ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আমরা সচেতন হলেই সমাজে পরিবর্তন আসবে

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার

প্রকাশিত : ১৫:৫৭, ১১ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ১৩:৫৩, ১৯ মার্চ ২০২১

Ekushey Television Ltd.

২০০০ সাল। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সে সময় গাইনি ওয়ার্ডে প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একটি মেয়ে মারা গেল। ডাক্তার নার্স সবাই মিলে আমরা খুব চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই রক্তক্ষরণ বন্ধ করা গেল না। বাঁচানো গেল না মেয়েটিকে। 

সেই রাতে আমি আর ঘুমাতে পারলাম না। বার বার শুধু মনে হচ্ছিল— মাত্র ১৮ বছর বয়স মেয়েটির, মা হতে গিয়ে সে এভাবে মারা গেল। আমরা কিছুই করতে পারলাম না!

সন্তান জন্মদানকালে পৃথিবীতে যত মা মারা যায়, তাদের প্রতি তিন জনের একজনের মৃত্যুর প্রধান কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। আমাদের দেশেও শতকরা ৩১ ভাগ মাতৃমৃত্যুর কারণ এটি। এসময় মায়ের রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব হলেই তাকে বাঁচানো যায়।

এ-বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় এক ধরনের বেলুন দিয়ে রক্তপাত বন্ধের কৌশল শেখানো হয়েছিল আমাদের। ইংল্যান্ড থেকে আনা সেই বেলুনটির দাম ৩০০ ডলার, কিন্তু মাত্র একবারই এটি ব্যবহার করা যাবে। আমাদের মতো একটি দেশের জন্যে যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। 

সেই মেয়েটি যেদিন মারা গেল, আমার শুধু মনে হচ্ছিল, বেলুনটি থাকলে হয়তো আজ মেয়েটি প্রাণে বেঁচে যেত। এরকম নানান চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন, হঠাৎ মনে হলো, কনডম তো একটা মেডিকেল টুল। আর এটি সুলভ ও সাশ্রয়ী। বেলুনের জায়গায় কি এটা ব্যবহার করা যেতে পারে না? তাতে যদি কিছু কাজ হয়!

এ ঘটনার একদিন পরেই আমি ওয়ার্ডে রাউন্ড দিচ্ছিলাম। জানতে পারলাম, সিজারিয়ান অপারেশনে একজন মা মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছেন, কিছুতেই তার রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে জরায়ু অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ রোগীর ক্ষেত্রেও সেই প্রস্তুতিই চলছিল। আমি অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে বললাম, শেষ একটা চেষ্টা করে দেখি তো! রোগীর জরায়ুতে একটি কনডম প্রবেশ করিয়ে তাতে স্যালাইন ভরে ওটা ফোলানো হলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হলো। রোগী বেঁচে গেল!

সহকর্মী ডাক্তারদের নিয়ে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করলাম পরের বছরের জানুয়ারি থেকে। একে একে ২৩ জন মৃত্যুপথযাত্রী প্রসূতি মায়ের ক্ষেত্রে আমরা এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলাম এবং সফল হলাম। ২০০৩ সালে আমাদের গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রথম প্রকাশিত হলো। ২০০৫ সালে এ-বিষয়ক গবেষণা-প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনোকোলজি এন্ড অবস্টেট্রিকস-এর জার্নালে। 

এভাবেই উদ্ভাবিত হলো সায়েবা’স মেথড। এরপর আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্যে। 

বর্তমানে বাংলাদেশসহ ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের গাইনি চিকিৎসায় ও মেডিকেল পাঠ্যসূচিতে কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হিসেবে যুক্ত হয়েছে সায়েবা’স মেথড। এসব দেশে হাজার হাজার দরিদ্র মায়ের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করছে এটা। আমাদের জন্যে যা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আমি মনে করি, এখানে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই, এটা সম্ভব হয়েছে আল্লাহ তায়ালার করুণা এবং আমার রোগীদের আন্তরিক দোয়ার ফলে।

এদেশের মায়েরা অনেক দিক থেকে অসহায়। এই উপলব্ধিটা আমার হয়েছে মেডিকেলে কলেজে পড়তে এসে। যদিও আমি কখনো ডাক্তার হতে চাই নি। কিন্তু আমার বাবার ইচ্ছে ছিল, চিকিৎসক হয়ে আমি মানুষের জন্যে কিছু করব। মূলত তার অনুপ্রেরণাতেই আমি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। প্রথম দুই বছর মেডিকেলের পড়ায় কোনো আগ্রহ পাই নি। চলেও এসেছিলাম কয়েকবার। কিন্তু থার্ড ইয়ারে যখন রোগীদের সংস্পর্শে এলাম, তখন থেকে আর কোনো দ্বিধা কাজ করে নি। রোগীদের অসহায়ত্ব দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, এদের জন্যে আমাকে কিছু করতে হবে।

আজ জীবনের এই প্রান্তে এসে আমি মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করি। তারা যদি আমাকে উৎসাহ না দিতেন, তাহলে আমাদের দেশের অসহায় মায়েদের জন্যে কিছু করার সুযোগ আমার হতো না। অভিভাবকদের সিদ্ধান্তগুলো কখনো কখনো সন্তানদের ভালো লাগে না। কিন্তু তারা যে কথাগুলো বলেন তা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেন।

প্রসূতি মায়েদের জন্যে কাজ করতে গিয়ে আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, গর্ভকালীন সময়ে সারাক্ষণ বিশ্রাম নেয়াই হচ্ছে পরিচর্যা। এটি ভুল ধারণা। অতিরিক্ত পরিশ্রম যেমন গর্ভবতী মায়ের জন্যে ক্ষতিকর, তেমনি ক্ষতিকর অতিরিক্ত বিশ্রামও। স্বাভাবিক চলাফেরা ও দৈনন্দিন কাজগুলো করাই স্বাস্থ্যসম্মত। 

কারো কারো আবার ধারণা, সন্তানসম্ভবা মাকে অনেক বেশি পরিমাণে খেতে হবে। এটাও ঠিক নয়। মায়ের সুস্থতা ও শিশুর বিকাশে সাধারণ পুষ্টিকর খাবারই যথেষ্ট। আর মায়ের শৈশবকালীন স্বাস্থ্য তার গর্ভাবস্থাকে প্রভাবিত করে। তাই একজন কিশোরীর পুষ্টি-পরিচর্যার ব্যাপারে পরিবারকে মনোযোগী হতে হবে। কিশোরীর যত্ন নেয়ার অর্থ হলো, তাকে একজন সুস্থ মা হতে সাহায্য করা।

এর পাশাপাশি দরকার নিরাপদ প্রসব। চিকিৎসক হিসেবে বলব, মাকে বাঁচিয়ে একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারার যে আনন্দ তা অতুলনীয়। পৃথিবীতে এর মতো আনন্দ আর হয় না। কিন্তু অদক্ষ ধাত্রীর হাতে অনিরাপদ প্রসবের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মা ও শিশুর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র মায়েরাই এর শিকার। এতে পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। 

এমনই একটি রোগ ফিস্টুলা। যার অন্যতম কারণ বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত প্রসব। এ ধরনের রোগীদের প্রস্রাব-পায়খানার ওপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় তাদের। এই রোগীরা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না, কেউ কাজেও রাখে না তাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীরা তাদের ত্যাগ করে। অধিকাংশের জীবনই কাটে নিদারুণ অবহেলা আর বঞ্চনায়।

আমার সবসময়ই ইচ্ছা ছিল এই দুস্থ মায়েদের জন্যে কিছু করার। এ লক্ষ্যেই গড়ে তুলি মাম’স ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা এন্ড ওমেনস হেলথ। এখানে ফিস্টুলা রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। থাকা-খাওয়া-অপারেশনসহ সবরকম সেবাই তারা এখানে পেয়ে থাকেন।

ফিস্টুলার একমাত্র চিকিৎসাই হলো অপারেশন। আর গাইনিতে যত ধরনের অপারেশন আছে, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে কঠিন। এ রোগটা যেহেতু গরিব মায়েদেরই বেশি হয়, তাই এ-ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই ডাক্তারদের নিজেদের টাকা খরচ করেই অপারেশন করতে হয়। ফিস্টুলা রোগীদের ও নিঃস্বার্থ এই ডাক্তারদের জন্যে আমি কোয়ান্টাম পরিবারের সবার কাছে বিশেষভাবে দোয়া চাই। সবাই দোয়া করবেন, মৃত্যুর আগে যেন দেখে যেতে পারি এদেশে ফিস্টুলা আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় কোনো মহিলা কষ্ট পাচ্ছেন না, নিগৃহীত হচ্ছেন না। 

আর আমাদের সকল রোগীর পক্ষ থেকে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম এবং কোয়ান্টামের রক্তদাতাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ মাম’স ইনস্টিটিউটে রোগীদের জন্যে যে রক্তের প্রয়োজন হয়, তার শতকরা ৯০ ভাগই আমরা পেয়ে থাকি কোয়ান্টাম থেকে। প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ চিকিৎসায় প্রথম প্রয়োজন হলো রক্ত। তখন রক্ত না পেলে মাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।

একটা সময় নিরাপদ রক্ত পাওয়া মোটেই সহজ ছিল না। সে-সময় পেশাদার রক্ত-বিক্রেতাদের কাছ থেকে রক্ত কিনতে হতো। এমনও হয়েছে, রোগী অপারেশন থিয়েটারে কিন্তু রক্ত কেনার সামর্থ্য রোগীর পরিবারের নেই। আমরা ডাক্তাররাই তখন নিজেদের ঘড়ি, স্বর্ণের চেইন জমা রেখে ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত এনেছি। সময়মতো রক্ত না পাওয়ায় অনেক প্রসূতি মাকে বাঁচানো যায়নি এরকম বহু দুঃসহ স্মৃতি আমাদের কষ্ট দেয়।

স্বেচ্ছা রক্তদান, গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের পরিচর্যা এবং মাতৃমৃত্যু রোধে আমাদের সবার সচেতনতা প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, আমরা প্রত্যেকে সচেতন হলেই সমাজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে।

এসএ/
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি