আগের পোশাকও পরতে পারবেন আইডিয়ালের শিক্ষার্থীরা
প্রকাশিত : ১০:০৯, ২৪ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৩:০৫, ২৪ জানুয়ারি ২০২০
গত বছরের ৩ আগস্ট গভর্নিং বডির এক সিদ্ধান্তে ১৯৭৩ সাল থেকে চালু করা ড্রেস কোড পরিবর্তন করে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। যা নতুন বছরের শুরুতেই কার্যকর করা হয়।
নতুন ড্রেসে মেয়েদের ওড়না ও স্কার্ফ ঐচ্ছিক করে নেভি ব্লু ফ্রক ও সাদা সালোয়ারের সঙ্গে সাদা জুতা ও মোজা বাধ্যতামূলক চালু করা হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে টুপিকে ঐচ্ছিক করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির এমন সিদ্ধান্তের পর থেকেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে চলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যাদের অনেকে বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও অভিভাবকদের একাংশের মাঝে রয়েছে চাপা ক্ষোভ।
তবে নতুন ড্রেস পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে আসার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দেখানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ বলে আসছিলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাছাড়া, সবাই ওড়না পরেও না। তাই ওড়নার পরিবর্তে হিজাব রাখা হয়েছে।’
তার এমন বক্তব্যের পর গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে অভিভাবকদের একটি অংশ। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন তারা। দেন ১৭ দিনের আল্টিমেটাম, যা আগামি ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। এরমধ্যে দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন তারা।
প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি শাখা ঘুরে শিক্ষার্থী ও অভিভাকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ওড়না-টুপি পরতে বাধ্যবাধকতা থাকায় অভিভাবকরাও এ নিয়ে কথা তুলেননি। কিন্তু তাদের সাথে আলোচনা না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। তবে, নতুন ড্রেস চালু হলেও পড়তে বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেকে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মা জানান, ‘ধর্মীয় অনুশাসন মানতে তো প্রতিষ্ঠান বাধা দেয়নি। চাইলেই যে কেউ তার নিজস্ব পোশাক পরে আসতে পারছে। এটি নির্ভর করছে পরিবারের ওপর। পরিবার যেহেতু প্রত্যেকটি সন্তানের প্রথম শিক্ষালয়, তাই পরিবার থেকে সন্তানকে আমরা যদি নৈতিক শিক্ষা দেই তাহলে সন্তান অবশ্যই প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে শালীনতা বজায় রেখে চলবে। এটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়।’
তবে দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের আলাদা নীতিমালা ও বৈশিষ্ট্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তার মানে এটা নয় যে, যা ইচ্ছা তাই চাপিয়ে দিবে। স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠান থেকে এর আগে আমার দুই সন্তান বেরিয়েছে। যারা আজকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। পরিবারের পাশাপাশি একাডেমিতে সন্তানদের নীতি, নৈতিকতা শেখাতেই মূলত এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ সবার। নতুন ড্রেস কোডে হিজাব ঐচ্ছিক হলেও মেয়ের ইজ্জত ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে অনেকটা চিন্তিত আমি।’
জানতে চাইলে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনিরুল হাসান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি যার বিরুদ্ধে আন্দোলন হতে পারে। এখানে শিক্ষার্থীদের প্রতি কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা চালিয়ে দেয়া হয়নি। চাইলে আগের পোশাক পড়তে পারবেন তারা। এ নিয়ে জোর-জবরদস্তি করতে চাই না আমরা।’
তিনি বলেন, ‘গুটি কয়েক যারা অপপ্রচার চালিয়ে আন্দোলন করছেন, তারা মূলত একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বর্তমান পোশাক চালু ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ওই শ্রেণির হাতে থাকায় অনেকটা মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীরা চাইলে হিজাব ও ওড়না পরে আসতে পারবেন। এটি তাদের নিজস্ব ব্যাপার।’
প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল আবু হেনা মোরশেদ জামান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ইচ্ছে করলেই ড্রেস কোডের মাধ্যমে আমি কাউকে ধর্মীয় বিষয়ে বাধ্য করতে পারি না। গত বছরের গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছেলেরা টুপি ও সালোয়ার কামিজের সাথে ওড়না ও বাড়তি স্কার্ফ পরার কথা ছিল। কিন্তু বাড়তি এই স্কার্ফে আমাদের মনে হয়েছে যে, এর মধ্যে কিছু মেয়ে ইয়াবা ও নকল আনে। তাই আমরা বলেছি মেয়েরা ওড়না পরবে। স্কার্ফটা পড়তে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘শুধু এ প্রতিষ্ঠান নয়, মতিঝিল গার্লস স্কুলের মেয়েরা চার ইঞ্চি ওড়না দিয়ে ক্রস বেল পরে, সেখানে আমরা করেছি ছয় ইঞ্চি। এমনকি তারা চাইলে হিজাবও পরতে পারবে। অর্থাৎ, ইসলামী মূল্যবোধটা থাকবে। গত বছর এমন সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সমন্বয়ে এটি পর্যালোচনা করা হয়েছে। যাতে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন বছর থেকেই তা কার্যকর করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সমস্যা আসলে সেখানে নয়। আমার ২৬ হাজার শিক্ষার্থীর ৫২ হাজার অভিভাবকদের মাঝে ৭০ থেকে ৮০ জন অভিভাবক বিভ্রান্ত হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। আমরা তাদের চিহ্নিত করতে চাই না। তাদের রাজনৈতিক প্রশ্ন নিয়ে সন্দেহ আছে।’
অভিভাবকদের একটি অংশের দেয়া আল্টিমেটামের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কি-না জানতে চাইলে গভর্নিং বডির এ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের তো আল্টিমেটামের কোনো বিষয় না। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এতে আমরা অন্যায় করেছি কিনা। আমরা যদি তা না করে থাকি, ঠিক ঠাক জায়গায় থাকি তাহলে কেন এই গুটি কয়েকের আন্দোলন? আমরা তো কাউকে জোর করে বলি নাই যে এটা তোমাকে পড়তেই হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের ইচ্ছেমত পোশাক পড়বে।’
এ ব্যাপারে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘পোশাক পরিবর্তনে আইডিয়াল স্কুলের স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা ও শঙ্কার কিছু নেই। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে তাই আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। চিন্তা ও চেতনার গভীরতা বাড়াতে হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান নিজের স্বকীয়তা নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিক্ষার্থীদের ওপর জোর করে ধর্মীয় অনুশাসন মানতে বাধ্য করা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘সন্তানদের শালীনতার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পরিবারের পক্ষ থেকে শিক্ষা দিলে তারা নিজ থেকে তা পালন করবে। কিন্তু যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে যে একটি বিদ্যালয়ে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে বাধা দেয়া হচ্ছে, সেই অপপ্রচারকারীদের আমরা চিনি।’
পোশাক পরিবর্তনে অভিভাবকদের একাংশের আন্দোলনকারীদের প্রতি অপপ্রচার না চালানোর আহ্বান জানিয়ে নওফেল বলেন, ‘মানববন্ধনের নামে যারা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, তারা জ্বালাও-পোড়াও ও তথ্য প্রযুক্তি মামলার আসামি। তাদের কার্যক্রম সরকারের নজরে আছে। রাস্তায় আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়ে ঘরে ঢুকে সন্তানদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করছেন তারা।’
মন্ত্রী বলেন, ‘মানববন্ধনের নামে বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা যদি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করা হয়, শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করতে চাওয়া হয়, তাহলে নিজেরাও ঘরেও শান্তিতে থাকতে পারবেন না। এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থাকবে না। মানববন্ধনের নাম করে অরাজকতা করলে সবাইকে তুলে আনা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই দেশে হিংসা, হানাহানি বাদ দিয়ে সহনশীলতার সাথে বাস করতে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রেখে চলতে হবে। নতুন সমাজ, অর্থনীতি ও বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
আরও পড়ুন