ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আমার প্রথম রান্না

লায়লা নাজনীন

প্রকাশিত : ১৬:৫৯, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

Ekushey Television Ltd.

আচ্ছা বলেন তো ‘বাঁচার জন্য খাওয়া না খাওয়ার জন্য বাঁচা?’ অবশ্যই বেঁচে থাকার জন্যই খাওয়া দাওয়ার দরকার হয়, তবে কেন সবাইকে বলতে শুনি এই পেটের জন্যই এত কাজ করা। মানুষের জীবনের মৌলিক মানবিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে খাদ্য। জীবন ধারনের জন্য এই চাহিদার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

পুরান ঢাকায় বড় হওয়ার কারণে স্বভাবত আচরণে আমি একটু ভোজ পটুয়সী। সুস্বাদু খাবারের প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বলতা রয়েছে ছোটবেলা থেকেই। স্বভাবটা পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। তিনি খুব ভোজনবিলাসী মানুষ ছিলেন। সময় পেলেই শুধু বাজার করতে যেতেন এবং প্রতিদিন মাকে নানা রকম আইটেমের খাবার রান্না করার বুদ্ধি পরামর্শ দিতেন। মায়ের হাতের রান্নারও বেশ প্রশংসা করত সবাই। আব্বা নিজে খেতে ও অন্যকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে বেশ পছন্দ করতেন। প্রতি সপ্তাহে কারো না কারো দাওয়াত থাকতো আমাদের বাসায়। 

একবার আব্বা তার বন্ধুদের স্বপরিবারে দাওয়াত দিলেন বাসায় এবং অতিথিদের চাহিদা ছিল তারা দাওয়াতে পোলাও-মাংস খাবে না। হরেক রকমের ভর্তা, ভাজি, মাছ খাবে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী সেটাই করা হলো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- খাওয়ার সময় আব্বার এক বন্ধুর ছেলের বয়স ৫/৬ হবে, সে কান্না জুড়ে দিল ‘আমি তো দাওয়াতে আসছি, আমি ভর্তা খাব কেন? ভর্তা খাব কেন? পোলাও কই? রোস্ট কই? ভ্যা ভ্যা ....’

বাচ্চারা দাওয়াত বলতে দামি খাবারকেই মনে করে, আর আমাদের ছোটবেলায় এখনকার মত এতো ‘ফার্স্ট ফুড’ ছিল না। আমরা বার্গার, স্যান্ডউইচ, পিজা এ ধরনের খাবারের সাথে এতো পরিচিত ছিলাম না। সিঙ্গাড়া, সমুচা, বিস্কুট, চানাচুর পর্যন্তই ছিল আমাদের দৌড়।

আমি তখন এসএসসিতে পড়ি। একবার এক বান্ধবীর দাওয়াতে তাদের বাসায় গেলাম। আমার সাথে আরও কিছু ওর মেহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। দুপুরে খেতে বসলাম মানুষ বেশি হওয়াতে দুই রুমে ভাগ হয়ে সবাই বসলাম, খাওয়ার সময় বান্ধবী প্লেটে মুরগীর রান তুলে দিল। আমি বেশ আরাম করে খেতে লাগলাম। মজার আর পছন্দের খাবারগুলো সবার শেষে খেতাম, কারণ মজার আইটেম দিয়ে খাওয়া শেষ করলে নাকি মুখে তার স্বাদ লেগে থাকে সারাদিন। 

যাই হোক, খাওয়ার প্রায় শেষের দিকে যেই মুরগীর রানে কামড় দিব, পাশের রুম থেকে শুনলাম এক বাচ্চার কান্নার শব্দ। পুরো বাড়ি মাথায় তুলে এক পিচ্চি বিরাট শব্দ করে কান্না করছে। আমার বান্ধবীর একটু মুখ ফ্যাকাশে করে কাঁচুমাচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিছু মনে করিসনা মুরগীর সবগুলো রানতো শেষ হয়ে গেছে আর সবার খাওয়া হয়ে গেছে। আমার মামাতো বোন মুরগীর রান ছাড়া ভাত খায় না তাতো আমি জানি না, এখন কি উপায় বলতো?’ 

কি আর করা পিচ্চির কান্না থামানোর জন্য পারলে সবাই তখন পেটের ভেতর থেকে মুরগীর রান খুঁজে নিয়ে আসে এরকম পরিস্থিতি। আর আমারটা তো অক্ষত অবস্থায় প্লেটে আছে। মুরগীর রান হেলতে দুলতে চলে গেল পাশের রুমে। আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। কি আর করার- যেই রানটা সবার শেষে মজা করে খাব ভেবেছিলাম সেই রানটা দিয়ে দিতে হলো ওই বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে। যাই হোক, যেটা আমার ভোগ করার কথা ছিল সেটা ত্যাগ করতে হলো। এরপর সেই বাচ্চার কান্না থামলো আর আমরা স্বস্তি পেলাম। ইহাকেই বলে ভোগে সুখ নাই ত্যাগই প্রকৃত সুখ।

ছোট থেকেই একটু ফাঁকিবাজ ছিলাম। বাড়ির বিভিন্ন কাজের চাপ থাকলেও সবসময় ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করতাম। আর রান্না করার অভ্যাস তো আমার কখনই ছিল না। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার পর থেকে রান্নার দায়িত্ব এসে পড়ে আমার উপর। প্রথম কয়েকদিন বুয়ার রান্না খাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হয়েছিল এমনকি আমারও হয়েছিল। কি আর করা নেমে গেলাম জীবনযুদ্ধে। প্রথমদিন খিচুড়ি রান্না করলাম। 

সেদিন আমার বান্ধবী ক্রিস্টিনা এসেছিল আমার বাসায়, কিছুক্ষণ রান্নার পর যখন চাল ফোঁটানো শুরু করলাম তখন দেখলাম পাতিল উতলে সব খিচুড়ি বাইরে পড়ে যাচ্ছে, বুঝলাম পাতিলের সাইজের থেকে চাল-ডাল বেশি হয়ে গেছে। কি আর করা তাড়াতাড়ি করে দুই বান্ধবী মিলে আরেকটা পাতিলে খিচুড়ি ঢাললাম। চারজনের জন্য রান্না করা সেই আধা কাঁচা-পাকা খিচুরি ১২ জনে খেয়েছিলাম। এই হলো আমার প্রথম রান্নার ইতিহাস।

আরেকদিনের ঘটনা। ইউটিউব এ সঞ্জীব কাপুড়ের আম রাস কি আলু রেসিপি দেখে কাঁচা আর আর আলু দিয়ে একটা তরকারি রান্না করে নিয়ে গেলাম আমার অফিসে। আমার দুই কলিগ আমাকে এটা সেটা রান্না করে খাওয়ায়, ভাবলাম আমিও তাদের খাওয়াই, যাই হোক বাকিটা ইতিহাস। আম রাস কি আলু খেয়ে তারা এটার নাম দিল ‘আম গাছ কি আলু’। বুঝেন কি ভয়ঙ্কর অবস্থা। 

তবে বেশ কয়েক বছর ধরে রান্না করতে করতে এখন এখন আমি রান্নার বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। কারণ আমি মনে করি, যে কেউ আমার হাতের রান্না খেলে খারাপ বলতে পারবে না। এখন যখন ইচ্ছা করে মন মতো বাজার করে রান্না করি। এখন আমাকে আর সবজিওয়ালাও ঠকাতে পারে না। কারণ সবজিও যাচাই-বাছাই করতে শিখে ফেলেছি। সময় এবং দায়িত্ব আমাদের সব কিছু শিখিয়ে দেয়।

আমার খাওয়া-দাওয়ার রুচি বেশ ভালো, অনেকে আমাকে দেখলে মনে করেন আমি বোধ হয় ডায়েট করি। আমার সাথে খেতে বসে আমার খাওয়ার পরিমাণ দেখলে হয়ত অনেকের চোখ কপালে উঠতে পারে! কারণ আমার শরীরের সাথে খাওয়ার পরিমাণ যায় না। আমি তিন বেলা পেট ভরে খাই। 

একবার অফিস কলিগ যাচ্ছিল নিউট্রিশনিস্টের কাছে ডায়েট চার্ট আনতে, আমাকে বললো যাবেন? আমিও গেলাম, ফেরত এসে কলিগ দু’জন নিউট্রিশনিস্টের ওপর বিরাট খ্যাপা। এমনিতেই তিন বেলা খায়, নিউট্রিশনিস্ট আমাদের ৫ বেলা খাওয়ার চার্ট দিল। অনেকের ধারণা, দুই একবেলা খাওয়া কমিয়ে দিলে মনে হয় স্লিম হওয়া যায়। 

আমার কাছে মনে হয়েছে, স্লিম হওয়ার চাইতে বেশি জরুরি সুস্থতার অধিকারী হওয়া। তার জন্য আমাদের কিছু অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত, যেমন- প্রতিদিন অন্তত ১০ গ্লাস পানি খাওয়া, ঘুম থেকে উঠে ১/২ গ্লাস কুসুম গরম পানি খাওয়া। সকালে ভারী নাস্তা করা। খাওয়ার মেনুতে কার্বোহাইড্রেডের পরিমাণ কম এবং সবজির পরিমাণ বেশি থাকা, আমিষের পরিমাণ প্রয়োজন মত রাখা উচিত। 

এছাড়া প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় ১টা ডিম কুসম ছাড়া, ১ গ্লাস দুধ, ১ বাটি সবজি, ১ বাটি ডাল, ১ টুকরা মাছ বা মাংস দুপুরের খাবারের তালিকায় রাখা যেতে পারে। তবে রাতের খাবার রাত ৮টার মধ্যেই সেরে ফেলা উচিত যদিও এটা কর্মজীবী নারীদের পক্ষে সম্ভব না। তাই রাতে হাল্কা খাবার খাওয়াই শ্রেয়। কিছু খাবার আপনার প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রাখা ভালো। যেমন- কালোজিরা, টকদই, অ্যালোভেরা, মধু। এসব খাবার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

কর্মজীবী যেসব নারীদের ছোট্ট বাচ্চা আছে রান্নার বিষয়গুলো তাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে হয়। যেমন- ছুটির ১/২ দিন তারা একটু বেশি করে রান্না করে ছোট বক্সে করে ফ্রিডআপ করে রাখতে পারেন। যেমন- সবজি এই দুইদিন কেটে ফাল্ফ বয়েল করে ফ্রিডআপ করতে পারে, মাংস হলে সেটা একদিন রান্না করে ২/৩ দিন এয়ার টাইট বক্সে-এ রেখে খাওয়া যায়। মিষ্টি জাতীয় কোন খাবারও রান্না করে ২/৩ দিন খাওয়া যায়, তবে মিষ্টি পরিহার করাই ভালো। আমার জানা মতে, মিষ্টি ক্যান্সার সেল গ্রো করতে সাহায্য করে। তাই পারতপক্ষে মিষ্টি না খাওয়াই ভালো।

একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের Body Metabolism এর ওপর আমাদের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। অনেকের বেশি খেলেও দেখবেন গায়ে লাগে না। কারণ তার Body Metabolism ভালো। আবার অনেকে কম খেলেও গায়ে লেগে যায়। চেষ্টা করবেন Regular basis এ কিছু টেস্ট করানোর জন্য। যেমন- Sugar test, BP test, Critinine test, Lipid profile। এছাড়া মেয়েদের জন্য কিছু টেস্ট করা খুবই জরুরি। যেমন- Memography যেটা তিন বছরে একবার করলেই হয় এবং servical cancer -এর টিকা দেওয়া খুবই জরুরি। 

কর্মজীবী নারীরা কাজের ব্যস্ততার কারণে ঠিকমত নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারে না। তাই তাদের সচেতন হওয়া উচিত। মাসে না হলে ছয় মাসে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। তা না হলে অন্তত বছরে একবার ডাক্তারের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। হায়াতের মালিক আল্লাহ, তিনি আমাদের নেক হায়াত দান করুন, আমাদেরকে সুস্থ রাখুন।

লেখক: হেড অফ এইচআর, স্টার সিনেপ্লেক্স।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি