ঢাকা, বুধবার   ০২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আর যাই নি ওখানে

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৬:৩১, ১৭ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৬:৪৬, ১৭ আগস্ট ২০২০

Ekushey Television Ltd.

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

একটু অন্যমনস্কভাবেই পথ চলছিলাম। বসন্তের বিকেল- ফুরফুরে হাওয়া, ঈদের দিন, রাস্তায় রঙীন কাপড় পরিহিত শিশুদের কলকলানি। ফিরছিলাম এক বন্ধুর বাড়ী থেকে মধ্যাহ্নের গুরু ভোজের পরে। বকশীবাজারের পরিচ্ছন্ন সফেদ সাদা একতলা বাড়ীগুলো ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল বিকেলের নরম আলোয়। পারিপার্শ্বিকতা আর অন্য সবকিছু মিলিয়েই আমাকে আনমনা করে দিয়েছিল ১৯৭৪ এর সেই বিকেল।

হঠাৎ শুনি নীচু এক পাঁচিলের ওপার থেকে মেয়েলি গলার ডাক, 'এই যে ফার্স্ট বয়, কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি'? তাকিয়ে দেখি আমার সতীর্থ সমাজ বিজ্ঞানের সুলতানা আহমেদ খুকু। অনেকে খুকি বলে ডাকলেও আমি ওকে খুকুই ডাকতাম। 'ফার্স্টবয়' ডাকটির মাহাত্ম্য হচ্ছে- কিছুদিন আগে স্নাতক সন্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার সুবাদে আমার কপালে ওই ডাকটি সেঁটে দিয়েছিল খুকুই - ফাজলামো, ঠাট্টা এবং সেই সঙ্গে মমতার সংমিশ্রণ ছিল তাতে।

হেসে বললাম, 'বন্ধুর বাড়ী থেকে ফিরছি'। 'বন্ধুর বাড়ীতে গেলে কি আর বান্ধবীর বাড়ীতে আসা যায় না'? অনুযোগ করেই বলল খুকু। 'বারে, আপনাদের বাসা যে এখানে তা তো জানতাম না', বললাম আমি। 'বেশ, এখন তো জানলেন, এবার আসুনতো গেট খুলে', ডাকল ও।

আমি একটু ইতস্তত করছি দেখে অনেকটা লোভ দেখানোর মতো করেই খুকু বললো, 'এলে একটা মজার জিনিস খাওয়াবো'। আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই মাথা দুলিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, 'হাঁসের মাংস - আমি নিজে রেঁধেছি'।

এইবার পালা বদল। আমার চিরায়ত জোরহাসি ছড়িয়ে পড়ল সারা বকশীবাজারে। 'ঈদের দিনে হাঁসের মাংস- ভাবা যায় না'। 'আহা,' ভ্রুভঙ্গি করে খুকুর জবাব, 'ঢং না করে ভেতরে আসুন তো'।

খুকুর সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় ছিল, কিন্তু তা ওই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই সীমাবদ্ধ। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল না। আমাদের আলাপ-পরিচয় কচিৎ কখনো কথাবার্তা কিংবা হাল্কা হাসি-ঠাট্টার বৃত্তের বাইরে কখনো যায় নি। কিন্তু চুয়াত্তরের সেই ঈদের বিকেলে ও বড় যত্ন করে আমার সামনে তুলে ধরেছিল হাঁসের মাংস আর চালের গুঁড়োর রুটি- বোন যেমন ভাইকে খাওয়ায়, বন্ধু যেমন বন্ধুকে আপ্যায়ন করে।

এলোমেলো অনেক গল্প করেছিলাম আমরা, হেসেছিলাম প্রচুর। সন্ধ্যের দিকে যখন বেরিয়ে আসি, তখন খুকু বলেছিল,' বাড়ীতো চিনে গেলেন, আবার আসবেন'। না, আর যাওয়া হয়নি ওদের বাসায়। আসলে ঐ দিকটাতেই যাই নি আর। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট খুকু হারিয়ে গেল।

তারপর কতদিন কেটে গেছে - মাস পেরিয়ে বছর, বছর পেরিয়ে যুগ। বছর পাঁচেক আগে এক ঈদে আমার এক খালাতো বোনের সদ্য বিবাহিত মেয়ের বাড়ীতে বেড়াতে গেছি। প্রচুর আড্ডা হলো আমার ভাগ্নি দীঘি আর তার বর গহীনের সঙ্গে। তারপর আমি উঠতে চাইলে দীঘি বলল, 'পাগল নাকি? না খেয়ে যাবে কোথায়'? আমার কাজ ছিল- সে কথা বলতেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল ওরা দু'জন।

চোখ বড় বড় করে দীঘি বললে, 'মামা, খেয়ে যাও। একটা মজার জিনিষ খাওয়াবো'। চমকে উঠলাম আমি- কোথায় শুনেছি এ কথা! আমি কোনো প্রশ্ন করি নি। আমি ততক্ষণে স্থির জানি প্রশ্ন করলে কি জবাব আমি পাবো। সে জবাব আমি জানি।

এ জায়গায় আমি আগেও দাঁড়িয়ে গেছি, এ মুখও আমি আগে দেখেছি। পূর্ণ দৃষ্টিতে দীঘির মুখের দিকে চাইবার আগেও আমি জেনে গেছি যে তাকালে সেখানে আমি খুকুর মুখটিই দেখতে পাবো।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি