‘অর্ধেক উপন্যাস’-এর সংক্ষিপ্ত কাহিনি
প্রকাশিত : ২২:২৭, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সিরিয়াল কিলিংয়ের ইতিহাসে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা পৃথিবীর সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে টেড বান্ডি হচ্ছে আকর্ষণীয় চেহারার লোমহর্ষক ও নৃশংস এক হন্তারক। বাক পটু, স্মার্ট, ও মেধাবী টেড বান্ডি কখনো প্লাস্টার করা বাম হাত ঘাড়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে, কখনো ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে পার্কে বা নির্জন জায়গায় গিয়ে সুন্দরী তরুণীদের সাহায্য চাইত। তারপর তার ভকসওয়াগেন বিটল গাড়িতে করে তাদের নিয়ে যেত জনমানব শূন্য কোন অরণ্যে বা পাহাড়ে, তারপর শুরু হত তার নিষ্ঠুর পৈশাচিকতা। টেড বান্ডি সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে বিকৃত যৌন কর্মকান্ডে লিপ্ত হত। এরপর কাউকে লোহার বার দিয়ে পিটিয়ে, কাউকে গলায় ফাঁস দিয়ে, কাউকে গাড়ির তলায় পিষ্ট করে হত্যা করত। দু’টি মামলায় তাকে তিনদফা মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়।
১৯৮৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ফ্লেরিডা স্টেট জেলাখানায় ইলেকট্রিক চেয়ারে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে টেড বান্ডি ৩০ জন তরুণীকে ধর্ষণ, ও হত্যার কথা স্বীকার করে। তবে অনেকেই মনে করেন যে, টেড বান্ডি ১০০ থেকে ৩০০ জন তরুণীকে হত্যা করেছিল। তার বিচারটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম টেলিভাইজড প্রসিকিউশন। টেড বান্ডির জীবন, প্রেম, সিরিয়াল কিলিং, আত্ম-পূজারি, খন্ডিত-সত্ত্বা ও সমাজ বিরোধী ব্যক্তিত্ব নিয়ে অনেক নাটক, সিরিয়াল, চলচ্চিত্র, এবং ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে। ্ ব্যাপারে Netflix-এর ডকুসিরিজ- Netflix-Gi WKzwmwiR - “Conversations with a Killer: The Ted Bundy Tapes,” এবং “Extremely Wicked, Shockingly Evil and Vile” শিরোনামের চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। তার মৃত্যুর পরে প্রায় ৩৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখনও তার জীবন, প্রেম, তরুণীদর বলাৎকার ও নৃশংস হত্যাকান্ড, ও তার কারণ নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক, অপরাধবিজ্ঞানী, ও সমাজতাত্ত্বিকরা গবেষণা করেন। সৃজনশীল লেখক ও চলচ্চিত্রকাররাও টেড বান্ডিকে নিয়ে থ্রিলার লেখেন, চলচ্চিত্র তৈরি করেন জীবনের নানা হেঁয়ালি, এবং রহস্যময় প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদে। টেড বান্ডির সিরিয়াল কিলিং, বিকৃত যৌন কর্মকান্ড এবং তরুণীদের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড যে কাউকে বিক্ষুদ্ধ, শংকিত ও প্রচন্ডভাবে আহত করবে। কিন্তু মানবিক পাঠক সংবেদনশীলতা নিয়ে পাঠ করবেন - ‘অজ্ঞাত’ পিতার এক সন্তান কিভাবে এবং কোন কারণে শৈশবে মায়ের কাংখিত মমতা থেকে বঞ্চিত হল? এরপর তার কপালে জুটল প্রিয়তমা প্রেমিকার প্রত্যাখ্যান, যার হাত ধরে সে অর্থপূর্ণ একটি মানবিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। পরিণতিতে তার মনের গভীরে সুপ্ত ভাইরাসগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল, এবং ব্যক্তিত্বের ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে সে হয়ে উঠল এক ভয়াবহ সিরিয়াল কিলার।
বুদ্ধিমান, স্মার্ট এবং আইনে স্নাতক বহিরঙ্গের টেড বান্ডিকে প্রথম দেখায়ই যে কারো পছন্দ হবে। অসংখ্য সুরূপা, চিত্তহারিণী ও রমনীয়ার সঙ্গে প্রেম করেছে সে, তাদের রূপ ও যৌবন আকন্ঠ পান করেছে। ঊর্বশী তরুণীরাও চারুদর্শন ও সুপুরুষ টেড বান্ডির সঙ্গ উপভোগ করেছে মুগ্ধ ভ্রমরের মত। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন এ্যামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, ওয়াশিংটনসহ সাতটি স্টেটে একের পর এক তরুণী উধাও হতে শুরু করল। পুলিশ টেড বান্ডিকে গ্রেপ্তার করল। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য তরুণীকে বলাৎকার ও হত্যার অভিযোগ আনা হল। কিন্তু টেড বান্ডির দাবি, সে নির্দোষ। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে দু’টি মামলায় তাকে তিন দফা মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হল। কারাবন্দি অবস্থায়ও টেড বান্ডি বিয়ে করেছে, পাশাপাশি এক মহিলা আইনজীবীর সঙ্গে প্রেম করেছে, আবার কারাগারের বাইরেও অনেক নারী তার প্রতি রমনীয় আকর্ষণ অনুভব করেছে।
১৯৮৯ সালের ২৪ জানুয়ারি বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে টেড বান্ডি ৩০ জন তরুণীকে ধর্ষণ এবং হত্যার কথা স্বীকার করে। তবে অনকের ধারণা, টেড এক শ’র অধিক তরুণীকে হত্যা করেছে। টেড বান্ডির সিরিয়াল কিলিং নিয়ে অনেক গ্রন্থ, চলচ্চিত্র, ও প্রামাণ্য চিত্র রচিত ও নির্মিত হয়েছে। এ উপন্যাসে লেখক টেড বান্ডির রোমহর্ষক বলাৎকার ও সিরিয়াল কিলিংয়ের পুরো বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। তবে টেড বান্ডি কেন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের কক্ষপথ থেকে ছিটকে গেল হিংস্র অন্ধকার ও বিকৃত যৌনতার অতলান্ত গহ্বরে ? মা-বাবার সহজাত ভালোবাসা এবং কয়েক ফোটা বৃষ্টির মত একটু প্রেম পেলে টেড বান্ডি হয়ত সুস্থ-স্বাভাবিক একজন মানুষ হতে পারত। এ উপন্যাসে টেড বান্ডির সিরিয়াল কিলিং, রিরংসা ও তরুণী হত্যাকান্ডের চেয়ে অধিকতর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে সেই প্রক্রিয়ার ওপর যার মধ্য দিয়ে টেড বান্ডি সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ থেকে এক ভয়ংকর সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়েছে। বিষয়টির মনস্তাত্তি¡ক, সামাজিক, অপরাধতাত্ত্বিক ও মানবিক বাস্তবতা এবং তার পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ব্যবচ্ছেদের চেষ্টা হয়েছে। ফলে, এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে একজন সম্ভাবনাময় মানুষের মানবিক আখ্যান, তার প্রেম, প্রেমের বিয়োগান্ত সমাপ্তি, পরিণতিতে ব্যক্তিত্বের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তার সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার গল্প। উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে টেড বান্ডির ‘স্যাডিস্টিক ও নারসিসিস্টিক পার্সোনালিটি’র নিষ্ঠুরতা। তার খন্ডিত ব্যক্তিত্বও বিশ্লেষিত হয়েছে কখনো নির্মোহভাবে, কখনো মানবিক সহমর্মিতা নিয়ে।
লেখক সম্পর্কিত
লেখক গবেষণা, কলাম লেখা, প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনাসহ সৃজনশীল লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে তিনি আইনের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ-এর পরিচালকের পদে দায়িত্বরত। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি অপরাধবিজ্ঞান পড়ছেন, পড়াচ্ছেন, এবং সহিংসতা, কিশোর অপরাধ, বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তন, সামরিক শাসন, সাংবিধানিকতাসহ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। বিভিন্ন জনবিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, প্রশাসন একাডেমি, পুলিশ স্টাফ কলেজ ও ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলে তিনি মানবাধিকার, সংবিধান, ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা ও অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান করেন। যশোর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিকের পড়াশুনা শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি সুইজারল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড ট্রেড ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স অব ইন্টারন্যাশনাল ল’ এ্যান্ড ইকোনোমিকস বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন।
ঢাকায় জন্ম হলেও তাঁর বাবার বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, এবং মায়ের বাড়ি খুলনা জেলার কুশলা গ্রামে। মধুমতি নদীর এপার এবং ওপারে দাদা ও নানাবাড়ি হওয়াতে গ্রামবাংলার সবুজ অরণ্য, খাল-বিল, ও ফসলের বৈচিত্র্যের প্রতি তাঁর রয়েছে সহজাত ভালো লাগা। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘টেক্সটবুক অন ক্রিমিনোলজি’ গ্রন্থটি। ২০২৩ সালে পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত হয় লেখকের ‘নন্দিত শৈশব এবং বাংলাদেশের কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচার’ গ্রন্থটি। লেখক এ গ্রন্থে শৈশব ও কৈশোরের গুরুত্ব, এবং বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর কিশোর গ্যাংয়ের প্রভাবকে বিশ্লেষণ করেছেন প্রামাণিক উপাত্ত এবং যশস্বী মানুষের শৈশবের গল্প বলার মধ্য দিয়ে। এ গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে।