ঢাকা, বুধবার   ০২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

‘আয় আয় চাঁদ মামা’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৮:৪৫, ২০ জুলাই ২০২০

Ekushey Television Ltd.

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

বেশ মনে আছে তারিখটি - ২০ জুলাই, ১৯৬৯ সাল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগে - ফলাফল আজ বেরোয় কি কাল! ১৮ বছরের এক কিশোরের জন্যে বড় উদ্বিগ্ন সময়। আমার জন্যে আরো বেশী। গোটা বরিশাল শহর উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে একটি সাংঘাতিক রকমের ভালো ফলাফলের জন্যে।

এই যখন অবস্থা, তখন সে বুক ধুক্ পুক্ করা দিনগুলোতে আরেক উপদ্রব যোগ হলো- ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার মতো অনেকটা। রেডিও, খবরের কাগজে গরম গরম সংবাদ বেরুচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে। টেলিভিশনের তখন প্রাথমিক অবস্থা বাংলাদেশে এবং বেশীরভাগ বাড়িতেই টেলিভিশন আসেনি। বরিশালের মতো মফস্বল শহরের অবস্থা আরো প্রাগৈতিহাসিক।

শোনা গেল- মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের বরিশাল দপ্তর চেষ্টা করছে বেলস্ পার্কের মাঠে বড় করে ছায়াছবি পর্দা টাঙ্গিয়ে চন্দ্রে অবতরনের দৃশ্য সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্প্রচার করবে। সারা বরিশাল শহর তখন ধুনকরের টঙ্কারের মতো টানটান। হাসপাতাল রোডে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে সারাক্ষণই উৎসুক জনতার ভিড়। কেন্দ্রের অধিকর্তা কিবরিয়া চাচার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা!

প্রচার মাধ্যমের জবানীতে জানা গেল যে, তিন নভোচারী নিয়ে এ্যপোলো-১১ চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। নভোযানটির অধিনায়ক ছিলেন নেইল আর্মস্ট্রং, তাঁর সহযোগী দু’নভোচারী ছিলেন এডউইন (বাজ) অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স। আমার কাছে তাঁদের তিনজনকে স্বপ্নের মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। বিরাট আশাভঙ্গ হলো সারা বরিশালবাসীর, যখন ঘোষনা করা হলো যে- যান্ত্রিক জটিলতার কারণে মার্কিন তথ্য কেন্দ্র চন্দ্রাবতরনের ঘটনা সরাসরি দেখাতে পারবে না। না, আমরা কিবরিয়া চাচার দফতর তছনছ্ করি নি। এমন সংস্কৃতির অভ্যুদয় তখনও হয় নি।

সুতরাং রেডিওই ভরসা সাম্প্রতিকতম সংবাদের জন্য। আমাদের ফিলিপস্ রেডিওর চারপাশে পরিবারের সবাই গোল হয়ে বসে আছি। ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠানে থেকে রেডিওর কাঁটা নাড়ানো সম্পূর্ণ বারণ। শুধু বাবাই মাঝে মধ্যে কাঁটা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভয়েস অব আমেরিকার মূল ইংরেজী অনুষ্ঠানে - তাঁর যুক্তি, ওখানেই সবচেয়ে গরম গরম খবর পাওয়া যাবে। কিন্তু যতবারই তিনি তা করছেন, ততবারই আমরা সবাই কঁকিয়ে উঠছি - যেন বিলায়েৎ খাঁ সেতারে মোচড় দিচ্ছেন।

এ্যপোলোর চান্দ্রিক যান ঈগল চাঁদের মাটি ছুঁলো বাংলাদেশ সময় ২০ জুলাই দিবাগত রাত ২টা ১৭ মিনিটে। নেইল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রাখলেন ছ’ঘন্টা পরে - ২১ জুলাই সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে। বেতার তরঙ্গে ভেসে এলো তাঁর কম্পিত আবেগময় কণ্ঠ - ‘একজন মানবের একটি ছোট্ট পদক্ষেপ - কিন্তু মানবজাতির জন্যে একটি বিরাট উল্লম্ফন’। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এবং আশে পাশের বাড়ির যুগপৎ চিৎকার ফুটবলের বিশ্বকাপ ফাইনালের গোলের চিৎকারকে ছাপিয়ে গেল। ঐ কথা ক’টি এবং চন্দ্রাবতরনের দৃশ্যটি পরবর্তী ৫০ বছরে নানাভাবে দেখেছি ও শুনেছি। কিন্তু সেই আদি কথা ও প্রথম চিৎকারের সঙ্গে কোন কিছুই তুলনীয় নয়।

ডান পাশের ছবিটি ভারী মজার- আমাদের দেশের নাবিস্কো কোম্পানীর একটি বিজ্ঞাপন।

আর্মস্ট্রং এর চন্দ্রাবতরনের ১৯ মিনিট পরে চাঁদের মাটিতে পা রাখলেন অলড্রিন। তাঁরা দু’জনে চাঁদের মাটিতে লাফালেন, ঝাঁপালেন। মজার সে লাফ - পৃথিবীর ২ ফুটের লাফ সেখানে ১২ ফুটের লাফ হয়ে যায়। তবে শুধু আনন্দ করা নয়, নানান বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করলেন তাঁরা দু’জনে। মাইকেল কলিন্স কিন্তু চন্দ্রযান নিয়ে কক্ষপথে আবর্তন অব্যাহত রাখলেন। তাঁর জন্যে কেমন যেন একটা কষ্ট অনুভব করলাম। মানুষের প্রথম চন্দ্রাভিযানের তিনি অংশ বটে, কিন্তু প্রথম চন্দ্রাবতরনের সুযোগ তাঁর হয়নি। জানি না, কলিন্সের কি মনে হয়েছিলো, কিন্তু তাঁর জন্যে দু:খে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়েছিল।

তার পরের দিনগুলোতে কি যে ভয়ংকর অবস্থা আমাদের। চাঁদের দিকে আর তাকাতে পারি না। ওর বুকে মানুষ নেমেছে ভাবতেই মনে হচ্ছিল, চাঁদের শুভ্রতা কলঙ্কিত হয়েছে। ‘চাঁদের বুড়ির’ উপাখ্যানও খান্ খান্ করে ভেঙ্গে গেল। চাঁদকেও আর মাতুল বলে মনে হচ্ছিল না। আমার মাতামহী কঁকিয়ে উঠলেন এই বলে যে, ‘কেয়ামতের আর বেশী দেরী নেই’। বাড়ির পাশের মাদ্রাসার মোহ্তামিম সাহেব জুম্মার নামাজে ঘোষণা দিলেন যে, ‘চাঁদে মানুষ নামার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। সব বানোয়াট ছবি নাসারারা বানিয়েছে’।

এর পরে ওই তিনজন নভোচারী বিশ্ব ভ্রমণের অংশ হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন। মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের উদ্যোগে যেখানে ‘সারকারামা’ দেখানো হয়েছিল, সেখানে তাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন। বহু মানুষের সমাগম হয়েছিলো সেখানে। বেনুর মুখে গল্প শুনেছি, সে সেখানে গিয়েছিল। করমর্দন করেছিল নেইল আর্মস্ট্রং এর সঙ্গে। এ কথা বলতে গিয়ে তার মুখ গর্বিত হাসিতে ভরে যেত। ১৯৬৯ এর অর্ধ শতাব্দী পরে আমার জ্যেষ্ঠ কন্যা হাত রেখেছিল চাঁদের মাটিতে, ওয়াশিংটনের মহাকাশ যাদুঘরে। কন্যার মুখের সে গর্বিত হাসিও আমি ভুলিনি।

এরপর অর্ধ শতাব্দী কেটে গেছে। এর মধ্যে কত নভোচারী যে চাঁদে নামলেন। যদি কোনদিন চাঁদে বাণিজ্যিকভাবে যাতায়াত শুরু হয়, তার জন্যে টিকেট কেটেছেন বহু ধনকুবের। নিজস্ব চন্দ্রযান বানানোর উদ্যোগও নিয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ। চাঁদে মানুষ যাওয়ার ব্যাপারটি মোটামুটি ডাল-ভাত হয়ে গেছে - এ নিয়ে তেমন উন্মাদনা আর নেই।

তবু আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন একজন স্বপ্নদ্রষ্টার কথা খুব মনে হয় - আমার কৈশোরের নায়ক বলা চলে তাঁকে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ রাষ্ট্রপতি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, দশক পূর্তির আগেই যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠাবে। অনেকেই তখন সেটাকে অসম্ভব ভেবে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। সব সংশয়বাদীকে মিথ্যা প্রমাণিত করে অবশ্য ব্যাপারটি ঘটেছিল।

তবে সেটা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য ঐ তরুণ রাষ্ট্রপতির হয়নি। তার ছ’বছর আগেই আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন ঐ তরুণ রাষ্ট্রপ্রধান জন এফ কেনেডী। কিন্তু মানুষের স্বপ্নের চেয়ে বড় এবং পবিত্র আর কি কিছু আছে? স্বপ্নের মাঝেই তো মানুষ বেঁচে থাকে আর স্বপ্নই তো মানুষকে সামনে নিয়ে যায়। ‘স্বপ্ন দেখবো বলেই তো আমরা দু’চোখ পেতেছি’।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি