আসুন আমরা একে অপরের ‘আয়না’ হই
প্রকাশিত : ১৯:৫৬, ২ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২০:০৮, ২ জুলাই ২০২০
এম আহসান হাবীব
ইতিবাচক ও গঠনমূলক সমালোচনার অনুপস্থিতি গীবত ও পরনিন্দার চর্চাকে উৎসাহিত করে; এমনকি বহুগুণ বর্ধিত করে। ইসলামে একজন মুসলিমকে অপরের ‘আয়না’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ছোট্ট এই রূপকের মধ্যে সুগভীর শিক্ষা নিহিত রয়েছে। যা আমাদের সামগ্রিক জীবনকে অধিকতর সুন্দর করে তুলতে সক্ষম বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
আমার বোধের জগতে এ থেকে ধরা পড়া কয়েকটি বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরছি-
১। আয়না তার চোখে ধরা পড়া আমাদের বিবিধ ত্রুটি ও অসঙ্গতির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে আমরা হয়তো আমাদের অগোছালো চুলটা ঠিক করে আঁচড়ে নেই, ময়লা ও অসুন্দর জামাখানি বদলে নেই, কাঁধের উপর লেগে থাকা ময়লাটি টোকা মেরে ফেলে দেই কিংবা খসখসে ঠোঁটে সামান্য ভ্যাসলিন মাখাই।
২। আয়না কেবল তখনই আমাদের কারও ত্রুটি-অসঙ্গতি তুলে ধরে, যখন আমরা তার সামনে থাকি। তার অগোচরে বা পিছনে থাকা অবস্থায় সে কখনোই কিন্তু এ বিষয়ে কোন কথা বলে না।
৩। সামনে একজন দাঁড়ানো অবস্থায় সে কখনই অন্যের চিত্র দেখায় না। অর্থাৎ একজনের ত্রুটি-অসঙ্গতির চিত্র সে কিন্তু কদাচিৎও অন্যের কাছে বর্ণনা করে না।
৪। কারো ত্রুটি-অসঙ্গতি নিয়ে আয়না কিন্তু কারও সাথে ঝগড়া বা তর্কে লিপ্ত হয় না কিংবা উচ্চবাচ্য করে না। বরং অত্যন্ত নিরবে ও মার্জিতভাবে সে তার প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে যায় মাত্র।
৫। কারও ত্রুটি-অসঙ্গতি সংশোধনে আয়না কিন্তু কখনই বল প্রয়োগ করে না। বরং তা উপস্থাপন করেই সে ক্ষান্ত হয়।
এই চমৎকার আন্তঃসম্পর্কে আয়নার সামনের ব্যক্তিটিরও অতীব গুরুত্ববহ কতিপয় দায়িত্ব রয়েছে। যেমন:
১। ত্রুটি-অসঙ্গতি অনুসন্ধানের জন্য নিজেকে আয়নার সামনে উপস্থাপন করতে হয়।
২। ধরিয়ে দেওয়া ত্রুটি-অসঙ্গতি আন্তরিকভাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকা জরুরী।
৩। দ্রুততা ও যথার্থতার সাথে ত্রুটি-অসঙ্গতিসমূহ সংশোধন করার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
৪। আয়নার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন।
৫। আয়নার যথাযথ সংরক্ষণ। কারণ এটি হারিয়ে বা ভেঙ্গে গেলে কিংবা এর উপর দাগ পড়লে এটি সামনের ব্যক্তির জন্যও ক্ষতির কারণ।
কথিত আছে, ‘আকলমানো কি লিয়ে এক ইশারা হি কাফি হোতা হ্যায়’। শুরুতে যে ‘অন্তর্নিহিত শিক্ষা’র কথা বলেছিলাম, তা নিশ্চয়ই বিচক্ষণ পাঠকগণ উপলব্ধি করতে পারছেন। তথাপি, আয়না ও এর সামনে উপবিষ্ট ব্যক্তির ভূমিকা থেকে আমাদের শিক্ষাগুলোকে এভাবে বলা যেতে পারে:
১। আয়না হচ্ছে- ত্রুটি-অসঙ্গতি ধরিয়ে দেওয়া আমাদেরই প্রিয় বন্ধু-স্বজন। আর সামনের ব্যক্তিটি হচ্ছেন যার ত্রুটি-অসঙ্গতি ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছেন তিনি।
২। আমাদের বিবেচনায় ধরা পড়া প্রিয় মানুষটির ত্রুটি ও অসঙ্গতির প্রতি আমরা যেন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
৩। কারও ত্রুটি-অসঙ্গতি যেন আমরা ঐকান্তিক পরিবেশে শুধু তাকেই বলি। তার অগোচরে বা পিছনে কখনোই এ বিষয়ে কোন কথা বলা উচিত নয়।
৪। একজনের কথা অন্যের কাছে যেন কখনো চালাচালি না করি।
৫। কারো ত্রুটি-অসঙ্গতি নিয়ে আমরা যেন ঝগড়া বা তর্কে লিপ্ত না হই। বরং অত্যন্ত নিরবে ও মার্জিতভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
৬। কারও ত্রুটি-অসঙ্গতি সংশোধনে আমরা যেন কখনোই বল প্রয়োগ না করি। কারণ জানানোটাই আমাদের কাজ, সংশোধনটা তাঁর ও স্রষ্টার ইচ্ছা।
৭। আপনার ত্রুটি-অসঙ্গতিগুলো আপনাকে জানানোর জন্য পরিবার-পরিজন ও কাছের মানুষদেরকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
৮। ধরিয়ে দেওয়া ত্রুটি-অসঙ্গতি আন্তরিকভাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা গঠন জরুরি।
৯। দ্রুত ও যথার্থতার সাথে ত্রুটি-অসঙ্গতিসমূহ সংশোধন করার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০। ত্রুটি-অসঙ্গতি ধরিয়ে দেওয়া মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ও উৎসাহ প্রদান করা জরুরি।
১১। ত্রুটি-অসঙ্গতি ধরিয়ে দেওয়া মানুষদেরকে নিজের পরিমণ্ডলে ধরে রাখা, তাদের পরিচর্যা এবং একইভাবে তাদের সংশোধনে ভূমিকা রাখাও জরুরি। কারণ তারা পাশে থাকলে এবং সত্য ও সততার পথে তাদের ধারাবাহিক মানোন্নয়ন ঘটলে আপনারও ধারাবাহিক আত্মোন্নয়ন সাধিত হবে।
সুতরাং আসুন, একে অপরের ‘আয়না’ হই।
লেখক: এম আহসান হাবীব, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, চান্দিনা, কুমিল্লা। ই-মেইল: ahsan.ec20@gmail.com
এমএস/এনএস
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।