আল কোরআন ও বাংলা মর্মবাণী: আমাকে কেবলই ভাবায় আর কাছে টেনে নেয়
প্রকাশিত : ১৮:১৭, ২৮ মে ২০২০ | আপডেট: ১৮:২৭, ২৮ মে ২০২০
অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান
প্রায় দুদশক আগে দুজন প্রথিতযশা নওমুসলিমের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। তাদের একজন জার্মান, আরেকজন আমেরিকান। জার্মান ভদ্রলোকের নাম ড. মুরাদ হফম্যান। তিনি পেশায় ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কূটনৈতিক, যিনি মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমেরিকান নওমুসলিমের নাম ইয়াহিয়া এমেরিক। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক এবং লেখালেখির জগতে ছিলেন সুপরিচিত। দুটো বেস্ট সেলিং বইয়ের লেখক তিনি। মুসলিম হওয়ার পর ড. মুরাদ হফম্যানের বইগুলো বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। দুজনের কাছেই আমার প্রশ্ন ছিল—তারা কীভাবে মুসলিম হলেন?
জবাবে তারা দুজনেই বললেন—কোরআন পাঠের পরেই তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান। ইয়াহিয়া এমেরিকের জবাব ছিল, ‘কোরআন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি গ্রন্থ। এটি পড়তে গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম-উচ্চতর একটি সত্ত্বা আমার সাথে কথা বলছেন, যিনি পরমদয়ালু। তিনি সরাসরি আমাকে উদ্দেশ্য করে আমার কল্যাণ-অকল্যাণ নিয়ে কথা বলছেন। আমি এক ধরনের গভীর টান অনুভব করলাম।’ মুরাদ হফম্যানের জবাব ছিল আরও সোজাসাপ্টা। তিনি বললেন, ‘কোরআন নিয়ে আমি অনেক কথা আগে থেকেই শুনেছি। কিন্তু নিজে যখন পড়তে শুরু করলাম, অল্প দিনের মধ্যেই আমার অন্তরে শুরু হলো এক গভীর আলোড়ন যা আমার পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। মনে হলো, পরম করুণাময় আমার অন্তরের তালা খুলে দিলেন এবং আমি কলেমা শাহাদাত পাঠ করলাম। অর্থাৎ মুসলিম হয়ে গেলাম।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তারা কেউ কিন্তু আরবি ভাষাভাষী ছিলেন না এবং আরবি ভাষা জানতেনও না। কোরআনের ইংরেজি অনুবাদ পড়েই এর মর্মবাণী কিছুটা উপলব্ধি করলেন এবং কোরআনে উপস্থাপিত সত্যের সামনে নিজেকে আত্মসমর্পণ করলেন। তখন আমার মনে পড়ে গেল নিজের জীবনের এক অভিজ্ঞতার কথা, যা ছিল পুরোপুরি বিপরীত।
দেশে থাকাকালে একবার কোরআনের বাংলা অনুবাদের একটি বইয়ের ওপর আমার চোখ পড়েছিল। আগ্রহ নিয়ে পড়তেও শুরু করেছিলাম কিন্তু অগ্রসর হতে পারিনি। আমারই দুর্ভাগ্য যে, সেই অনুবাদ আমাকে কাছে টানেনি। সত্যি বলতে কী, ঐশী গ্রন্থের অনুবাদ করা সহজ কাজ নয়। কোরআনের মর্মবাণী ধারণ করার জন্যে সাধনারও প্রয়োজন। এ কাজে কে কতটা শ্রম দিলেন, কতটা দক্ষতার পরিচয় দিলেন, কতটা আন্তরিকতার স্বাক্ষর রাখলেন এবং সফল হলেন, তা এই গ্রন্থ যিনি নাজিল করেছেন তিনিই ভালো জানেন। বাইরে থেকে এর বিচার করা মুশকিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি কোরআন অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমি আরেকটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই যা পূর্বের তুলনায় ব্যতিক্রম। এবারের অভিজ্ঞতা কিন্তু আনন্দময়। আলহামদুলিল্লাহ!
গত বছর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আলোকায়ন কার্যক্রমে আমি যোগদান করি। সেখানে আমাকে ‘আল-কোরআন ও বাংলা মর্মবাণী’ উপহার হিসেবে দেয়া হয়। এর অত্যন্ত সুন্দর মলাট ও আকর্ষণীয় ক্যালিগ্রাফি সত্ত্বেও পূর্বে কোরআনের বাংলা অনুবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা সুখকর না হওয়ায় আমি একে মনের শোভা বর্ধনের কাজে না লাগিয়ে চোখের শোভা বর্ধনের জন্যে কোরআনের আরো চারটি অনুবাদ গ্রন্থের সাথে বুক শেলফে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখি। ভাবলাম, কখনো গবেষণা কাজে প্রয়োজন হলে ব্যবহার করব। গ্রন্থটি সাথে সাথে না পড়ার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল। যদিও আমি গুরুজীর অন্যান্য বইয়ের একজন মুগ্ধ পাঠক, তারপরও ভাবলাম তিনি তো কোনো ধর্মীয় পণ্ডিত বা বিশারদ নন যে তার উপস্থাপিত মর্মবাণীর মধ্যে তুলনামূলক ভালো কিছু পাব যা অন্য কোথাও পাই নি।
কিন্তু এবারের রমজানে লকডাউনের বদৌলতে কোরআন আরেকটু মনোযোগ দিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিষয়ভিত্তিক অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমার সংগ্রহে থাকা সবকটি অনুবাদগ্রন্থ পাশাপাশি রাখলাম এবং অত্যন্ত আনন্দের সাথে লক্ষ করলাম যে, ‘আল-কোরআন ও বাংলা মর্মবাণী’ অন্যান্য অনুবাদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। এটি আমাকে থামায় না, কেবলই ভাবায় আর কাছে টেনে নিয়ে যায়। কোরআনের বাণীর গভীরতায় আমি মুগ্ধ ও বিমোহিত হলাম। এ আকর্ষণ ও উপলব্ধি বলে বোঝাবার মতো নয়। সেই থেকে ‘আল-কোরআন ও বাংলা মর্মবাণী’ আর বুক শেলফে নয়, পড়ার টেবিলে আমার হাতের নাগালের মধ্যেই রাখি। পড়া শেষে উঠে গেলেও গ্রন্থটি আবার আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই আবারও এসে খুলি। আবারও পড়ি। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, যে ভাষাতেই হোক কোরআন পাঠের অভিজ্ঞতা একেক জনের কাছে একেক রকম হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। তবে কোরআন সকলকেই আহবান জানায় একে জানতে, বুঝতে এবং গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এরপরও কি ওরা কোরআন নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে তা অন্তরে ধারণ করবে না? নাকি মনের দরজা বন্ধই করে রাখবে?’ (সুরা মুহাম্মদ : ২৪)।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে মুসলমানরা যারা এই কোরআনে বিশ্বাস করি এবং একে ভক্তি করি, সেই আমরাই অর্থাৎ আমাদের সিংহ ভাগই এই কোরআন সম্পর্কে অজ্ঞ। একে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা তো দূরের কথা, এর পঠনপাঠন নিয়েও রয়েছে নির্লিপ্ততা। অথচ সময় থাকতেই আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কোরআন অধ্যয়নে সাধ্য মতো সচেষ্ট হওয়া, এর জ্ঞান ও শিক্ষা নিজের মধ্যে ধারণ করা এবং পরস্পরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কোরআন মর্মবাণী আমাদেরকে সেদিকেই হাতছানি দিচ্ছে অবিরত। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। মঙ্গল হোক সবার। আমিন।
লেখক: অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব বিভাগ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এমএস/