অ্যান্টিভেনম কেন জরুরি এবং কতটা সহজলভ্য?
প্রকাশিত : ১৬:০৩, ২২ জুলাই ২০২৩ | আপডেট: ১৬:০৬, ২২ জুলাই ২০২৩
বাংলাদেশে বর্ষাকাল এলেই গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয় হয়ে ওঠে সাপের দংশন। বিষধর সাপের দংশনে হরহামেশাই মানুষের মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় চার লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়, যার ফলে সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়।
যে কোনো বিষধর সাপ কাটার পর অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ জরুরি হয়ে যায়। অন্যথায় রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। রোগীর শরীরে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ সবচেয়ে জরুরি হলেও বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে এখনও অত্যাবশ্যকীয় এই ওষুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই।
অ্যান্টিভেনম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় এসেনশিয়াল ড্রাগ বা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত হলেও বাংলাদেশে সাপের কামড়ের বিষয়টি এখনও অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা।বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর বা বিষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন উপাদানকে অ্যান্টিভেনম বলা হয় ।
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ মে, জুন এবং জুলাই -এই তিন মাস সাপের কামড় এবং তার কারণে মৃত্যুর ঘটনা বেশি দেখা যায়।
কেননা অতি বৃষ্টিপাতের কারণে সাপের আবাসস্থল বা গর্তগুলো ডুবে যায়। তখন সেগুলো উঁচু জায়গায়, অনেক সময় মানুষের বসতবাড়ির আশেপাশে বিচরণ করে। তাই একটু অসাবধানে থাকলেই সাপে কাটার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
অ্যান্টিভেনম কখন প্রয়োজন?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি এম এ ফয়েজ সাপের দংশন ও এর চিকিৎসা নিয়ে বই লিখেছেন।
সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘন্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘন্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি।
সাপের কামড় বা দংশনের পরে, দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলি বিষকে নিষ্ক্রিয় করে । যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁচে যায় ।
সাপ কামড়ানোর পর একজন রোগীকে ১০টি করে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে হয়। ১০টি ভায়াল মিলে একটি ডোজ হয়ে থাকে।
বিষের পরিমাণ এবং বিষাক্ততার মাত্রা বেশী হলে সাপে কামড়ানো ব্যক্তির উপর এক বা একাধিক ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে।
বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে যে অ্যান্টিভেনম আনা হয়, সেটি মূলত চারটি সাপের বিষের একটি 'ককটেল' বা মিশ্রণ, যা কিছু সাপের দংশন নিরাময়ে কাজ করে। বাকি ক্ষেত্রে সেগুলো আংশিক কাজ করে।
অনেক সময় সাপের কামড়ের ধরণ দেখে, আবার রক্ত পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন যে এটি বিষাক্ত সাপে কামড়েছে নাকি বিষহীন সাপে কামড়।
বাংলাদেশে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম নেই
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেকে বিষধর সাপের কামড় খেয়ে মারা যান শুধুমাত্র সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া বিশেষ করে হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম না থাকার কারণে।
এ বিষয়ে মি. ফয়েজ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এর বড় কারণ বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে কোনও অ্যান্টিভেনম তৈরি হয় না। দেশে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় এখন যেসব অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয় তা ভারত থেকে আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, সাপের কামড়ের রোগীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়।
অন্য দেশের অ্যান্টিভেনম এই দেশে শতভাগ কার্যকর নাও হতে পারে। কারণ, একেক দেশের সাপের প্রকৃতি একেক রকম।
ভারতে যেসব সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর পুরোপুরি বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে না। অথচ বছরের পর বছর ধরে ভারতের অ্যান্টিভেনম দিয়েই বাংলাদেশের সাপের কামড়ের রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিভেনমকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বললেও বাংলাদেশে এখনও নিজেদের সাপের বিষের অ্যান্টিভেনম বানাতে পারাকে ব্যর্থতা বলছেন মি. ফয়েজ।
এ ব্যাপারে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর মুনাফা কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাকে দায়ী করছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন বলেন, “বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো এতো ওষুধ তৈরি করে, কিন্তু তারা অ্যান্টিভেনম বানায় না। কারণ এখানে লাভ কম। সাপে কাটে গরিব মানুষদের।”
অ্যান্টিভেনম প্রয়োগে ভয়?
সরকারি নিয়মে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার সিভিল সার্জনদের তাদের চাহিদার বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানানোর কথা। সেই চাহিদার ভিত্তিতে জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সেখান থেকে উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুযায়ী অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করার কথা।
এসব হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের বিনামূল্যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দেয়ার কথা।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় সরকারিভাবে অ্যান্টিভেনমের যথেষ্ট সরবরাহ নেই। যেগুলো আছে সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। আবার মেয়াদ সম্পন্ন অ্যান্টিভেনম থাকা সত্ত্বেও অনেক চিকিৎসক দিতে সাহস পান না।
বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরা নিরাপত্তাজনিত কারণে অ্যান্টিভেনম প্রদানে অনেক সময় বিরত থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের ১০ থেকে ৬০ মিনিট পরে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, কাশি, চুলকানি, লাল লাল চাক খাওয়া, জ্বর আসা, বুক ধরফর করা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, মাথাব্যথা। এছাড়া মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে রক্তচাপ কমে যাওয়া শ্বাসকষ্ট হওয়া শ্বাসনালী ফুলে যাওয়া।
আবার সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে অ্যান্টিভেনম না পেয়ে অনেক রোগীকে হাসপাতালের বাইরে থেকে চড়া দামে কিনতে হয়।
সরকারিভাবেই সরকার ভারত থেকে ১০ ভায়ালের এক ডোজ অ্যান্টিভেনম ১৪ হাজার টাকায় কেনে। সেটি রোগীরা বাইরে থেকে কিনতে গেলে আরও বেশি দাম পড়ে। যা সাপে কাটা অনেক রোগীর পক্ষেই বহন করা সম্ভব না।
অধ্যাপক ফয়েজ বলেন, অ্যান্টিভেনম তৈরির জন্য একটি ফিজিবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট করা প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশের কোথায় কোথায় কী পরিমাণ অ্যান্টিভেনম লাগবে। কী পরিমাণ তৈরি করতে হবে। এগুলো কিভাবে সরবরাহ করা হবে।
তিনি বলেন, “বছরে যদি ১০ হাজার রোগী বিষাক্ত সাপে কাটা নিয়ে হাসপাতালে আসে। তাহলে তাদের চিকিৎসায় এক লাখ ভায়ালের প্রয়োজন। এর বেশিও প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু এর অর্ধেকেরও কম পরিমাণ কিনেও সেগুলো ব্যবহার করতে পারেনি হাসপাতালগুলো।"
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে হাসপাতালগুলোর কাছে তথ্য চাওয়া হলেও তারা কোন তথ্য না দেয়ায় সরবরাহ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান অধিদফতরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন।
মি. আমিন জানান, তারা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর কাছে গত বছর লিখিতভাবে তাদের অ্যান্টিভেনমের চাহিদার বিষয়টি জানাতে বলেছেন যে কাদের কতোটুকু লাগবে। কিন্তু তাদের কোন সাড়া মেলেনি।
সব চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া সত্ত্বেও অনেকে এসব রোগী কিভাবে সামলাবেন সেই ভয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে চাহিদার কথা জানান না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
"আমরা তাগাদা দিচ্ছি, তদন্ত করছি, তাও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।" বলেন তিনি।
মি. আমিন বলেন“আবার অনেক হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ব্যবহার না করায় মেয়াদ চলে গিয়েছে। সাপে কাটা রোগী গেলে অ্যান্টিভেনম থাকা সত্ত্বেও তারা রোগীদের অন্য হাসপাতালে যেতে বলছে।”
সাপে কাটলে মৃত্যু অনিবার্য?
বাংলাদেশে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা আছে যে সাপে কাটলেই মৃত্যু হবে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে প্রায় ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ, বাকিগুলো স্থল সাপ।
এসব সাপের অধিকাংশই নির্বিষ। শুধুমাত্র বিষধর সাপের কামড়েই মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। নির্বিষ সাপের কামড়ে তেমন কোন ঝুঁকি নেই।
বাংলাদেশে ছয় থেকে আট প্রজাতির সাপ অত্যন্ত বিষধর বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি এম এ ফয়েজ।
এই বিষধর সাপগুলো চারটি ধরণের হয়ে থাকে, কোবরা বা গোখরো/শঙ্খচূড়, ক্রেইট বা কেউটে/বাংগারাস, রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া/উলুবোড়া এবং গ্রিন ভাইপার বা সবুজ বোড়া/গাল টাউয়া/পিট ভাইপার।
গবেষকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে সকাল ও সন্ধ্যায় সাপে বেশি ছোবল দেয়। শীতকালে গোখরো সাপের দংশনের ঘটনা ঘটে।
মূলত তিনভাবে এসব সাপের বিষ মানবদেহে প্রভাব ফেলে। হেমোটক্সিন রক্তকে সংক্রমণ করে। এতে কাটা জায়গায় রক্ত জমাট বাধে না, ফলে প্রবল রক্তক্ষরণ হয়।
মায়োটক্সিন বা মাংসপেশিকে অকার্যকর করে দেয়। এতে মাংসপেশির দ্রুত সংকোচনে গায়ে ব্যথা হতে থাকে এবং অসাড় হয়ে যায়। শ্বাসতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে যেসব মাংসপেশি, সেগুলো ঠিকমত কাজ না করায় মানুষের দমবন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়।
এছাড়া নিউরোটক্সিন মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়।
আবার কোন কোন সাপের বিষে শিরার ভেতর রক্ত জমাট বেধে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রাণ হারায়। কখনও বিষক্রিয়া আবার শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সেসব অঙ্গ বিকল করে দেয়।
আর কিছু কিছু বিষ যেখানে সাপে কেটেছে সেই স্থান ও আশপাশের কোষগুলোকে পুরো মেরে ফেলে। তখন মৃত কোষের কারণে পচে যাওয়া সেই সব প্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিতে হয়।
কোন একটা সাপের শরীরে ভিন্ন মাত্রায় কয়েকশ ধরনের বিষের সংমিশ্রণ থাকে। ফলে সেইসব সাপ কামড়ালে একই সাথে নানাধরনের বিষক্রিয়া ঘটতে থাকে। যে কারণে সাপের দংশনের চিকিৎসা খুব সহজ নয় বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
এক্ষেত্রে সাপের কামড়ের পর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রোগীকে সাপে কাটার সাথে সাথে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া এবং সেই হাসপাতালে যদি সংশ্লিষ্ট সাপের বিষের অ্যান্টিভেনম থাকে – তাহলে যত দ্রুত সম্ভব সাপে কামড়ানোর ওষুধ বা অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন মি. ফয়েজ। তাহলেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত আশঙ্কামুক্ত এমনকি মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/