আমাদের ধর্মবোধ ও ঈদ আনন্দের ইতিকথা
প্রকাশিত : ১৫:৩২, ২৪ মে ২০২০
গোলাম সারোয়ার
পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষ আছে প্রায় সাত’শ আশি কোটি আর ধর্ম আছে প্রায় চার হাজার দু’শটি। এ বছর বিশ্বের সব ধর্মের বর্ণের মানুষ নোবেল করোনা ভাইরাসের কারণে উদ্বেগে আছেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ আছেন স্বেচ্ছায় কারাবাসে। মানুষ জীবন বাঁচাতে জীবিকার তাড়না ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু জীবিকা ছাড়া যে মানুষ বাঁচতে পারবেনা। তাই মানুষকে ভাইরাসের বাস্তবতা মাথায় রেখেও বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে একদিন। এরকম পরিস্থিতিতে মুসলমানদের ঘরে এসেছে ঈদুল ফিতরের মতো একটি বড় ধর্মীয় উৎসব।
বিশ্বের মানুষ নানান ধর্মবিশ্বাস মতে জীবনযাপন করেন, আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। কিছু মানুষ অবশ্য প্রচলিত কোন ধর্মকেই মানেন না। তারা পালন করেন মানবধর্ম। এরকম মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। নাস্তিকতাবাদ, অজ্ঞেয়বাদ, ইহবাদ, জুচে মিলে পৃথিবীতে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় একশ দশ কোটি, বাকিরা ধর্মপ্রাণ। পৃথিবীতে মানুষ যে বিশ্বাসেরই হোকনা কেন প্রতিটি মানুষ আনন্দ, উল্লাস আর উচ্ছ্বাস পালন করে থাকে। বিভিন্ন বিশ্বাসের আছে বিভিন্ন পর্ব, পার্বণ আর উৎসব।
ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী মানুষের সংখ্যা মোতাবেক পৃথিবীর প্রধান চারটি ধর্ম হলো খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু এবং বৌদ্ধ। পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মের অনুসারী আছেন প্রায় ১৮০ কোটি। সে হিসেবে পৃথিবীতে প্রতি একশ জন মানুষের মাঝে মুসলমান আছেন প্রায় ২৪ জন। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্তত ১৮০ কোটি মানুষের একটি একক উৎসব হলো ঈদের উৎসব। মুসলমানদের ঈদ দুটি। একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আযহা। একমাস রোযা পালনের পর পহেলা শাওয়াল ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। তার দু'মাস দশ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আযহা। ‘শাওয়াল’ একটি আরবি মাসের নাম। শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে পরেরদিন ঈদ। ‘ঈদ’ শব্দটির অর্থ হলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ-উৎসব। ঈদ অর্থ বার বার ফিরে আসাও বুঝায়। ঈদ নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে, তা প্রতি বছর নতুন সুখ ও আনন্দ নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে।
নবুয়তের প্রথম দিকে এক সঙ্কটময় মুহূর্তে মহানবীকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে হয়। সে ঘটনা থেকে আরবীতে হিজরি সন গণনা করা হয়। হিজরি মাস গণনা করা হয় চাঁদ দেখা সাপেক্ষে। ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় লাইলাতুল জায়জা, যার অর্থ হলো পুরস্কার রজনী। আমাদের দেশে ঈদের আগের রাতটিকে বলে ‘চাঁদ রাত’। আর এ রাত মুসলিম শিশু-কিশোরদের আনন্দের রাত। তারা আসন্ন ঈদের উত্তেজনায় বিভোর থাকে এ রাতে। একমাস রোজার পর অবশেষে আসে সেই আনন্দের দিন। ঈদের দিন রোজা রাখা কিন্তু ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু চলমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবকিছু নেই ঠিক ঠাক। এ বছর চাঁদ রাতের তাই সেই আবেদন নেই, নেই শহর নগরগুলোর সেই আলোর মিছিল।
মুসলমানরা যে ঈদ পালন করে থাকেন তা শুরু হয় মূলত মদিনাতে রাসুলের হিজরতের পর। জাহেলিয়াতের যুগে মদিনাতে দুটি উৎসব হতো। একটির নাম ছিলো নওরোজ এবং অন্যটি মিহিরজান। তখন আরবের পৌত্তলিকরা এসব উৎসবে সীমালঙ্ঘন করতো। ওকাজ মেলা হতো, যেখানে তারা অশ্লীলতায় মেতে উঠতো। ইসলাম এসব অশ্লীলতার পরিবর্তে উপহার দিলো নির্মল আনন্দের ঈদ, যা আনন্দের সাথে সাথে ইবাদতের আমেজও বহন করে। ঈদের নামাজের পর ধনী-গরীব, উচু-নিচু, সাধারণ-অভিজাত সবাই কোলাকুলি করে আনন্দে একাকার হয়। এটি এক ধরণের বৈষম্যহীন সমাজের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু বাস্তবতার প্রয়োজনে এবার আমাদের সামাজিক দূরত্ব মেনটেইন করতে হবে বলে সেই কোলাকুলিও এবার আমাদের পরিহার করতে হবে।
আমাদের দেশে মুসলিম সংস্কৃতি আসে আরবরা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে আসার পর। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক থেকে বাংলায় আরবরা আসতে থাকে। পাহাড়পুরের মহাস্থানগড়ে খননকালে খলিফা হারুনর রশিদের আমলের রৌপ্যমুদ্রা (৭৮৮-তে উৎকীর্ণ) পাওয়া যায়। এ থেকে সে সময়কালে বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলায় আরবদের আগমনের ইতিহাস জানা যায় ‘তাযকিরাতুল সোলহা’ নামের এক গ্রন্থ থেকে। শেখউল খিদা নামের একজন আরব সুফিসাধক হিজরি ৩৪১ সনে (৯২১ খ্রিস্টাব্দে) ধর্ম প্রচারের মানসে ঢাকায় এসেছিলেন। অনুমান করা হয়, শেখউল খিদা সম্ভবত চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের আমলে (৯০৫-৯৫৫ খ্রি.) বাংলায় আসেন। এছাড়া শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমি ইংরেজী ১০৫০ সালে নেত্রকোনা অঞ্চলে এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুর পরগনার রামপালে আস্তানা গেড়ে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনে এবং সঙ্গীসাথীদের নিয়ে নামাজ, রোজা ও ঈদ পালন করতেন। এভাবে ক্রমে ক্রমে আসা মুসলমান বণিক, ধর্মসাধক ও ইসলাম প্রচারক গোষ্ঠীর প্রভাবে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেন। নতুন ধর্মান্তরিত মুসলমানরাও ক্রমে রোজা, নামাজ ও ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করতে শুরু করেন।
১২০৪ সালে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে আসার পর থেকে বাংলায় মুসলিম শাসনের শুরু। ১২২৯ সালে দিল্লির সুলতান ইলতু্তমিশ যখন ক্ষমতায়, সে সময় থেকে পূর্ব বাংলায় নামাজ, রোজা, ঈদ ও অন্যান্য মুসলিম উৎসব ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে। ঢাকা ও আশেপাশের এলাকার ঈদ এবং রোজার ইতিহাস পাওয়া যায় ‘বাজাস্তানী গাইবী’ গ্রন্থে। বইটি লিখেছেন মির্জা নাথান। মির্জা নাথান ঢাকায় আসেন ১৬০৮ ইংরেজী সালে সুবেদার ইসলাম খাঁর সাথে।
আমাদের মনে আছে, ইসলাম খাঁ মুঘল শহর ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ১৬১০ সালে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও সপ্তদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রের কবিতায় মুসলমানদের রোজা পালন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মুকুন্দরামের বর্ণনায় শরিয়তি ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা পাওয়া যায় তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে। তিনি লিখে যান, ‘…প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ে’। ভারতচন্দ্রের কবিতায় ধর্মের সাথে ধর্মের মিলনের কথার মাঝে পাওয়া যায় রোজার কথা। যেমন-‘দেবদেবী পূজা বিনা কি হবে রোজায়’- অন্নদামঙ্গল।
মুঘল আমলে ঈদের চাঁদ দেখা ছিল এক আনন্দের ব্যাপার। চাঁদ দেখা যাওয়ার বিষয়টি মানুষকে জানানোর জন্য তোপধ্বনি করা হতো। আর দূরদূরান্তের মানুষকে চাঁদ দেখা যাওয়ার সংবাদ জানানোর জন্য ভারী কামান দাগা হতো। ঈদের নামাজ আদয়ের জন্য ঈদগাহ নির্মাণের কৃতিত্বও মুঘলদের। ঢাকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেন, বাংলার সুবাদার শাহ সুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাশেম ১৬৪০ সালে ঢাকা শহরের ধানমণ্ডি এলাকায় একটি ঈদগাহ নির্মাণ করেন। তবে মুঘলদের সময় ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন গরীবদের জন্যে ঈদের আনন্দ ছিলোনা। মানুষ ছিল কৃষিজীবি, অভাবী। ঈদের আনন্দ করার মতো মানসিকতা বা সামর্থ্যও তাদের ছিলোনা। সনাতন ধর্মালম্বীদের যারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তারা ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। শান শওকতের সাথে ঈদের উৎসব করার মতো এদের সঙ্গতিও ছিলোনা। তবে ধীরে ধীরে তারা তাদের মতো করে নিজস্ব সংস্কৃতির মিশেলে ঈদের আনন্দে হা-ডু-ডু খেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, বর্ষাকালে ঈদ হলে নৌকা বাইচ জুড়ে দিয়ে আনন্দ করতো।
ঢাকায় তিনটি উৎসবে আনন্দ মিছিল হতো। এগুলো ছিলো হিন্দুদের জন্মাষ্টমি মিছিল, শিয়াদের মহররমের তাজিয়া মিছিল এবং ঢাকাবাসীর ঈদ মিছিল। বাংলায় এখন ঈদের অর্থনীতিই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। অনেক ব্যবসায়ীর সারা বছরের ব্যবসার প্রধান আকর্ষণ হলো রোজার মাস। বাংলাদেশে এখন পনের রোজার পর থেকে মার্কেটগুলোতে ঠাঁই নাই। এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে অঢেল অর্থ। যেকোন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন কোন উৎসবে অংশগ্রহণ করে তখন সে উৎসব হয়ে ওঠে ওই অঞ্চলের প্রাণের উৎসব। গতকয়েক বছর ধরে টিভি চ্যানেলগুলো ঈদের আগে-পরে সাত-আট দিন যাবত অনুষ্ঠান প্রচার করতো। কারণ বাঙালিরা সংস্কৃতিগতভাবেও ঈদকে আপন করে গ্রহণ করেছেন।
মানুষ ধর্মের কারণে অনেক মহৎকাজ করেছেন, ধর্মের কারণে অনেক বিভেদের সৃষ্টিও করেছেন। পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস নামক মহামারী আসার পর মানুষকে আবারো স্মরণে আনতে হলো, মানব জাতির সমস্যা ও সম্ভাবনা এক। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষই মানুষের আপনজন। এই মন্ত্রবাণী যদি মানুষ মনেপ্রাণে গ্রহণ করে তবে পৃথিবী থেকে অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে যাবে। জাতিতে জাতিতে শান্তি সহিষ্ণুতা ফিরে আসবে।
পৃথিবীতে মানুষের যুগে যুগে বহু বিপদ এসেছে, বহু মহামারী এসেছে। মানুষ সম্মিলিতভাবে সেসব মোকাবেলা করে এসেছে। কোন মহামারীরই ক্ষমতা নেই পৃথিবীর সব মানুষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করার। আজকের পৃথিবীতে আমরা যারা আছি তারা হাজার বছর ধরে যেসব মানুষ অগণিত বিপদআপদ মহামারী মোকাবেলা করে জয়ী হয়েছিলেন তাদেরই সন্তান। আমাদের জিনে-বংশানুক্রমে আছে বিজয়ের গোপন মন্ত্রধারা। সেই বিজয়ী জাতির সন্তান হিসেবে আমরা এবারো নিশ্চয় বিজয়ী হবো। ইতিহাসের ভিন্নধর্মী এই ঈদ বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ ও স্বস্তিময় বিশ্ব।
লেখক- গবেষক ও কলামিস্ট।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।