ঢাকা, বুধবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আইসিইউতে রোগী মৃত্যুর বড় কারণ ‘সুপারবাগ’

প্রকাশিত : ১২:৩৩, ২৫ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ১২:৩৫, ২৫ এপ্রিল ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

চিকিৎসকরা বলেছেন, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ-তে থাকা রোগীদের একটি বড় অংশের মৃত্যুর পেছনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দায়ী, যাদেরকে এই ক্ষমতার জন্য ‘সুপারবাগ’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বিবিসিকে জানিয়েছেন, আইসিইউ-তে থাকা রোগীদের বেশীরভাগের শরীরেই সুপারবাগ পাওয়া গেছে।

তিনি বলেন, ‘আইসিইউতে যে সব রোগীরা মারা যাচ্ছেন, তারা এমনিতেই জটিল রোগী, তাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, তাদের আরও অনেক সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি, তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেসিস্ট্যান্স সুপারবাগ পাওয়া গেছে।’

‘হয়তো তাদের মৃত্যুর আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু দেখা গেছে মারা যাওয়া রোগীদের আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়ার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। এ সব আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী, আবার কখনও কখনও সব ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হতে দেখা যায়।’

২০১৮ সালে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ-তে মোট ৯০০ রোগী ভর্তি হয়েছিল, যাদের মধ্যে ৪০০ জন মারা যায়। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ছিল।

তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রোগীরা আসেন, তারা আগেই বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়ে এখানে আসেন। ফলে সেখান থেকেই তারা এ ধরণের ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন বা এখানেও আক্রান্ত হতে পারেন।

অধ্যাপক রহমান বলেন, এ সব রোগীর বেশিরভাগই অন্যান্য হাসপাতাল থেকে এসেছিলেন, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ওইসব আইসিইউ-তে যথেষ্ট তদারকি নেই।

অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেসিস্ট্যান্স (এএমআর) বলতে কী বোঝায়?

অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, যে সব ব্যাকটেরিয়া সাধারণত মানুষের শরীরকে আক্রমণ করে, তারা দীর্ঘদিন ধরে ওষুধের সংস্পর্শে থাকার কারণে ওই সব ওষুধ থেকে বেঁচে যাওয়ার কিছু ক্ষমতা অর্জন করে। এটাকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স।

কেন এটা এতো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?

এ ধরণের ওষুধ প্রতিরোধী সক্ষমতা অর্জন করে যে সব ব্যাকটেরিয়া, তারা সেই ক্ষমতা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে খুবই দ্রুত গতিতে অনেক ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে এই সামর্থ্য তৈরি হয়।

ফলে আর কোনও অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই এই জীবাণুগুলোকে দমন করা যায় না, অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ফলে রোগীকে সুস্থ করে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে।

সুপারবাগ বা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেসিস্ট্যান্স শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, সারা বিশ্বেই এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তবে ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এবং কম নজরদারি থাকায় বাংলাদেশে এই সমস্যাটি দ্রুত গতিতে বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

প্রতিবেশে এই রেসিস্ট্যান্স কিভাবে তৈরি হয়?

আমরা যে সব প্রাণীর মাংস বা শাকসবজি খাই- সেই সব প্রাণীর শরীরে বা সবজির উৎপাদনে যদি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেগুলো রেসিস্ট্যান্স তৈরি করে, যার প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে।

অধ্যাপক রহমান জানান, ‘মানুষের প্রোটিনের জন্য মাছ, মুরগি, গরু দরকার এবং সেগুলোকে সস্তায় বাঁচানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দরকার। অর্থাৎ মানুষকে তার প্রোটিনের জন্যে ভবিষ্যতকে ঝুঁকিগ্রস্ত করা হচ্ছে।’

এছাড়া হাসপাতাল থেকে শুরু করে রেসিস্ট্যান্ট ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, মল-মূত্র থেকেও তা ছড়াতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কিন্তু আইসিইউতে কেন এ রকম ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ?

অধ্যাপক সায়েদুর রহমান এর জন্যে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

‘অসুস্থ হওয়ায় রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, ফলে অন্যান্য সময় তিনি যে সব ব্যাকটেরিয়াকে নিজে সামলাতে পারতেন, তখন সেটা আর তিনি পারেন না।’

‘দ্বিতীয়ত, আমাদের হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) আসা রোগীরা সাধারণত অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার পর এখানে আসেন। কিন্তু সে সব হাসপাতালে তুলনামূলকভাবে সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকানোর ক্ষেত্রে তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল। ফলে তারা এমন কিছু ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হন, যেগুলো এর মধ্যেই ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে গেছে।’

‘তৃতীয়ত, আইসিইউতে সংক্রমণ। এ ক্ষেত্রে যে সব সুপারিশ করা হয়ে থাকে, আমাদের দেশে আইসিইউতে সেগুলো সেভাবে মানা হয় না। ফলে রোগীরা আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার পর খারাপ ধরণের ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। যে কারণে এই হারটি ধীরে ধীরে বাড়ছে।’

দেশের একমাত্র চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলছেন, আট বছর আগে এই হার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ছিল, তবে এখন এই হার অন্তত তিনগুণ বেড়েছে।

এ ধরণের সংক্রমণের পেছনে কারণ কী?

অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘এ নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা এখনও চলছে। সেগুলোর ফলাফল প্রকাশিত হলে হয়তো নিশ্চিতভাবে বলা যাবে। তবে যে সব কারণ এখন ধারণা করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, সংক্রমণ ঠেকাতে যে সব ব্যবস্থা হাসপাতালে থাকা উচিত, এখানে সেগুলো খুবই দুর্বল।’

‘বাংলাদেশে ঢালাওভাবে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওভার দা কাউন্টার অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাচ্ছে।’

২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব সায়েন্টিফিক রিসার্চের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি তিনজন রোগীর একজন চিকিৎসকের কোনও পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকেন।

‘কোটি কোটি মুরগীতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো নানাভাবে মানুষের শরীরে চলে আসছে।’

আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানীরা বলেছেন, অনেক শিশুর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট দেখা গেছে, যদিও ওই শিশু হয়তো তেমন কোনও ওষুধ খায়নি। জিনের মাধ্যমে তাদের শরীরে এটি তৈরি হয়েছে।

‘এর মানে শিশু এন্টিবায়োটিক না খেলেও প্রকৃতি-পরিবেশে থাকা এ সব ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করছে এবং ওষুধ কাজ করছে না,’ বলেছেন আইসিডিডিআরবি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মনিরুল আলম।

তাহলে বাজারে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের কী অবস্থা?

অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলছেন, ‘সাধারণভাবে আমাদের গবেষণাটি হচ্ছে হাসপাতাল-কেন্দ্রিক, যেখানে তুলনামূলক জটিল রোগীরা আসেন। সে সব পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের অর্ধেক ক্ষেত্রে, আজ থেকে ১০/১৫ বছর আগে যে সব অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে তাদের চিকিৎসা করা যেতো, তার অন্তত অর্ধেক ওষুধ কার্যকারিতা হারিয়েছে।’

‘সুতরা আমরা বুঝতে পারছি, এইভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে ব্যাকটেরিয়াগুলো বিপদজনকভাবে প্রতিরোধী হয়ে উঠবে এবং মানুষের চিকিৎসা করাটা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়বে।’

কীভাবে সমস্যাটির মোকাবেলা করা যেতে পারে?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, প্রথমত, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করা দরকার। সেটা করার সহজ পদ্ধতি হলো, এ রকম ওষুধের প্যাকেটগুলো লাল রঙ করে ফেলা, যাতে সবাই বুঝতে পারে যে এটি ঝুঁকিপূর্ণ।

‘পশুসম্পদে, বিশেষ করে মুরগিতে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ করা। কারণ এ সব অ্যান্টিবায়োটিক পরিবেশে মিশে প্রতিরোধী হয়ে উঠলে তা মানুষের জীবনের জন্য অনেক ঝুঁকি তৈরি করবে।’

‘প্রতিটা হাসপাতালে সরকারের নজরদারি বা টিম করে দিতে হবে, যাতে সেখানে সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো অবশ্যই নিশ্চিত করা হয়।’

অধ্যাপক রহমান বলেন, একসঙ্গে এ সব পদক্ষেপ নিতে হবে।

‘তা না হলে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যাবে। কারণ এখানে ছোট্ট জায়গা, মানুষ বেশি, ফলে দ্রুত সংক্রমণ বা জীবাণু ছড়াতে পারে’- সতর্ক বার্তা জানালেন এই চিকিৎসক।

সূত্র: বিবিসি

একে//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি