ইট ভাটার করুণ কাহিনী
প্রকাশিত : ১৪:২০, ২৩ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ১৫:০৯, ২৫ জুলাই ২০১৮
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। চট্টগ্রাম পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় প্রচুর ইটের ভাটা দেখা যায়। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের পিছনে একটা ইট ভাটা ছিল। একদিন বিকেলে আমি আর আমার বাবা হাটতে হাটতে ইট ভাটায় কাজ করছে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল। ফটাফট কিছু ছবি তুলে ফেললাম। কৌতূহল বশত কাচা ইট বানাচ্ছে এমন একজন নারীর দিকে এগিয়ে গেলাম কথা বলতে।
উনার নাম জয়নব বেগম। বয়স ৩৭/৩৮ হবে। জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিদিন কত` শ ইট বানান? প্রতিদিন পারিশ্রমিক কত দেয়? মলিন চেহারায়, ভেজা ভেজা কণ্ঠে উনি উত্তর দিলেন, "প্রতিদিন ৬০০ ইট বানাতে হয়। বানাতে পারলে ৫০ টাকা পাই। না পারলে টাকাও পাই না মারও খেতে হয়।"
মার ও খেতে হয় শুনে অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, " মার খেতে হয় কেন??" জয়নব বেগম শুরু করলেন প্রথম থেকে তার কস্টের কাহিনী।
জয়নব বেগমের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ভাল চাকরি দিবে বলে এক মামা চট্টগ্রাম নিয়ে আসে। তারপর এই ইট ভাটার ম্যানেজারের কাছে দিয়ে চলে যায়। তারপর আর কোনদিন কোন খবরও নেয়নি। এখানে উনি কাচা ইট বানায়। দিনে ৬০০ ইট বানাতে হয়। তাহলে দিন শেষে ৫০ টাকা পায়। ৬০০ ইট বানাতে না পারলে টাকাও পায় না, মার ও খেতে হয়। চট্টগ্রাম আসছে সাড়ে তিন বছর। একবারের জন্য বাড়ি যেতে দেয়নি। একবার পালাতে চেয়েছিল। ম্যানেজার আর মালিক মিলে অনেক মারছে আর গরম ইটের ছ্যাকা দিছে পেটে। শাড়িটা একটু সরিয়ে দেখালো ছ্যাকার দগদগে কালো দাগ পেটে।
আমাকে কথা বলতে দেখে আরও কিছু পুরুষ-নারী এগিয়ে আসলো। সম্ভবত হাতে ক্যামেরা দেখে উনারা আমাকে সাংবাদিক বা মিডিয়া কর্মী ভেবেছিল। একটা মেয়ে, বয়স ২৫/২৬ হবে। খুব অভিমান নিয়ে বললো, " এত মন্ত্রী মিনিস্টারদের নিয়ে লেখেন। আমাদের নিয়ে একটু লিখতে পারেন না? উনারা তো সুখেই থাকে। আমাদের কস্ট একটু উনাদের জানাইতে পারেন না।" এক এক করে অনেকের সঙ্গে কথা বললাম। পুরুষ কিংবা নারী, সবারই গল্পগুলো একই রকম। প্রতিদিন ইট পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ইট ভাটায় পোড়ে তাদের সুখ, স্বপ্ন। সবাই এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায় কিন্তু সব রাস্তা বন্ধ। পুরুষদের পারিশ্রমিক নারীদের দ্বিগুন। যেখানে নারীরা ৫০ টাকা পায় সেখানে পুরুষরা পায় ১০০ টাকা। কিন্তু একটু ভুল হলেই পুরুষদেরও সহ্য করতে হয় অমানবিক অত্যাচার। তার কিছু নমুনাও উনারা আমাকে তাদের শরীরে দেখালেন। অনেক নারী বললেন "আপা, কিছু কিছু ঘা এমন জায়গায় যে সবার সামনে দেখাতে পারছি না। আমাদের সঙ্গে ম্যানেজার জোর করে ওই সবও করে।" বুঝতে বাকি রইলো না এখানে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে অবিরত। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থার কথা জিজ্ঞেস করতেই জানালেন এবং দেখলান। ইট ভাটার এলাকার ভিতরেই তাদের জন্য কয়েকটা ইটের ঘর করে দেওয়া হয়েছে। ওখানেই উনারা খায় আর রাতে ঘুমায়। এক এক রুমে ৮/৯ জন করে। এর মধ্যে হঠাৎ অফিস রুম থেকে একজন লোক মোটা একটা লাঠি হাতে বের হয়ে এলেন। উনাকে দেখে বাকিরা সবাই দৌড়ে কাজে লেগে গেলেন। অফিস থেকে বেরিয়া আসা লোকটা পরিচয় দিল, উনি সেখানকার ম্যানেজার। তারপর কিছুটা জোর করে আমাদের ওখান থেকে বের করে দিলেন। বললেন, এখানে এভাবে ওয়ার্কারদের সঙ্গে কথা বলার নিয়ম নাই। কথা বললে আপনি আমাদের সঙ্গে বলবেন। এখন এখান থেকে চলে যান।"
কয়েকবার সেই অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিরে আসলাম। আসার সময় কিছু ছবি তুলতে চাইলাম কিন্তু ক্যামেরাটা হাত থেকে নিয়ে নিল। তারপর ক্যামেরাটা ফেরত নিয়ে চলে এলাম।
খুব কস্ট লাগছিল মানুষগুলোর জন্য। প্রতিদিন শত শত ইট আমরা বাড়ি বানাতে, ব্রিজ, ফ্লাইওভার বানাতে ব্যবহার করি। কিন্তু আমাদের এই ভদ্র সমাজ জানে না, ইট বানাতে যাদের ঘাম ঝরে তাদের জীবনের করুন কাহিনীগুলো।
তারা পায় না কোন মিডিয়া কাভারেজ। ইট ভাটায় পুড়ে যায় তাদের জীবনের মূল্যবান সময়, সুখ, শান্তি। আর কিছু না পাওয়া স্বপ্ন।
এই মানুষগুলোও হয়তো স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বাঁচার। তাদেরও সুন্দর এই পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে নিশ্চয়ই। যারা এতো কষ্ট নিয়ে জীবন সংগ্রামে ঠিকে আছে আমাদের সমাজকে সুন্দর করতে তাদের নিয়ে কি রাষ্ট্র ভাবতে পারে না। কেনো তারা সারা জীবন বন্ধির মতো জীবনযাপন করবে। সমাজ, রাষ্ট্র যাই বলি না কেনো এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাড়ানো উচিৎ তাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে। অন্য পেশার মতো এই পেশায় যারা জড়িত তাদের মঙ্গলেও কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে এমনটাই, প্রত্যাশা থাকলো।
লেখক: বেসরকারি চাকরিজীবী।
আআ/এসএইচ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।