্নছত্র।

১২৫ জন নিয়ে শুরু হলেও এখন দুই থেকে আড়াইশ লোকের জন্য খাবার রান্না হয়। তালিকায় নেই আহামরি কোনো পদের খাবার। কিন্তু ক্ষুধার রাজ্যে এই ডাল-ভাতই বা মেলে কোথায়?

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একেবারে বিনামূল্যে পেটপুরে খাওয়ানোর এ আয়োজনে সামিল হতে পারেন যে কেউ। নেই জাত, ধর্ম, শ্রেণি-লিঙ্গের ভেদাভেদ। এমন অনেকে আছেন ২০ বছর ধরে যাদের একমাত্র সম্বল এই অন্নছত্র।

জমিদারির নয়টি বাড়ি তারা দান করেন ট্রাস্টের নামে। সেই নয়টি বাড়ি এখন নয়টি মার্কেট। মার্কেটের দোকান ভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে মেটানো হয় খাবারের সব খরচ।

মাসের দুই একাদশী (চাঁদের একাদশ দিন) আর জন্মাষ্টমী বাদে সারা বছর বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত এখানে খাবার বিতরণ করা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের পর কেউ এলে তাকেও ফেরানো হয় না।

ট্রাস্টের সেবকেরা বললেন, তখন তারা নিজেদের খাবারটুকু সেই অতিথিকে দিয়ে দেন। আর নিজেরা নতুন করে রেঁধে খান। ট্রাস্টের উইলে বলা আছে, কাউকে ফেরানো হবে না।

অন্নছত্র ট্রাস্টের প্রবীণ কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জমিদারের তিন ছেলেই বাবার আদর্শ মেনে চলতেন। এর মধ্যে প্রিয়নাথ পাল ছিলেন দানবীর ও বিদ্যোৎসাহী। তিনি নবাবপুরে ১৯৩৫ সালে নিজ নামে প্রিয়নাথ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে নবাবপুর সরকারি হাই স্কুল নামে পরিচিত। অন্নছত্র ট্রাস্টির ট্রাস্ট দলিলের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে, মদনমোহন পালের বংশধররা পালাক্রমে ট্রাস্টি অন্তর্ভুক্ত থেকে অন্নছত্র ট্রাস্ট পরিচালনা করবেন। কোনো কারণে কোনো দিন এ বংশের কেউ জীবিত না থাকলে প্রতিবেশী পাল বংশের লোকজনকে ট্রাস্টি হিসেবে নিতে হবে। প্রায় ১০০ বছর ধরে এ নিয়মেই চলছে অন্নছত্র ট্রাস্টের ট্রাস্টি নিয়োগের প্রক্রিয়া। মদনমোহনের তিন ছেলের মৃত্যুর পর তাদেরই বংশধর হীরালাল পাল, নিশিকান্ত পাল, বিজয়কৃষ্ণ পাল ও রাজবল্লভ পাল প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। বর্তমানে প্রাচীন অন্নছত্র ট্রাস্টের ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পাল বংশীয় দীপক কুমার পাল, তপন কুমার পাল ও মিন্টুরঞ্জন পাল। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা পূর্বপুরুষদের এ মহতী উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্ট রাখতে চান।

এ জনহিতকর কাজে নবাবপুরের পাল জমিদার বংশের সদস্যদের পাশাপাশি বাইরের নিবেদিতপ্রাণ অনেক মানুষও বরাবরই জড়িত ছিলেন বা রয়েছেন। তাদেরই একজন সুখরঞ্জন পাল। তিনি জানান, তার বাবা ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় এসে অভুক্ত অবস্থায় অন্নছত্র ট্রাস্টের আশ্রয় পেয়ে আমৃত্যু সেখানে কাটিয়ে গেছেন। সুখরঞ্জনও আমৃত্যু অন্নছত্রের সঙ্গে থাকতে চান। বিশ্বজিৎ গোস্বামী আইসিএমএর মেধাবী ছাত্র। তিনিও অবসর সময়ে অন্নছত্র ট্রাস্টের হয়ে কাজ করছেন শুধু মনের টানে।

ট্রাস্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঢাকায় জনসংখ্যার সঙ্গে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই প্রতিদিনই বহু মানুষ পেটের তাগিদে অন্নছত্রে আসে। কিন্তু ট্রাস্টের আয় সীমিত বলে ব্যয় সংকুলানে এখন সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া ট্রাস্টের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেছে বলেও জানান তারা। যেসব দোকান কিংবা মার্কেট রয়েছে, তা থেকেও ঠিকমতো ভাড়া তোলা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ভাড়াটিয়া পুরনো আমলের নিয়মে ভাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শত বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি জনহিতকর কাজ করে গেলেও কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি। নিজস্ব আয় থেকেই ট্রাস্টের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

 

এলএম/ডব্লিউএন

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি