ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে

অধ্যাপক ড: মোহাম্মদ কায়কোবাদ

প্রকাশিত : ১৫:২১, ১৯ মার্চ ২০২১

গত শতাব্দীর বিশ্বখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান গণিতবেত্তা পল আর্ডশ। তাকে নিয়ে একটা কথা প্রচলিত ছিল— তার যাবতীয় সম্পদ একটা মাত্র টিনের বাক্সেই রাখা যেত, যা নিয়ে তিনি ক্রমাগত এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াতেন। বছরজুড়ে বিশ্বের অন্তত ৭০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে অংশ নিতেন। ওসব সেমিনারে তার পাশে কেউ দেড়-দুই মিনিটের বেশি বসতে পারত না। বিজ্ঞানীরা যিনি যে সমস্যার সমাধান করতে পারতেন না, তিনি সেই সিটে বসে সেটা আর্ডশকে বলতেন। শুনে তিনি একটুক্ষণ ঝিমাতেন, তারপর মিনিট দুয়েক পরেই সমাধানটা বলে দিতেন এবং ওটাই একটা রিসার্চ পেপার হয়ে যেত।

একদিন শুনি, পল আর্ডশ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। আমি তখন ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়াতে ডক্টরেট করছি। আর্ডশকে অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব পেল যে দুজন, তার মধ্যে আমি একজন। ভদ্রলোককে সেই আমার প্রথম দেখা। গাড়ি থেকে নামলেন খুবই ছোটখাটো একজন মানুষ। পুরু লেন্সের চশমা দিয়ে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্ন ‘হোয়াট ইজ ইওর প্রবলেম?’

একজন আগন্তুকের প্রতি সাধারণত ওটাই হতো তার প্রথম বাক্য। প্রবলেমটা বললাম। মিনিটখানেক পর তিনি বললেন, ইট ইজ আ ভেরি ডিফিকাল্ট প্রবলেম। একসময় তিনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। যতদূর বুঝলাম নামটা তার পছন্দ হলো না। বললেন, কলকাতা পর্যন্ত গেলেও বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ হয় নি। খুব গরিব দেশ। আমি বললাম, আপনি কীভাবে দেখছেন তার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশ গরিব কিনা। অস্ট্রেলিয়া আমাদের চেয়ে ৮৭ গুণ বড় দেশ। কিন্তু প্রতি বর্গকিলোমিটারে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের জনঘনত্ব বেশি। আমার উত্তর শুনে তিনি বেশ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

আমরা আসলেই গর্ববোধ করতে পারি সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদে এত ছোট জায়গায় এত মানুষ নিয়ে আমরা টিকে আছি। আমাদের গর্ব করার আরো কারণ আছে। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে অবস্থা তাতে আমাদের ছেলেমেয়েদের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে গিয়ে কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান পারার কথা নয়। কিন্তু ওরা ঠিকই পারছে।

লেখাপড়ায় ভারতের অনেক নামডাক। কিন্তু পদক তালিকায় তারা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে। এবছরই ইরানে অনুষ্ঠিত ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে আমরা ব্রোঞ্জ পেয়েছি চারটা, আর ভারত তিনটা। ১৯৯৯ সালে আইআইটি কানপুরে গেলাম প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইবিএম ইন্ডিয়ার প্রধান বললেন, ১৯৯৮-এ বিশ্বসুন্দরী হয়েছে ভারত থেকে। আগামীকাল প্রমাণ করব মেধায়ও আমরা শ্রেষ্ঠ। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলো বুয়েট আর রানার-আপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান যেন পরিণত হলো শোকসভায়। পরের বছরও একই ফলাফল করলাম আমরা।

আসলে সময় এখন বাংলাদেশের। বিশ্বসেরা হওয়ার মেধা আমাদের ছেলেমেয়েদের আছে। তাদের প্রাণশক্তিও অনেক। এই প্রাণশক্তি নিয়ে একটু চেষ্টা করলেই আমরা বহুদূর যেতে পারি। কোরিয়া যেমন পেরেছে। জ্ঞানবিজ্ঞানে ওরা দারুণ উন্নতি করেছে। তাদের ভদ্রতাবোধও অসাধারণ। চলন্ত সিঁড়িতে কারো হয়তো খুব দ্রুত যাওয়া দরকার। তিনি সামনের জনকে ‘এক্সকিউজ মি’-ও বলবেন না। চুপচাপ পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবেন, সামনের যাত্রী কোনোভাবে যদি জায়গা ছেড়ে দেয়ার কথা নিজে থেকে বুঝতে পারেন, এই আশায়।

কোরিয়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দেখেছি, কোনো মা হয়তো তার সন্তানকে নিয়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য রাস্তায় চলে যাওয়ার সময় সেই মা তার সন্তানকে বলবেন হাত নেড়ে সে যেন আমাকে বিদায় জানায়। এটাই তো উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি। এখানেই আমাদের উন্নতি প্রয়োজন।

সেইসাথে কমাতে হবে আমাদের অপচয়-প্রবণতা। এদেশে যত খুশি গাড়ি কেনা যায়। সিঙ্গাপুরে, জাপানে ইচ্ছা করলেই গাড়ি কেনা যায় না। সুইজারল্যান্ডের মতো ধনী দেশে পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষ একটা ওয়াশিং মেশিন ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে। আর আমাদের দেশে প্রতি পরিবারে আলাদা ওয়াশিং মেশিন। 

পৃথিবীর অনেক দেশেই উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতির চর্চা আছে। রাশিয়াতে পড়ার সময় দেখেছি, লেনিনের জন্মদিন তারা পালন করত রাস্তাঘাট-পার্ক পরিষ্কার করে। নেতার জন্মদিন পালনের কী অভিনব পদ্ধতি! গ্রীষ্মের ছুটিতে রাশিয়ান শিক্ষার্থীরা চলে যেত সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে রেললাইন তৈরি করে তারপর যেতে হতো। শিক্ষার্থীরা ওখানে শহর নির্মাণ করে ফিরে আসত। এর মধ্য দিয়ে ওদের হৃদয়ে দেশপ্রেম প্রোথিত হতো— আমি আমার দেশের একটা শহর তৈরিতে অবদান রেখেছি! দেশ জাতি সমাজের প্রতি ভালবাসা গড়ে উঠবে এমন কর্মসূচি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো অনুপস্থিত।

পার্শ্ববর্তী দেশেও দেশপ্রেমের মাত্রাটা এমনই। একবার লক্ষ্মৌ থেকে কানপুর যাচ্ছি। গঙ্গার ওপরে একটা ব্রিজ দেখিয়ে ট্যাক্সিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কবে বানানো হয়েছে? সে গর্বের সাথে বলল, ১৯৭১ সালে এবং এটা বানিয়েছে আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা! এই হলো একজন সাধারণ ট্যাক্সিচালকের দেশপ্রেম! আমরা এমন কয়টা ব্রিজ বা ভবন দেখিয়ে এভাবে বলতে পারব যে, এটা আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা বানিয়েছে?

আমাদের তাই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমরা যদি বুঝতে পারি আমাদের অবস্থান কোথায় তাহলে বুঝতে পারব কোনদিকে হাঁটতে হবে, কোনদিকে আমাদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। 

আমাদের নাগরিকদের মধ্যে আজ এমন একটা সচেতনতা দরকার যারা সমাজের উন্নতি কীভাবে হবে সেটা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিন্তা করবে। শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিকভাবে দৃঢ় হবে। দেশের সীমিত সম্পদ ব্যবহারে পরিচয় দেবে উদ্ভাবনী শক্তির। 
লেখক : কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শিক্ষক, কলামিস্ট এবং লেখক

লেখাটি লেখা হয়েছে ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি