আবদুল গণি শেখ: একজন সত্য সাধকের জীবনভাষ্য
প্রকাশিত : ১৯:৫৯, ২১ নভেম্বর ২০১৯
মরহুম আব্দুল গণি শেখ
আবদুল গণি শেখ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এক ঋদ্ধপুরুষ। স্মৃতির অতলে হারিয়ে সাহসী মানুষের গল্প তিনি। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস সমৃদ্ধ গ্রাম হিসেবে কয়ার পরিচিতি ও খ্যাতি দীর্ঘকালের। হিন্দু-মুসলমানের সৌহার্দ্যপূণ বসবাস ছিল এখানে। এ গ্রামে তার জন্ম ও মৃত্যু।
কয়া গ্রামে চ্যাটার্জি, ঘোষ, পাল, সাহা, বিশ্বাস, দত্তসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হিন্দু সমাজের বসতি ছিল। হিন্দুরাই কয়া এবং এর আশপাশ এলাকায় একসময় প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিরাজ করে বাস করেছে। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় তাদের প্রধান ভূমিকা ছিল।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশ-ভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধ এসব ঐতিহাসিক ঘটনাকালীন সময়ে এখানকার অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে। ফলে প্রভাবশালী হিন্দু সম্প্রদায় ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে।
কয়া গ্রামের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ। হিন্দু-মুসলনমান একসাথে ভাইয়ে-ভাইয়ের মতো মিলেমিশে বসবাস করলেও, বাইরের দুর্বৃত্তদের বহুমুখি অত্যাচারে হিন্দু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছে। জীবন-সম্পদ-সম্ভ্রম রক্ষা করা তাদের জন্য কঠিন ছিল। এরকম দুঃসময়ে আবদুল গণি শেখ গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ান। শক্তি দিয়ে সাহস দিয়ে প্রেরণা দিয়ে নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
অবদুল গণি শেখ প্রচন্ড সাহসী এবং ধন-সম্পদে প্রভাবশীল ব্যক্তি ছিলেন। সুদর্শন ও সুঠাম শরীরের অধিকারী ছিলেন। ভালো লাঠিখেলা জানতেন। মিশুক এবং উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। হিন্দু সমাজের প্রতি এতোটাই মমত্বশীল ছিলেন, নিজেও একসময় হিন্দু পরিবেষ্ঠিত এলাকায় নতুন করে বাড়ি করে সেখানে বাস করেছেন। যাতে তাদের উপর কেউ অত্যাচার করতে না পারে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও আবদুল গণি শেখকে ‘দেবতা’র আসনে বসিয়েছিল এবং দেবতাজ্ঞান করে সম্মান করতো। বিভিন্ন পূজাপার্বণে দেবতাদের সাথে আবদুল গণি শেখের নামও লেখা হতো ‘শ্রী শ্রী আবদুল গণি সহায়’।
কয়া গ্রাম বিপ্লবীর গ্রাম। বাঘা যতীনের গ্রাম। বিখ্যাত চ্যাটার্জি পরিবারের গ্রাম- যে পরিবারটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল সূতিকাগার ছিল। সে কারণে এ গ্রামে ব্রিটিশ সৈন্যরা প্রায়ই হানা দিতো। নানাভাবে অত্যাচার করতো। গ্রামের মানুষদের আতঙ্কের ভেতরে রাখতো। কারণও ছিল পরিষ্কার। বাঘা যতীনের ভয়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা তটস্থ থাকতো। তাকে গ্রেফতারের জন্য তাদের নানারকম পরিকল্পনা থাকতো। বাঘা যতীনের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের কাছে প্রত্যেকবারই ব্রিটিশসৈন্যদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে কয়া গ্রামে ব্রিটিশসৈন্যদের অত্যাচার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাতে পরিণত হয়েছিল।
ব্রিটিশসৈন্যরা জানতো কয়া গ্রাম হলো বাঘা যতীনের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। এখানে তার মায়ের বাস, মামাদের বিশাল আধিপত্য। সারা গ্রামের মানুষ তাকে আগলে রাখতো।
ব্রিটিশসৈন্যরা কয়া বাজারে এসে জোর করে সাধারণ মানুষকে পাঞ্জা খেলতে বাধ্য করে তাদের হাতের কব্জি ভেঙে দিতো। বাঘা যতীন যখন এ খবর জানতে পারেন, মুহূর্ত দেরি না করে কৃষ্ণনগর থেকে ছুটে এসে ছদ্মবেশে কয়া বাজারে ব্রিটিশসৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করেন। ব্রিটিশসৈন্যরা কয়াবাজারে আসা মাত্রই তাদের পাঞ্জা খেলতে আহ্বান করেন। এতে ব্রিাটশসৈন্যরা খুশিই হন। মুহূর্তে সে খুশি চূর্ণবিচূর্ণ করে ব্রিটিশসৈন্যদের হাতের কব্জি ভেঙে দেন তিনি।
এ ঘটনার পর বেশ কিছুকাল ব্রিটিশসৈন্যরা ভয়ে কয়া বাজারে আসা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহা তাদের মধ্যে ঠিকই ছিল। বালেশ্বরের যুদ্ধে বাঘা যতীন আহত হয়ে গ্রেফতার হওয়ার পর, হাসপাতালে আত্মাহুতি দেয়ার বেশ কিছুকাল পর, অনেকের মতে ১৯৩০ সাল বা এর দু এক বছর আগে-পরের দিকে তারা আবার নতুন করে কয়া বাজারে আসতে শুরু করে এবং পাঞ্জা খেলার নামে এলাকার নিরীহ লোকদের কব্জি ভেঙে দেয়।
গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে এ কারণে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ গ্রহণের অগ্নিস্পৃহা তৈরি হয়। বাঘা যতীনের দেখানো সাহসে ভর করেই অবদুল গণি শেখ গ্রামের লোকদের নিয়ে তাদের উচিত জবাব দেয়ার পরিকল্পনা করেন। তিনি মোজাহার মালিথা, লোকমান মিস্ত্রি, লয়মান মিস্ত্রি, আমোদ আলী মাঝি ও আরশেদ আলীসহ গ্রামের আরো কিছু সাহসী যুবককে নিয়ে ব্রিটিশসৈন্যদের কয়া বাজারে চরমভাবে গণপিটুনি দেন। এরপর ব্রিটিশসৈন্যরা আর কখনওই কয়া বাজারে আসার সাহস দেখায়নি।
সে সময়ে আবদুল গণি শেখ, মোজাহার মালিথা, লোকমান মিস্ত্রি, লয়মান মিস্ত্রি, আমোদ আলী মাঝি, আরশেদ আলীরা ছিলেন প্রচন্ড সাহসী এবং শারীরিকভাবে শক্তিশালী মানুষ ছিলেন। খেলাধূলাতেও এরা ছিলেন প্রায় অপারেজয়। বাঘা যতীন যে সময় গোটা ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অবিসংবাদিত নেতা, তার সাহসের তেজস্বীতে নিজের গ্রামের কিশোর-তরুণ সবাই যেনো চেতনা আর সাহসের অগ্নিবারুদে ‘বাঘা যতীনই’ হয়ে-উঠেছিলেন। আর সে কারণেই তারা ব্রিটিশসৈন্যদের গণপিটুনি দিয়ে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করার অবিশ্বাস্য সাহস দেখাতে পেরেছিলেন।
বাঘা যতীনকে তারা তো অনেকেই চোখের সামনেই দেখেছেন, যারা দেখেননি তারা তার গল্প শুনেছেন। তার আলোতেই তো বড় হয়েছেন, তার সাহসের অগ্নিরেখাতেই সাহসী হয়েছেন। বাঘা যতীনের জন্ম ১৮৭৯ সালে, মৃত্যু ১৯১৫ সালে।
অন্যদিকে, শতবর্ষ আয়ুপ্রাপ্ত অবদুল গণি শেখ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। আবদুল গণি শেখ যাদের সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশসৈন্যদের গণপিটুনি দেন, তারা প্রায় সবাই কাছাকাছি বয়সের ছিলেন। ফলে বাঘা যতীনের অগ্নিস্পর্শ তাদের অনেকেই সরাসরি ছুঁয়ে থাকবে এটা সহজেই অনুমানযোগ্য। পুরো গ্রামটাই যেনো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অভেদ্য দূর্গ ছিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আবদুল গণি শেখ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভরতার নাম। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপন আশ্রয়স্থান তৈরি-খাবার প্রদান-অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহসহ বিভিন্ন ধরণের সাহসী সহযোগিতা করেছেন। রাজাকার-আলবদর-আল শামস- এদের প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। জাতীয় বীর নূর আলম জিক, মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গণি এবং এদের সহযোগীদের আঞ্চলিক ঘাঁটির মতো ছিল অবদুল গণি শেখের বাড়ি।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার বড় ছেলে আবদুল হাকিম শেখ ও মেজো ছেলে মোহা. উকিল উদ্দিন শেখ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। আবদুল হাকিম শেখ তার পিতার মতোই অসীম সাহসী ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গ্রামে অবস্থান করেই রাজাকার আল-বদরদের হত্যা লুণ্ঠন ধর্ষণ থেকে গ্রামকে নিরাপদ রাখার জন্য সাহসী ভূমিকা রাখেন। যে কারণে মুখোশধারী রাজকারদের হাতে আবদুল হাকিম শেখ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
আবদুল গণি শেখের মেজো ছেলে উকিল উদ্দিন শেখকেও রাজাকার-আল বদর বাহিনী হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে নিয়ে নৌকায় করে শিলাইদহের পাশে পদ্মা নদীতে নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি বুদ্ধি-কৌশলে নৌকা থেকে পালিয়ে দীর্ঘ নদী সাঁতরে নিজের জীবন বাঁচান এবং কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে কলকাতায় চলে যান। আবদুল গণি শেখের কনিষ্ঠ পুত্র মোক্তার শেখ আগুনে পুড়ে নিহত হন। এখনও সেই মৃত্যু রহস্য হয়ে রয়ে গেছে। এটা সাধারণ কোনও মৃত্যু ছিল নাকি তার গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয়েছিল! কারণ মোক্তার শেখ ছিলেন বয়সে ছোট। তার বাবা-ভাইয়ের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণস্বরূপ পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে। তবে এর মীমাংসিত কোনও উত্তর নেই।
তার মেজো ভাই মোহা. উকিল উদ্দিন শেখ মনে করেন, এটা দূর্ঘটনাও হতে পারে, আবার পরিকল্পিতভাবে হত্যাও হতে পারে। প্রকৃত সত্যটা এখন আর বের করা সম্ভব নয়। তবে মনের ভেতর নানা প্রশ্ন তো হয়ই।
সুদর্শন চেহারার অধিকারী আবদুল গণি শেখ এলাকায় দাপুটে লাঠি খেলোয়াড় ছিলেন। এটা একদিকে যেমন খেলা ছিল, আরেক দিকে ছিল শত্রুকে দমনের বড় হাতিয়ার। আবদুল গণি শেখের লাঠির মারের প্যাঁচ ছিল কঠিন, তার লাঠির আঘাত ছিল অপ্রতিরোধ্য। তিনি তার সন্তানদেরও লাঠি খেলায় পারদর্শী করে গড়ে তুলেছিলেন। কুস্তি খেলাতেও তিনি ছিলেন সেরা। তাকে পরাজিত করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। যে কারণে তিনি ‘গণি মাল’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তার খ্যাতির আলো বহু দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আবদুল গণি শেখ কবিগান জারিগান সারিগান পালাগান এসবের ভক্ত ছিলেন। নিজের বাড়িতে এসবের আয়োজন করতেন। কয়া গ্রামের বিখ্যাত সন্তান ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের সাথেও তার শ্রদ্ধা-স্নেহের সম্পর্ক ছিল। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। আবদুল গণি শেখও তাকে পরম স্নেহ করতেন। তিনি কখনও ঢাকা গেলে ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতেন। ফিরে এসে বলতেন ‘আকবর কবি’র সাথে দেখা করে আসলাম। কবি তো ছাড়তে চায় না, জোর করে চলি আসলাম।’
গ্রামের বিখ্যাত এই সন্তানের কাছে ছুটে যাবার গভীর এক তাড়না অনুভব করতেন তিনি। সে সময় তো আজকের মতো ঢাকায় যাওয়াটা এতো সহজ ছিল না। তবুও তিনি কয়েকবার ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের বাড়িতে গিয়েছেন। এ যে মাটির প্রতি গভীর টান। আবদুল গণি শেখ তাকে আদর করে ‘আকবর কবি’ সম্বোধন করতেন। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের সঙ্গে আবদুল গণি শেখের মেজো ছেলে মোহা. উকিল উদ্দিন শেখেরও শ্রদ্ধা-স্নেহ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আকবর হোসেনকে তিনি বড়ভাই মান্য করতেন। তিনিও উকিল উদ্দিন শেখকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন।
আবদুল গণি শেখ মুখে মুখে কবিতা বানাতে পারতেন এবং তা শোনাতে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় আমারও তার মুখে সেসব কবিতা শোনার দূর্লভ সৌভাগ্য হয়েছে। আমাদের আদর করে কাছে বসিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কবিতা বলতেন। কালস্রোতে সেসব ভেসে গেছে। সে সব এখন আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়। আমরা যে পারিবারিকভাবে সাহিত্য-অনুরক্ত, তা হয়তো আমাদের পিতামোহেরই রক্তস্রোতের ধারা থেকে প্রাপ্ত।
আবদুল গণি শেখের পিতা ছিলেন মিয়াজান শেখ। তিনিও সাহসী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মিয়াজান শেখের পিতার নাম মিলন শেখ। মিলন শেখের বাবার নাম ছিল লবন শেখ। লবন শেখের বাড়ি ছিল মাছপাড়া গ্রামে। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কয়া গ্রামে চলে আসেন। মিয়াজান শেখের জন্ম কয়া গ্রামে। তার চার পুত্র দুই কন্যার মধ্যে আব্দুল গণি শেখ ছিলেন সবার বড়। তিনি আমার পিতামহ। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আদর্শ ও দেশপ্রেমের দীপ্তশিখা জ্বালিয়ে রেখে গেছেন, সে আলোতেই সুন্দরের অবগাহনে আমাদের নিত্য পথ চলা।
(লেখক: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ)
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।