ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

আশুরার মর্যাদা ও কারবালা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:৫৮, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মহররম ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। মহররম শব্দটি আরবি, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মহররম মাস পবিত্র হিসেবে গণ্য। মহররমের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন দিন, যাকে আশুরা বলা হয়ে থাকে। মহররম মাসের পরবর্তী মাসের নাম সফর।

মহররম মাস প্রসঙ্গে কোরআনে কারিম ও হাদিস শরিফে যা এসেছে তা হলো, এ মাস অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ মাস। পবিত্র কোরআনে কারিমের ভাষায়, এটি `আরবাআতুন হুরুম` অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। এ মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, `রমজানের পর আলল্গাহর মাস মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।`

মহররম মাসের রোজাগুলোর মাঝে আশুরার রোজার ফজিলত আরও বেশি। আশুরার রোজা প্রসঙ্গে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, `আমি রাসুলুলল্গাহকে (সা.) রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য সময় তা দেখিনি।`

হজরত আলীকে (রা.) এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন হজরত রাসুলুলল্গাহর (সা.) কাছে জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে হজরত রাসুলুলল্গাহ (সা.) বললেন, `রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আলল্গাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যেদিনে আলল্গাহতায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।`

অন্য এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, `আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আলল্গাহতায়ালা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।` আশুরার রোজা সম্পর্কে আরেক হাদিসে আছে যে, `তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করো; আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখ।` হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, `আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোজা রাখব।`

এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আলল্গাহতায়ালা তার কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মেরেছেন।

তবে এদিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন- এদিন হজরত ইউসুফ (আ.) জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হজরত ইয়াকুব (আ.) চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হজরত ইদরিসকে (আ.) আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলেন, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই (আল আসারুল মারফুয়া/আবদুল হাই লাখনবি)।

এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হজরত হুসাইনের (রা.)। বলা বাহুল্য, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী করিমেরই (সা.) তো শিক্ষা-`নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না, যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।`

বহুবিধ কারণে এ মাসটি মুসলিম উম্মাহের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং আলল্গাহর রাসুল (সা.) নিজে এ মাসকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, `রমজানের পরে সর্বোত্তম রোজা হলো আলল্গাহর প্রিয় মহররম মাসের সাওম এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের নামাজ।` অন্যদিকে মানবতার মুক্তির দিশারি, সব নবী-রাসুলের নেতা এবং আমাদের পথপ্রদর্শক হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধরাবাসীর প্রতি তার দায়িত্ব অর্থাৎ মানুষকে শান্তির ধর্ম ইসলামের পথে আহ্বানের শুরু করেছিলেন মহররম মাসে। মহররম মাসের ১০ তারিখ গোটা মুসলিম বিশ্বের কাছে পবিত্র আশুরা নামে পরিচিত। আশুরা ও মহররম শব্দদ্বয় শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে এক ভয়ঙ্কর, বীভৎস, নিষ্ঠুর, নির্মম ও ইসলামের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক ঘটনা। রাসুলুলল্গাহর (সা.) নয়নের পুতুলি, কলিজার টুকরা হজরত হোসাইনের কারবালার প্রান্তরে শাহাদাতের মর্মন্তুদ ঘটনা; যা এ পৃথিবীর এক করুণ ইতিহাস। বিশ্বের সব মুসলিম নর-নারী আজও ধর্মীয় রীতিনীতির মাধ্যমে দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করে। হজরত মুহাম্মদের (সা.) ওফাতের মাত্র ৫০ বছর পর ফোরাতের তীরে কারবালার কঙ্করময় প্রান্তরে মুহাম্মদের (সা.) অন্যতম প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সপরিবারে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মোয়াবিয়াপুত্র ইয়াজিদের হাতে শাহাদাতবরণ করেন। তবে কারবালার এ করুণ ট্র্যাজেডির পরেই ইসলাম নবরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে বলেই ইসলামী স্কলারদের বিশ্বাস। তাদের মতে, `কারবালার ত্যাগের পরেই ইসলাম জিন্দা হয়েছে।` কারবালাই মুসলমানদের শিক্ষা দিয়ে গেছে, মর্সিয়া কিংবা ক্রন্দন নয় বরং ত্যাগ চাই।

এক হাদিসে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, `তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, যারা (শোক প্রকাশ করতে গিয়ে) মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহেলি যুগের কথাবার্তা বলে।`

অতএব শাহাদাতে হোসাইনকে (রা.) কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলি রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।

এ মাসে আরও যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় সেগুলো হলো- তাজিয়া মিছিল, শোকগাথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেকের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। এ জন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদি থেকে বিরত থাকেন। বলা বাহুল্য, এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার। এসব অবশ্যই বর্জনীয়। এ মাসের করণীয়গুলো হলো- বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করা, দান-খয়রাত করা, নফল রোজা পালন করা এবং অন্যান্য নেক আমল করা। এর অন্যথা কাম্য নয়।

প্রভাষক (আরবি বিভাগ), চাটখিল কামিল (এমএ) মাদ্রাসা, চাটখিল, নোয়াখালী।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি