ইটিসি-পূর্বপশ্চিম এবং দীপনপুর
প্রকাশিত : ১৮:১৫, ১৫ জুন ২০২০
বুকশপ ক্যাফে ‘দীপনপুর’
জ্ঞান ও সৃজনশীল বই বিক্রয়ের প্রায় প্রতিটি বইয়ের দোকানকে কেন্দ্র করেই আড্ডা গড়ে ওঠে। ছোট-বড় সব দোকানেই। সবাই প্রকাশকও নয়। তবুও কিছু পাঠক-লেখক আড্ডা দেয়। এমনিতেই আড্ডা দেয়। আলাদা আলাদা আড্ডা। আজিজ মার্কেট, কনকর্ড মার্কেট, নিউমার্কেট, বেইলি রোডের দোকানগুলোতে এমনটাই দেখে আসছি।
আজিজ মার্কেটের জাগৃতি, ক'বছর আগে এলিফ্যান্ট রোডের উপরে দীপনপুর নামে বড়ো পরিসরেই যাত্রা শুরু করেছিল। আমার অনেক ঘনিষ্ঠ ও পরিচিতরা ওখানে আড্ডা দিতেন। বই ও লেখালেখিকে কেন্দ্র করে নানান আয়োজন করতেন। আমিও বেশ ক'বার গেছি। বই কিনতেও গেছি। যদিও আজিজ মার্কেট, পাঠক সমাবেশ কিংবা কনকর্ডের তুলনায় অনেক, অনেক কমই যাওয়া হয়েছে।
দীপনপুরের যাত্রার শুরুতেই প্রত্যাশা করেছিলাম এমন বইয়ের দোকান, আড্ডা-আসরের কেন্দ্র আরও আরও গড়ে উঠুক। কিন্তু ব্যবসাসফল হতে না পেরে বছর তিনেকের মধ্যেই এখন সেটি বন্ধ হয়ে গেল।
অনেকেরই হয়তো মনে আছে, একসময় ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরে ইটিসি-ETC নামে একটা বিশাল বইয়ের দোকান ছিল। ইটিসি-এর আরেকটা আউটলেট ছিল গুলশানে। ধানমন্ডি সাতাশের আউটলেটে যাওয়া-আসা করেছি, গুলশানেরটাতে যাওয়া হয়নি। এদের চলন্ত লিফট ছিল, মানে বড়ো বিনিয়োগ ছিল। কিন্তু স্থায়ী হলোনা। সম্ভবত ২০০৮ সালের দিকে বইয়ের এই চেইন শপ দুটো বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো ব্যবসাসফল ছিলো না।
শান্তিনগর পাঞ্জেরী বুক শপ (পিবিএস), শাহবাগে পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র, শুক্রাবাদে পূর্ব-পশ্চিম বইঘর, ধানমন্ডি সাতাশে বেঙ্গল বুক সেন্টার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নিজস্ব এবং ওই ভবনেই বাতিঘর। এই, এগুলোই ঢাকা শহরের বড়ো বড়ো বইয়ের দোকান। বাতিঘরের জন্মভূমি চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকা ও সিলেটেও বড়ো আয়োজন নিয়ে এসেছে। প্রত্যাশা করি, এগিয়ে চলুক দেশজুড়ে। যেখানে বসে আড্ডা দেয়া যায়, কফি-চা খাওয়া যায়, বই পড়ে-দেখে কেনা যায়। যেগুলোতে আরও কিছু নাগরিক সুবিধা বেশি আছে। বয়স্ক ও বাচ্চাদের জন্য খুবই সুবিধাজনক।
যা আজিজ মার্কেট ও কনকর্ড মার্কেট, বেইলি রোড, নিউমার্কেটের ছোট পরিসরের দোকানগুলোতে এই সুবিধাটুকু পাওয়া যায়না। বিচ্ছিন্নভাবে অনেক এলাকাতেই দোকান থাকলেও মেগা বুক শপ উল্লিখিত কয়টি-ই। আরও আছে কী, ঢাকা শহরে? কিন্তু দুঃখজনক খবর হলো- দীপনপুর বন্ধ হয়ে গেল গত শুক্রবার (১২ জুন), মালিক পক্ষের আর লোকসান গোণা সম্ভব নয়। শুক্রাবাদের পূর্ব-পশ্চিম আউটলেটটিও বন্ধ হয়ে গেছে। বছরখানেক আগেই। ব্যবসাসফল হতে না পারায়।
কথায় আছে, কোন শহর বা এলাকার মানুষকে জানতে-বুঝতে দুটি স্থানে যেতে হয়। বইয়ের দোকান ও কাঁচাবাজার। কী পড়ে ও কী খায়, এটুকু বুঝতে পারলেই সেখনাকার মানুষকে জানা যায়। কিন্তু ঢাকা শহরে তো বইয়ের দোকান বাড়ছে না। লেখক বাড়ছে, প্রকাশক বাড়ছে, বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে, বইমেলায় বিক্রি বাড়ছে; অথচ শুধু কমছে বইয়ের দোকান। আমার এই একুশ বছরের ঢাকাবাসেই দেখেছি, তিন-তিনটি বড়ো উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়লো।
লেখক
আমিও একসময় স্বপ্ন দেখতাম, বিশাল একটা বইয়ের দোকান দিয়া বসে থাকবো! হা, হতোম্মী। অনেকেই অনলাইনে কেনাকাটাকে এসব আয়োজনের জন্য অন্তরায় মনে করেন। আমার বিশ্বাস হয়না। তাছাড়া বইয়ের দোকানে বসে দেখেশুনে আড্ডা দিয়ে তারপরে বই কেনার যে স্বাদ, যে আনন্দ; এটা অনলাইনে তো একেবারেই অসম্ভব।
উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই লোকসান গুণে দোকান খুলে বসে থাকবেন না। উপায় কী- বেশি বেশি বই কেনা, বেশি বেশি বই পড়া। বিকল্প নাই।
দীপনপুরের অগ্রজ জাগৃতি- আজিজ মার্কেটের যেখানে ছিল সেখানে এখন কাপড়ের দোকান। এই ক’মাস আগে আজিজ মার্কেটের যেখানে বিদিত ছিল, সেখানেও এখন কাপড়ের দোকান- বিদিত উচ্ছেদ হয়ে কনকর্ডে আশ্রয় নিয়েছে। এই, এভাবেই বইয়ের দোকান কমছে, কাপড়ের দোকান বাড়ছে। এটাকে প্রবাদাকারে বলা যায়, উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট! সুন্দর কাপড়ে সবকিছু ঢেকে দেবো ভিতরের থাকুক-না ফাঁকা…
সরকারের ভর্তুকির প্রত্যাশা করে কিংবা ভর্তুকি দাবী করে বিপ্লবী স্ট্যাটাস পয়দা করা যাবে, কিন্তু এতে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারবে না। তবে, করোনাকালে সকল খাতেই সরকার সহযোগিতা করছে, এই খাতেও নজর দেয়া উচিত। অতএব, বইপড়ার বিকল্প নাই।
লেখক- মিলন পাঠান।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।