ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আলীর ঘাটে সংগ্রামী আলীর জীবন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:০৩, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

Ekushey Television Ltd.

এক সময়ে একটি স্বপ্নকে পুজি করে শরিয়তপুরের জাজিড়া থানার কাইজারচর গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন গ্রামের সহজ সরল যুবক মোহাম্মদ আলী মিয়া। স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজধানীতে তার কষ্টে অর্জিত টাকা দিয়ে হবে এক টুকরো জমি, হবে বাসস্থানের ব্যবস্থা। সেই লক্ষেই প্রথমে ১৯৬৫ সালে ঢাকার ইসলামবাগে ছোট একটি কক্ষ ভাড়া বসবাস শুরু করেন।

বেঁচে থাকার জন্য প্রথমেই ছোটকাটরা এলাকার একটি প্লাস্টিক কারখানায় সপ্তাহে তিন টাকা বেতনে কাজ করেন। এতে করে কোনো রকম চলে যেত আলী মিয়ার জীবন। এভাবে একবছর যেতে না যেতেই চাকরিটি ছেড়ে দেন  তিনি। ভাবেন এ করে নিজের কোন স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না। বছরখানেক পরে তিনি চিন্তা করেন ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা চালিয়ে কর্মসংস্থানের নতুন যাত্রা শুরু করবেন। যেই কথা সেই কাজ। একটা নৌকা তৈরি করে নেমে পরলেন মাঝি হিসেবে। কেরানীগঞ্জের জিনজিড়া পোলের ঘাট থেকে নদীর ওপার ইসলামবাগের চুনারঘাটের পাশেই যাত্রী নিয়ে নৌকা ভিড়াতেন।

শুরু হল- নতুন করে একটি ঘাট। টগবগে যুবক মাঝি দেখে অনেকে ভাবতেন এই ছেলেটা কেন নৌকার মাঝি হল। যে ওই ঘাট পার হত সে-ই কিনা কথাটা বলতো। এক সময়ে সবাই তার নামটা জেনে গেল আলী মাঝি। দেখতে সুদর্শন চেহারার অধিকারী  প্রথম প্রথম অনেক সমস্যা হত। তবে এক সময়ে সব ঠিক হয়ে গেল। এভাবে কয়েকবছরের মধ্যে আলীর ঘাট হিসেবে ঘাটটি তার পরিচিতি লাভ করে। তখন পারাপার ছিল জন প্রতি তিন পয়সা করে। এভাবে কেটে যায় কয়েকটি বছর।

১৯৭৩ সালে একাকিত্ব জীবনের অবশান ঘটিয়ে সংসার জীবনের অধ্যায় শুরু করেন আলী। বিয়ে করেন আছিয়া আক্তার নামে এক মেয়েকে। কয়েকবছর পর আছিয়ার কোল জুরে আসে মেয়ে নাছিমা আক্তার ও তার কয়েকবছর পর আরেক মেয়ে নাজমা আক্তার। দুই মেয়েকে নিয়ে মাঝি আলী ও আছিয়া দম্পতির পরিবারের আনন্দটাই অন্যরকম।

এভাবে কেটে যাচ্ছিলো আলীর সংসার জীবন। তার পরে আবারও পর্যায়ক্রমে দুই পুত্র সন্তানের বাবা হন আলী মাঝি। সব মিলে আলী আছিয়া দম্পতির চার সন্তান যার মধ্যে বড় দুজন মেয়ে ছোট দুজন ছেলে।

সময়ের পরিক্রমায় সেই আলী ১৯৯৮ সালে কামরাঙ্গীর চরে একটি জায়গা কিনেন এবং সেখানে গড়ে তোলেন ছোট একটি বাড়ি। ভালই চলছিল সংসার জীবন। ঠিক তখন ভাগ্যবিধাতার নিয়তির খেলায় আলীর সাজানো সংসারটা কামরাঙ্গি চরের বেরিবাধ নামের সিডরে তুরুপের তাসের মত ভেঙ্গে যায়।

জানা যায় ২০০৪ সালে কামরাঙ্গিচরের বেরিবাধ হওয়ার সময় তার জমিসহ ঘরটি ভেঙ্গে ফেলতে হয়। যদিও তৎকালিন সরকার বলেছিল যারা আছে তারা কমবেশি ক্ষতিপূরণ পাবে। তবে কে পেয়েছে কে পায়নি তা জানা নেই আলীর। আলী পাইনি এতটুকু জানালেন অকপটে। এতে একদম নিশ্ব হয়ে যায় আলী মিয়া। তাতেও হাল ছাড়েনি আলী। সে জানতেন জীবন জীবীকার একমাত্র হাতিয়ার নৌকার বেয়ে তাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। তাতেও আলী ভেঙ্গে পরেননি।

স্বরেজমিনে গত সোমবার একুশে টেলিভিশনের এই প্রতিবেদক গিয়েছিল বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝিদের জীবন সংগ্রামের গল্প জানতে। কিন্তু সেখানে যেয়ে আলী নামের এক মাঝির জীবন সংগ্রামের এমন গল্প পাবে তা জানা ছিল না এই প্রতিবেদকের।

গেীধূলীর শেষ লগ্নে আলীর নৌকায় চেপে বুড়িগঙ্গার পানিতে ভেসে ভেসে জানা গেল আলীর সংগ্রামী জীবনের পেছনে লুকিয়ে থাকা আরেক গল্প।

অশ্রুসিক্ত কন্ঠে আলী বললেন, বাবা জীবনের কতটা বছর এই নৌকা করে মানুষ পারাপার করছি কেউ কখনো আমার কিংবা আমাদের মাঝিদের নিয়ে কিছু লেখে নাই। শোনে নাই সুখ দুঃখের গল্প। আপনি এই প্রথম আসলেন। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, আমার নামের ওপরে এই ঘাট আজও আছে অথচ আমি নিজেই প্রতিদিন এই ঘাটে সবার মতো ৭০ টাকা ও পোলের ঘাটে  ৩০ টাকা খাজনা দেই। তখন দুচোখে পানি ধরে রাখতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, এই ইসলামবাগে অনেকে আছে যারা আমার নৌকায় পার হয়ে কাজ করতে যাইতো এখন সাহেব। কি কমু বাবা আল্লায় যারে দেয় কে তারে ফিরায়। এই প্রতিবেদক বলেন, আপনার নামে এখনো ঘাট এই ভাবতে কেমন লাগে বিষয়টা। প্রথমে বলবো ভাল। তবে এই ঘাটটা কয়েকবার নাম বদলাইতে চাইছে কয়েকজন। কিন্তু কেউ আলীর ঘাট ছাড়া চেনে না। তাই মনে মনে বলি তোরা ইচ্ছা করলেই আমার নামটা বদলাতে পারবি না। তিনি তার পরিহিত সাদা গেঞ্জিটা ধরে ঝাকি দিয়ে বলে “আমি রাজা মহা রাজা”লোখে দেখলে দূর থাইকা কয় কি, কেমন আছ আলী ভাই? এতেই আমার শান্তি রে বাবা।

এখন আলী স্ত্রী আছিয়া বেগম ও দুই ছেলেকে নিয়ে কামরাঙ্গীচরের একটি ভাড়া বাসায় থাকে। বড় ছেলে নূর ইসলাম কামরাঙ্গীচরের একটি মোবাইলের দোকানে চাকরি করে। এতে মাসে ১০ হাজার ও ছোট ছেলে জহিরুল ইসলাম সোয়ারীঘাট এলাকার ছোট কাটরায় একটি রং ছাপা কারখানায় মাসে আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করে। আর আমি সব মিলে ১০-১২ হাজার টাকা পাই। এতে আমাদের ঘড় ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ চলে যায় ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে খাওয়া দাওয়া অন্যান্য খরচ নিয়ে কোন রকম সংসারটা চলছে। মন চাইলে কাজ করি মন না চাইলে কাজ করি না। এই হল আমি আলী মিয়ার বর্তমান অবস্থা। এভাবেই সোজা সাপটাভাবে আলী মাঝি জানালেন তার বর্তমান জীবনব্যবস্থার কথা।

এর আগে কথা হয় এই ঘাটের মাঝি মো. আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি সাংবাদিক পরিচয় জেনে বলে বাবা আমরা না হয় ঘাটের খাজনা দেই ঠিক আছে তবে আলী ভাইর খাজনা দিতে হয় এটা আমাগো অনেক খারাপ লাগে। তাই আলীর ঘাটের মাঝিদের জোর দাবি ঘাট সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ যাতে আলী ভাইর ঘাটের খাজনা মওকুফ করেন এবং তাদের খাজনাগুলো কমিয়ে নেন। তারা আরো জানান আগে এই ঘাটে অনেকরে কিছু দিতে হইত এখন আর হয় না। তার কথার সঙ্গে সুর ধরে মাঝি বাদশা মিয়া, মো. বাবুল,শফিকুলসহ আরও অনেক মাঝি একই কথা বলেন। এছাড়া বুড়িগঙ্গা নদীর মঝিদের অনেক বোবা কষ্টের কথাই আছে যা চুনারঘাট, চেয়ারম্যান ঘাট, সুয়ারীঘাট, ইমামগঞ্জ ঘাট, বাবুবাজারঘাট, পোলের ঘাট ঘুরে জানা গেছে। তাই আলী মাঝির সরকারের প্রতি আকুল আবেদন সরকার যাতে তার নামের ওপরে ঘাটটিকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সারা জীবনের জন্য খাতা কলমে রাখেন। তাতে শেষ নিশ্বাস নিলেও লোকে যাতে নৌকা পার হলে বলে এই হল সেই আলীর ঘাট। এতেই আমার বড় শান্তি।

 

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি