আনন্দ-বিষাদের শ্রাবণধারা!
প্রকাশিত : ১০:৫৩, ৩১ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১১:০২, ৩১ জুলাই ২০২১
সেই ১৯৯৪-৯৫ সালের কথা। স্কুলে আমার উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ পর্যায়। গ্রাম এবং শহর মিলিয়েই থাকা। আমাদের গ্রামে তখন কলের লাঙল এসেছে নতুন, কিন্তু ব্যয়বহুল। ফলে বেশিরভাগ মানুষের ভরসা ছিল গরু-মহিষ দিয়ে হাল চাষ করা। যাক সে কথা, আরেকদিন বলব। আজ আসুন, আসল কথা বলি-
সে সময় আষাঢ়-শ্রাবণ মানেই টানা ৫/৭, এমনকি ১০ দিনের বৃষ্টি। এতে গ্রামের মহাজন, ধনী কৃষক আর ধনাঢ্যদের বাড়িতে চলত আম, কাঁঠাল, দই আর বোয়াল, রুই এবং মোরগ পোলাও উৎসব। মেয়ে জামাইর সে কি আদর, চোখে পড়ার মতো। কোনও কোনও বাড়ির কাচারি ঘরে চলত দিনভর তাস আর ক্যারাম খেলা। যেন বর্ষা উৎসব।
তবে আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যতিক্রম। এমন দিনে বাবা ঘরেই থাকতেন। তাই বৈঠকখানাটা ভরা থাকত মুরুব্বিদের আড্ডায়। এতে দ্বৈত চিত্র ফুটে উঠত- একদিকে বর্ষা উৎসব অন্যদিকে উনুন না জ্বলা।
টানা বৃষ্টিতে খেটে খাওয়া দিনমজুরদের কষ্টের সীমা থাকত না। কাজে যেতে পারতেন না। ফলে কোনও কোনও বাড়িতে সারাদিনে এক বেলা রান্না হতো। আর দু’বেলা কাটিয়ে দিতেন কাঁচা পেঁয়াজ আর পান্তা কিংবা জবের গুড়া অথবা লাল আটার খামির খেয়ে। সে কি অভাবের তাড়না! আর মহাজনেরা সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে করতেন রমরমা দাদন ব্যবসা। এমনকি গরীব মানুষকে চাল, ডালের পাশাপাশি লাকড়ীও ধার করতে হতো মহাজনদের কাছ থেকে। কেননা, টানা বৃষ্টিতে যেখানে শোবার ঘরে পানি ঢুকে পড়তো, সেখানে লাকড়ী সংরক্ষণের জায়গা কোথায়?
অনেককে দেখেছি ভিটে বাড়ির দলিলের সাথে গবাদী পশুও বন্ধক রাখতে। সংসার চালাতে সালাম, কবির, ইসরাফিল, মনছুররা রীতিমত পাগল হয়ে যেতেন এ সময়। আজ মনছুরের ছেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। কিন্তু করোনা মহামারী তার ভবিষ্যত জীবনেও তৈরি করেছে এক অনিশ্চিত রেখা। অবশ্য পুরো বিশ্বই আজ এক অভূতপূর্ব অনিশ্চিয়তার মধ্যে সময় পার করছে।
সে সময় কারো কারো বাড়িতে এক, দুই এমনকি তিনদিনও চুলা জ্বলত না। জবের গুড়া, শুকনো মুড়ি, প্রতিবেশীর দেয়া কাঠাল খেয়ে দিন কাটাত তারা। হাট-বাজারেও যাওয়া যেত না কাদাপানি মাড়িয়ে। গিয়েও লাভ হত না। দোকান পাট বলতে কিছু থাকত না। আর সে সময় গ্রামের হাট বসত ফাঁকা জায়গায়।
তবে এ সময় সবচেয়ে সস্তা ছিল গরুর দুধ। কারণ, দুধ কিনে খাওয়াকে মানুষ মনে করতো বিলাসীতা। আর গরীব কৃষক গাভীর দুধ বেঁচে চাল, ডাল কিনতো। বেশিরভাগ দুধ কিনতেন চা বিক্রেতারা। কিন্তু বৃষ্টির বাধায় চা দোকানেও বিক্রি কমে যেত। ফলে দুধের দাম কমে তিন টাকা লিটারেও বিক্রি হতে দেখেছি। নিজেও কিনেছি।
তবে টানা বৃষ্টির পর যেদিন রোদ উঠত, সেদিন মহল্লা জুড়ে চলত আনন্দ-বন্যা। হাফ ছেড়ে বাঁচত গ্রামের মানুষ। ফিরে আসত কর্মচাঞ্চল্য।
এই মহামারীতেও আজ আমি, আপনি বহুতল ভবনের ছাদে কিংবা জানালার পাশে বসে বৃষ্টিবিলাস করছি। ভাল মন্দ রান্নার গন্ধ নাসিকায় আঘাত হানছে অহরহ। অথচ ১৯৯৪ সালের এমন দিনে যে গন্ধ পেতাম, তা ছিল সপ্তাহব্যাপী মহল্লাজুড়ে অভাবের তাড়নার তামাটে রংয়ের-উৎকট গন্ধ।
এনএস//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।