আবদুর রশীদ চৌধুরী: বৃক্ষছায়া
প্রকাশিত : ২৩:১১, ১৩ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১২:৫০, ১৪ নভেম্বর ২০১৯
আবদুর রশীদ চৌধুরী
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার তীর্থভূমি হিসেবে দেশে-বিদেশে কুষ্টিয়ার খ্যাতি রয়েছে। এই খ্যাতি একদিনে অর্জন হয়নি। বহু পথ বহু সময় বহু কীর্তিমানের সাধনার ফসল কুষ্টিয়ার ললাটে খ্যাতির তিলক পরিয়ে দিয়েছে। যা আজ আমরা সহজেই গর্ব করতে পারি। কিন্তু এ তো বহমান নদীর মতো। লালন রবীন্দ্রনাথ গগন কাঙালের কথা বলে আমি সম্মান ও গর্ব অনুভব করি।
দেশ-বিদেশে আমাদের সম্মান হয়। কতো দেশ থেকে কতো সাধক আর উৎসাহী মানুষ কুষ্টিয়ার মাটি দেখতে আসে। এখানকার মাটি নিয়ে কতো হাজার প্রশ্ন তাদের। পথ যে তারপর আরো প্রসারিত হয়েছে আরো সাধক যে এখানে জন্মেছেন এ মাটিতে আরো যে সোনার ফসল ফলেছে, সেসব খুব বেশি উচ্চারিত হয় না। কবি আজিজুর রহমান, ঔপনাসিক আকবর হোসেন সহ আরো অনেকের নাম আমরা উচ্চারণ করি। গর্ব অনুভব করি। এদের পরেও যে আরো অনেক নাম যুক্ত হয়ে গেছে, সেসব আমরা বলি না। অনুষ্ঠান উৎসবে গবেষক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী, কবি-গীতিকার আবু জাফর, গবেষক শ ম শওকত আলী, কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক, কবি-গবেষক বিলু কবীর এঁরাও যে ইতিহাসে ঢুকে পড়েছেন, সেদিকে আমাদেও লক্ষ্য নেই বললেই চলে। নাম মাঝেমধ্যে কিন্তু আমি যখন বিএ (অনার্স)-এর ছাত্র, তখন একবার প্রখ্যাত গবেষক ড. ক্ষেত্র গুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না গুপ্ত কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে এসেছিলেন। এটা বেশ আগের কথা। ’৯০ এ দিকের কথা। জ্যোৎস্না গুপ্ত তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘কুষ্টিয়ার মাটিতে কী এমন আছে, যে মাটিতে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ-হয়ে ওঠেন, লালন সাঁই, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মীর মশাররফ হোসেন এমনকী আজকের শ্রীমান আবুল আহসান চৌধুরী এঁরা সবাই এ মাটির সন্তান।
আমার খুব ইচ্ছে করে এই মাটি নিয়ে গবেষণা করতে।’ এই কথাটা আমার মনে গেঁথে আছে। এখনো কান পাতলে আমি শুনতে পাই। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমি একটু একটু লেখালেখি করি। প্রকাশের সাহস ও সুযোগ কোনোটাই সেভাবে ছিল না। কুষ্টিয়া শহরে থাকি। তখনো অতোটা গভীরভাবে বুঝিনি কুষ্টিয়ার মাটি কতোটা উর্বর কতোটা পলিমাটি সমৃদ্ধ। কেউ তো লেখক হয়ে জন্ম নেন না। লেখক হয়ে উঠতে হয়। লেখক হয়ে ওঠেন। লেখক হতে হলে শুধু লিখলেই তো হলো না তার জন্য প্রেরণা লাগে, সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এসব মানুষও তো আলোকবর্তিকা। যাঁরা নিজের লেখার চেয়ে তরুণদের কাঁচা ও অপরিপক্ক লেখাকে তিরস্কার না করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না ভেবে, পরম মমতায় হাতে টেনে নিয়ে, উৎসাহ প্রেরণা দিয়ে পত্রিকায় ছাপিয়ে এক আকাশ আলো তরুণ লেখকটির বুকের ভেতর মনের ভেতর জ্বালিয়ে দিতেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তিটি আমার কাছে আব্দুর রশিদ চৌধুরী। নানা বিশেষণে তাঁকে অভিহিতি করা যাবে। তাঁর সম্পাদনা ও প্রকাশনায় দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা তখন খুব আলোড়ন সৃষ্টিকারী পত্রিকা। মজমপুরে অফিস। দিনরাত জমজমাট অফিস। কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার প্রধানতম কেন্দ্র তখন সেটিই।
আমি তখন মাঝেমধ্যেই দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা অফিসে যাই। লাকি মিজান ও আতিক আল হেলাল এক রুমে বসতেন। দুজনই চমৎকার মানুষ। কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের সাথেই আমার বেশ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লাকি মিজান ‘লাকি ভাই’ নামে কুষ্টিয়ায় এক নামে পরিচিত তখন। সাংবাদিকমহলেও বেশ কদর ও সম্মান। আমিও লাকি ভাই ডাকতাম। তার ছোট বোন মুন্নী আমার সাথে পড়তো। আমার ভালো বন্ধু। সে সুবাদে লাকি ভাই আমাকে একেবারেও আপন ভাইয়ের মতো কাছে টেনে নিলেন। তার মটর সাইকেলে আমাকে তার পেছনে বসিয়ে কুষ্টিয়া শহর ঘুরতেন। বাসায় নিয়ে গিয়ে আদর করে খাওয়াতেন। মুন্নীর থেকে তার পরিবারের অন্য সবাই যেন বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আতিক হেলাল তখন কুষ্টিয়ায় বেশ পরিচিত। কবি-লেখক-সাংবাদিক হিসেবে বেশ খ্যাতিও পেয়েছিলেন। এদের সামনে অফিসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গল্প হতো। লেখালেখি-সাংবাদিকতা নানা বিষয় নিয়ে কথা হতো। এ রুমে আব্দুর রশিদ চৌধুরীও কখনো কখনো ঢুকে পড়তেন। নায়কের মতো চেহারা। খুব কম কথা বলেন। যা বলতেন তার প্রত্যেকটি কথাই কাজের কথা। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, তার সাথে কথা বলবো। কিন্তু তিনি কথা শেষ কওে এক সেকেন্ডও দাঁড়াতেন না। নিজের রুমে চলে যেতেন। আমি যে লেখালেখি করি, এই কথাটাই বলা হয়ে উঠতো না। একদিন লাকি ভাইকে বলতেই, তিনি এতো খুশি হলেন, তার সেই খুশি মুখটা এখনো চোখের সামনে ভাসছে। বললেন, ‘তুমি যেটা ভালো লেখো, সে রকম একটা লেখা আমাকে কাল পরশুর ভেতর দিবে।’ ঠিক এসময়ই সম্পাদক মহোদয় ঢুকলেন। তার কোনো কথা বলার আগেই লাকি ভাই তাকে বললেন, আপনার সাথে তো রকিবের পরিচয় হয়নি। এটুকু বলতেই তিনি আশ্চর্যরকমভাবে লাকি ভাইয়ের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, চিনি তো। ওকে লেখার সুযোগ করে দাও। ওকে কিছু অ্যাসাইনমেন্ট ঠিক করে দাও। এ সপ্তাহেই ওর একটা লেখা আমি ছাপতে চাই।
অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। সম্পাদক মহোদয় চলে যাবার পর লাকি ভাই বললেন, উনি মুখ দেখলেই বুঝে ফেলেন তাকে দিয়ে কী হবে। তোমাকে কয়েকদিন ধরেই উনি খেয়াল করছিলেন। লাকি ভাই অনেক খুশি হলেন। আমিও। কিন্তু সমস্যা হলো, দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা তখন কুষ্টিয়ার নামকরা পত্রিকা। সেখানে তো যেমন তেমন কোন লেখা দেয়াও সম্ভব নয়। ভালো লেখা কিভাবে তৈরি করতে হয়, তাও তো জানিনে। লাকি ভাইকে বলেও সাহস পাচ্ছিনে। কিছু না বলে মাথায় দুশ্চিন্তা এবং একই সঙ্গে আনন্দ নিয়ে ফিরে আসি। একটাই চিন্তা কী লিখবো! লাকি ভাই প্রথমে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন না। বললেন, খুঁজে বের করো। আমি পরের দিন গ্রামে আসি। আমার মেজো দাদার বড় ছেলে শাহজাহান আলী শেখ। তার বড় ছেলে মজিদ সুস্থ সবল ছেলে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথেই পা থেকে অবশ হয়ে যাওয়া শুরু হলো। দশ বারো বছরের মধ্যেই মাজা পর্যন্ত প্যারালাইজড হয়ে গেলো। দু হাত চিকন হয়ে গেলো। একই অবস্থা হলো তার ছোট অন্য ভাইদেরও।
এ বিষয়টা আমার মনে অনেক কষ্টের কারণ ছিল। কারণ তারা আমার ভাই। বয়সে সবাই আমার ছোট। ভাবলাম আমার এই ভাইদের নিয়েই লিখবো। তিন চারদিন খেটেখুটে লেখাটা তৈরি করে লাকি ভাইয়ের হাতে দিলাম। লাকি ভাই লেখাটা পড়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। একটা কথাও জিজ্ঞেস করলেন না। আমার বারবারই মনে হচ্ছিলো, বোধ হয় লেখাটা কিছুই হয় নি। তবে লেখাটা পড়ে তার চোখের কোণ যে একটু ভিজেছিল, তা এখনো আমার চোখে লেগে আছে। তিনি বললেন, তুমি এখন যাও। সম্পাদক মহোদয় এলে তোমার লেখাটা দেখাবো। আমার ভয়টা আরো বাড়লো। এই ভয়টা নিয়েই সেদিন বাংলাদেশ বার্তার অফিস থেকে বের হই।
পরের দিন সকালে দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা হাতে নিতেই দেখি আমার লেখাটা প্রথম পৃষ্ঠায় বক্স করে সুন্দর ভাবে ছাপা। বারবার দেখছিলাম, লেখাটা তো আমারই! আমার নামের বানান পড়ছিলাম। আমিই তো! এর পর কয়েকটা পত্রিকা কিনে পারলে এক দৌঁড়ে কয়ায় যাই মেজো দাদা জনিরুদ্দিন শেখের বাড়িতে। আমি ঘরের পোটনির ’পর বসে নিজেই লেখাটা পড়ছি। আমাকে ঘিরে আমার দাদি-দাদা, চাচা-চাচিরা কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে আমার পড়া শুনছে। যখন পড়াটা শেষ হলো, দেখি সবাই চোখের পানি মুচছে। আমার চোখেও তখন পানি।
গ্রাম থেকে ফিরে বিকেলে পত্রিকা অফিসে ঢুকতেই লাকি ভাই আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, সম্পাদক মহোদয় তোমার লেখাটা প্রশংসা করেছেন। তোমাকে দেখা করতে বলেছেন। ভেতরে উনি আছেন। যাও দেখা করে আসো। আমি সম্পাদক মহোদয়ের রুমে ঢুকতেই তিনি বললেন, রকিব, আসো। তোমার লেখাটা পড়েছি। ভালো হয়েছে। তুমি এখানে নিয়মিত লিখবে। আমি লাকি মিজানকে তোমার লেখা নিয়মিত ছাপতে বলে দিয়েছি।
আমার লেখালেখি জীবনে এটা ছিল পরম আশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদ আজো আলো হয়ে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার লেখালেখির ভুবনে শ্রদ্ধেয় আব্দুর রশিদ চৌধুরী প্রথম আলোর পরশ মেখে দিয়েছিলেন দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা আমার লেখক হবার বাসনার প্রথম তীর্থস্থান। শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে ঢাকায় এসে সাংবাদিকতা দিয়েই পেশাজীবন শুরু হয় আমার। তার শেখানো পথেই। ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক অর্থবিত্ত নামে একটি পত্রিকা প্রায় বিশ বছর ধরে প্রকাশ করছি। তিনি জেনে খুশি হয়েছিলেন। খুব কাছে থেকে দেখেছি শ্রদ্ধাভাজন আব্দুর রশিদ চৌধুরীকে তিনি কীভাবে সাধকের মতো লেগে থেকে সাফল্যের আকাশ ছোঁন। তার কাছ থেকে শিখেছি কোন কিছুতে সাফল্য পেতে হলে সাধনা করতে হয় নির্মোহভাবে লেগে থাকতে হয়। তার মতো হওয়া সম্ভব নয় কিন্তু বোধটা ধারণ করে আছি। সাধ্যমতো নিষ্ঠা ও একাগ্রতা ধরে আছি। পারি না পারি তাঁকেই অনুসরণ করে পথ হাঁটি।
আজো তার পরম মমতা আদর অনুভব করি। কিছুদিন আগেও বললেন, ‘রকিব, তোমার কবিতা পাঠিও।’ কতোটা মমত্বশীল হলে এতোটা উদার হওয়া যায়! যেনো ফলভর্তি নুয়ে পড়া সাধকরূপী বিশাল বৃক্ষ। যিনি শুধু দিতে শিখেছেন অথবা দিতেই এসেছেন। নিজেকে ভাবেননি বা ভাবেননি কী পেলাম না পেলাম। কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতায় কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব তিনি। সাহিত্যাঙ্গনে তার নিজের রচনাসম্ভার এবং একই সঙ্গে নিজের হাতে আপন ছায়ায় কতো কবি-সাহিত্যিক গড়ে তুলেছেন, সেসব হিসেবের খাতায় আনলে, তিনি কুষ্টিয়ার শিল্পাঙ্গনে নিজেই একটি বিশাল আকাশ এই অসামান্য অবদান আলো হয়ে ছড়িয়ে আছে অংকে মেলানো যায় না মেলানো সম্ভব নয়।
লেখক: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।