আমার মা সব জানে
প্রকাশিত : ১৬:১৯, ১০ আগস্ট ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
শনি-রবিবারের সকালের জলযোগটা বারান্দাতেই সারি। সব কিছু বারান্দার টেবিলটিতে সাজাই। খেতে খেতে রাস্তার দিকে তাকাই, রাস্তার ওপারের গাছটি দেখি, দৃষ্টি ছড়িয়ে দেই দূরের সুরম্য হর্ম্যরাজির দিকে। খাওয়া সেরে কফির পেয়ালা। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি- অনেক শিশুকে নিয়ে চলেছেন হয় মা, নয় বাবা, অথবা মা-বাবা। তরুণ জনক-জননী এবং নানান বয়সের শিশু। কেউ শিশু-ঠেলুনী শকটে, কেউ মা-বাবার হাত ধরে। দেখি, মা-বাবা গল্প করছেন হাঁটতে-হাঁটতে, ঠেলছেন শিশু-শকট, আদর করছেন সন্তানদের।
একটা দৃশ্য বারে বারেই দেখি। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে মা-বাবা ও শিশুর মধ্যে বেশ গুরুতর কোন কূটনৈতিক আলোচনা হচ্ছে- মনে হয়, একটি অচল অবস্থা নিরসনের জন্যে। চলতে চলতে শিশুটি দাঁড়িয়ে গেছে। মুখ গোঁমড়া করে আছে- সে নড়বে না এক পা’ও আর। মা-বাবা প্রাণপনে বোঝাচ্ছেন হাত-পা নেড়ে। কিন্তু নট নড়ন চড়ন, নট কিচ্ছু। মনে হয় না, আরব-ইজরায়েল বৈঠকেও এতটা শক্তি ব্যয়িত হয়।
এ জাতীয় অবস্থার তিনটে ক্রম:ফল দেখেছি। এক, সব পক্ষই কোন একটা সমঝোতায় পৌঁছোয় এবং সকল অচলাবস্থার অবসানের পর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মতো পরিবারটির পদযাত্রা পুনঃরায় শুরু হয়। দুই, হাল ছেড়ে দিয়ে মা-বাবা শিশুটিকে তার নিজের হাতে ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। শিশুটি কিছুক্ষণ অনড় থেকে পুরো পরিস্থিতিটি নিজের মনে পর্যালোচনা করে। তারপর একটা পর্যায়ে সে নিশ্চিত হয় যে, মা-বাবা আর ফিরছে না। তখন উপায়ান্তর না দেখে সে মা-বাবার দিকেই দৌড়োয়। তিন, মা-বাবা রেগে গিয়ে সকল কূটনৈতিক পন্থা বাদ দিয়ে শক্তির আশ্রয় নেন এবং জোর করে শিশুটিকে হিঁচড়ে সামনের দিকে চলতে থাকেন। শিশুটির গগণ-বিদারী চিৎকার বধিরের কানেও তখন পৌঁছে যায়।
শিশুদের আচরণ আমাকে চিরকালই অভিভূত করে। তাদের কথাও আমাকে মুগ্ধ করে। সেই যে আমার জেষ্ঠ্যা কন্যা, যে তার শিশুকালে মাঠে-ঘাটে-বাটে সর্বদাই একটি কুড়িয়ে পাওয়া ডাল হাতে ধরে থাকতো। কিছুই করত না সে ঐ ডালটি দ্বারা, শুধু রাজদন্ডের মতো সে তা বহন করতো।
একবার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিশু ঠেলুনী শকটে উপবিষ্ট তার হাত থেকে তেমনি একটি ডাল কেমন করে যেন কোথায় পড়ে যায়। খেয়াল হওয়ার পরে সেই বিশেষ ডালটি আবার খুঁজে নিয়ে আসতে আমাকে পেছনদিকে প্রায় আধ মাইল হাঁটতে হয়েছিল।
‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে, তোমারে করেছে রানী’- সবার অতি চেনা গান। নজরুল গীতি- অনেকেই গেয়েছেন, তবে গানটি জনপ্রিয় হয়েছে জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে। যখন তার বয়স তিন কি চার, তখন গানটি শুনে অভূতপূর্ব এক ব্যাখ্যা দিয়েছিল আমার কণিষ্ঠা কন্যা- ‘মেয়েটার জন্যে গিফট কিনতে কিনতে ছেলেটা ফকির হয়ে গেছে, আর মেয়েটা ছেলেটার কাছ থেকে গিফট পেয়ে পেয়ে বড়লোক হয়ে গেছে।’
তাঁর গানের এমন বাস্তব ব্যাখ্যায় নজরুল মূর্চ্ছা যেতেন নিশ্চয়ই। শচীন দেববর্মণের গানে ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেনো আসনি?’ এ প্রশ্নের তার সাফ জওয়াব ছিল, ‘কাল বাস নষ্ট ছিল’।
তিনি এখন চারের কাছাকাছি। আধো আধো বোল শুরু করার কালে আমার দৌহিত্রী আমাকে ‘কাগা’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করেন। ঠাট্টা করে আমিও তাকে উল্টো ‘কোজো’ বলে ডাকতাম। আমাক ‘কাগা’ ডাকায় তার মা-বাবা দু’জনেই বিব্রত বোধ করত। দু’জনেই তাদের কন্যাকে সঠিক ডাকটি শেখানোর জন্যে উঠে পড়ে লাগতো। তারা যখন বলতো, ‘ন’ আকার ‘না’, ‘ন’ আকার ‘না’, তখন আমার দৌহিত্রীও সঠিকভাবে বলতো, ‘ন’ আকার ‘না’, ‘ন’ আকার ‘না’। কিন্তু যে মুহূর্তেই তার মা-বাবা বানান সমাপান্তে বলতো- ‘নানা’, সে মুহূর্তেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়ার মতো সে বলে উঠতো ‘কাগা’। এখন অবশ্য সে সঠিক ডাকটি ডাকতে পারে। কিন্তু এখনো সে চশমাকে বলে ‘সুনতা’। এ শব্দের উৎস কোথায়, কে বলতে পারে!
আমাদের বাড়ীতে বছর পাঁচেক আগে একটি শিশু তাঁর মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছিলো। আমি আমার পড়ার টেবিলে বসে কাজ করছিলাম। সে গুটি গুটি পায়ে আমার টেবিলের কাছে এসে আমাকে দেখছিল। আমি হাতের কাজ সরিয়ে তার সঙ্গে গপ্পো জুড়ে দিলাম। তার নাম জানতে চাইলাম, সে স্কুলে যায় কিনা জিজ্ঞেস করলাম। সে টুক টুক করে জবাব দিল। তারপর বললাম, ‘তোমার বয়স কত?’। সে সর্বাঙ্গীন গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো, ‘পাঁচ’। তারপরই তার হয়তো মনে হলো- আমি যেহেতু তার বয়স জিজ্ঞেস করেছি, আমার বয়স জিজ্ঞেস করাও তো তার ভদ্রতা। সুতরাং সে বেশ গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার বয়স কত?’। আমি ঠাট্টা করার জন্যে বললাম, ‘তিরিশ’। সে নির্বিকারভাবে তার অভিমত দিলো, ‘তা’ হলে তো তুমি বেশ বুড়ো’।
তাদের আচরনের মতো, কথার মতো, শিশুরা খুবই মজার মজার কথা লেখে। আমার কন্যাদ্বয়ের খুব কচি বয়সের কিছু লেখা আমর কাছে আছে (তার মধ্যে কবিতারও ছড়াছড়ি)। সেগুলো পড়ে চমকিত ও চমৎকৃত দুই’ই হই। বহুকাল আগে ‘Kids Sure Write Funny’ বলে একটি বই পড়েছিলাম। তার তিনটে উদাহরণের কথা মনে আছে।
একটি শিশু লিখেছিলো, ‘Dogma is the mother of dog’. Dog আর Ma এর মধ্যে এ সম্পর্ক তার আবিষ্কার। আরেকটি শিশু লিখেছিলো, ‘We shouldn’t run around the classroom even when the teacher isn’t in the class. This is because even if she doesn’t see us, Jesus does and he might tell the Principal.’
যীশুখৃষ্টকেই চুকলখোর ভেবেছে শিশুটি। তবে তৃতীয় উদাহরণটিই সবচেয়ে মারাত্মক। শিক্ষয়িত্রী তাদেরকে ভদ্রতা শেখাচ্ছেন। বলছেন, ‘You should be polite while addressing a stranger’. একটি শিশু শব্দটি ঠিক ঠাহর করতে পারে নি। সে লিখলো,’ You should be polite while undressing a stranger’. বলুন দেখি, কি কাণ্ড!
শেষে কটা স্বীকারোক্তি করি। শিশুরা তাদের কথা, লেখা, আচরণে আমাকে অভিভূত করলেও, তারা কিন্তু আমার দিকে খুব অবাক চোখে তাকায়। কেন যে এমনটা তারা করে, জানি না। তবে আমার মা একদিন বলেছিলেন যে, আমার মুখে নাকি বেশ বোকা বোকা একটা ভাব আছে আর শিশুরা নাকি বোকাদের অবাক হয়েই দেখে। এ আপ্ত বাক্যটি সত্যি হতেই হবে, কারণ প্রয়াত অদ্রীশ বর্ধনের মায়ের মতো, ‘আমার মা সব জানে’।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।