ঢাকা, সোমবার   ৩১ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আমার পাঠাগারবাস

সমর ইসলাম

প্রকাশিত : ২১:৫৩, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ | আপডেট: ০৮:৩৭, ২০ ডিসেম্বর ২০২০

Ekushey Television Ltd.

কথা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নিউজরুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন, ঢাকা।

প্রাণি ছাড়াও পৃথিবীতে সব ধরনের বস্তুর নিজস্ব গন্ধ থাকে। সবার ঘ্রাণশক্তি সমান নয়। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ঘ্রাণ পেয়ে থাকে। যেমন- ছাত্রজীবনে শিক্ষার্থীরা নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পায়। আর তা প্রায় সবার কাছেই বেশ মোহনীয়। তবে পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ সবাই পায় না বা পেতে চায় না। যারা পায় বা চায় তারা সংখ্যায়ও অনেক কম। 

আর এটা পাওয়ার জন্য বইয়ের নিজস্ব সংগ্রহশালা থাকতে হয় অথবা যেতে হয় পাঠাগারে। যেখানে সেলফের তাকে থরে থরে সাজানো থাকে বই। বলতে দ্বিধা নেই- জ্ঞানান্বেষী ছাড়া এই কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না।

বই জ্ঞানের বাহন। চিন্তার অগ্রসরতা ছাড়াও মনে নতুন নতুন ভুবন তৈরির জন্য বইয়ের চেয়ে উত্তম উপায় আমার জানা নেই। আমি তাই বইপাগল ছেলেবেলা থেকেই। কারণ বুঝতে শেখার পর থেকে পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক নানা অসঙ্গতি, বৈষম্য, ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা, অপ্রাপ্তির বেদনাবোধসহ সকল কিছু ভুলে নিজের তৈরি ভুবনে ডুবে থাকার মতো আনন্দ আর কিছুতে পাইনি। আর নিজের ভুবন তৈরির জন্য আমি বইকেই পেয়েছি সবচেয়ে সহজলভ্য উত্তম ও কার্যকর উপায় হিসেবে। কিন্তু সম্প্রতি পেশাগত ব্যস্ততা আর ভার্চুয়াল আসক্তি সেই আমাকেও পাঠাগার থেকে অনেকখানি দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

ঢাকা আসার আগ পর্যন্ত আমাদের এলাকায় কোনও পাঠাগার গড়ে ওঠেনি। সামর্থের অভাবে বই তেমন কিনতে পারতাম না। নিজের খরচ বাঁচিয়ে টুকটাক কেনা হতো। স্কুল-কলেজ বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পাওয়া পুরস্কার আর আত্মীয়-স্বজনদের থেকে চেয়ে চিন্তে প্রায় শ’পাঁচেক বইয়ের সংগ্রহ গড়ে ওঠে আমার। সে সময় মোফাজ্জল আনসারীসহ দু’তিন জন বন্ধু প্রিয়জনের সংগ্রহ আমার চেয়ে রিচ ছিল। সেগুলো ধার-বিনিময় করে পাঠক্ষুধা মিটিয়েছি। কিন্তু কলেজে ভর্তি হবার পর মননপূর্তি করে সে ক্ষুধা মিটিয়েছে শহীদ বেলাল গণপাঠাগার।

অনেক সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার। জানা-অজানা কতশত বই। চাইলেই পাওয়া যায়। আমাকে নেশায় পেয়ে বসে। এতটা আসক্ত হয়ে পড়ি যে, পাঠ্যবই আমার অস্পর্শ হয়ে ওঠে। এর জন্য অনেক বড় মাশুলও আমাকে গুণতে হয়। সে প্রসঙ্গ অন্য একদিন।

বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ দেখে পাঠাগারের প্রাণপুরুষ মো. শামছুল হক সবক’টা আলমারি আমার জন্য অবারিত করে দেন। এই সুযোগটা সে সময় বেলাল পাঠাগারের খুব কম সদস্যই পেয়েছেন। বই সংরক্ষণ ও ছেঁড়াফাঁড়া বই মেরামত কাজ অর্থাৎ বই বাঁধাইয়ের কাজও তিনি আমাদের কয়েকজনকে শিখিয়ে ছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার এই কাজটা আমরাই করতাম।

আমার বাড়ি থেকে গফরগাঁওয়ের দূরত্ব প্রায় ছয় মাইল। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার বিকেলে সাইকেলে করে চলে আসতাম পাঠাগারে। রাতে কিছুটা সময় দু’তিন জন মিলে বইয়ের যত্ন নিতাম। তারপর লম্বা টেবিলে শুয়ে রাতভর ইচ্ছেমতো বই পড়তাম। সকালে পদ্মপাপড়ি কচি-কাঁচার মেলার নানা প্রশিক্ষণ চলতো। গান, নাচ, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞানসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। সেসবের কয়েকটাতে অংশ নিয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরতাম। আর এমনটাই নিয়মিত চলছিল প্রায় দুই বছর।

আমি তখন আট বছর আগে ঝিমিয়ে পড়া পাঁচবাগ নীলতারা কচি-কাঁচার মেলাকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে হাত দিলাম। গত শতকের শেষার্ধে গফরগাঁওয়ের সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন মরহুম মো. শামছুল হক। তাঁর সান্নিধ্যে আমার সাংবাদিকতারও হাতেখড়ি। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি জাতীয় একটি দৈনিকের উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে নিয়োগ পাইয়ে দেন। 

আর এই শামছুল হকের মুখেই শুনেছিলাম- আমাদের এলাকার সে সময়ের একনিষ্ঠ কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মীর নাম। তার মধ্যে অন্যতম- ফাইজুস সালেহীন ও তুষার কান্তি সরকার। ফাইজুস সালেহীন পেশা হিসেবে সাহিত্য-সাংবাদিকতাকেই বেছে নেন। আর তুষার কান্তি সরকার এখন লন্ডনে; প্রবাসকে নিবাস করেছেন। গফরগাঁওয়ের কথা ও কাহিনীতে তাদের কর্মকুশলতার পরিচয় পাই।

কথায় বলে- রতনে রতন চেনে...! তেমনি কাছাকাছি সময়ে পৃথিবীতে আসা সৃষ্টিশীল মানুষেরাও কোনও না কোনওভাবে একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে যায়। আমি খুব পলায়ণপর মানসিকতার মানুষ। কারও সাথে পরিচিত হওয়ার মতো কোনও পরিচয়ও আমার তেমন নেই। কিন্তু কাজের প্রয়োজনেই গফরগাঁওয়ের এক সময়ের সাহিত্য-সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িতদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। 

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা কোনও কর্মসূচি না থাকলে যা হয়। দীর্ঘদিন ধরে গফরগাঁওয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বেশ ঝিমিয়ে আছে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাবে বিভিন্ন মত-পথের সাস্কৃতিক কর্মীরাও একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে আমরা যারা দূরে থাকি তারা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি।

সেই বিচ্ছিন্নতাকে যুক্ত করতে মজবুত সুঁতো হয়ে সামনে এসেছে মুসলেহ উদ্দিন ফাউন্ডেশন ও পাঠাগার। এর কর্ণধার মরহুম শিক্ষাবিদ মুসলেহ উদ্দিন সাহেবের পরিবারের সদস্যরা। শিক্ষা-সাস্কৃতিক অঙ্গনে এই অঞ্চলের অগ্রসর পরিবার এটি। তাদের মধ্যে সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক ফাইজুস সালেহীন এবং সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, কবি ও গদ্যশিল্পী ড. আহমেদ মনিরুস সালেহীন অন্যতম। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অনেক বছর পর নড়েচড়ে বসেছে এই অঞ্চলের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গন। সকল মত-পথের সাংস্কৃতিক কর্মীদের আনাগোনায় মুখরিত মুসলেহ উদ্দিন ফাউন্ডেশন পাঠাগার।

১৩ ডিসেম্বর রোববার। একদিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর বন্ধু মোফাজ্জল আনসারী ও ছোট ভাই আকিব খানের সঙ্গে মুসলেহ উদ্দিন ফাউন্ডেশন পাঠাগারে গেলাম। বাড়ির কাছে হলেও এই পাঠাগারে এটাই প্রথম আসা। কারণ পাঠাগারটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার কিছুদিন আগেই জীবিকার প্রয়োজনে আমাকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। ফলে এটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।

লাইব্রেরিয়ান ফয়সাল মিয়া আমাদের অভ্যর্থনা জানায়। শেষ হেমন্তের সন্ধ্যা রাতে ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালা হাতে ধরিয়ে দেয় ফয়সাল। তা হাতে নিয়ে দেখি থরে থরে সাজানো অনেক বই। বড় টেবিলের চারপাশে চেয়ার পাতা। পাশেই চায়ের আয়োজন। সেলফ সার্ভিস পদ্ধতিতে যে কেউ বই পড়তে পড়তে চা পানও করতে পারেন। কী সুন্দর আয়োজন! মনটা ভরে গেলো। 

এরইমধ্যে সম্ভবত ফয়সালের মাধ্যমে শ্রদ্ধেয় ফাইজুস সালেহীন ভাই জেনে নিয়েছেন, আমাদের পাঠাগারে আসার কথা। অনেকক্ষণ ফোনে কথা বললেন। পাঠাগারে আসায় ধন্যবাদও জানালেন। সদস্যদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানমালা হাতে নেয়া হয়েছে। পরামর্শ দেন- কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়। 

ফোন রেখে লম্বা করে নিঃশ্বাস টানি। কারণ, অনেকদিন পর পুরনো বইয়ের গন্ধটা আবার পেলাম। আসক্ত ব্যক্তি দীর্ঘ বিরতির পর নেশার উপকরণ পেলে যেমন উতালা হয়ে ওঠে, আমার অবস্থাও ঠিক তেমন। স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠলো আমার পাঠাগারবাসের সময়টা। এই ফয়সাল মিয়ার মতোই ছোট তখন আমি। মনে মনে ভাবি- আহা, আমার ছেলেবেলায় এত কাছে এমন একটা পাঠাগার যদি পেতাম!

লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, নিউজরুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন, ঢাকা।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি