ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় আটকে মুক্তিপন দাবির অভিযোগ পরিবারের
প্রকাশিত : ১৭:৩৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ইতালীতে পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন ও মোটা অঙ্কের মুক্তিপন আদায়ের পরও ভুক্তভোগীদের না ছেড়ে আবারও মুক্তিপন দাবির অভিযোগ উঠেছে মধ্যস্থতাকারী মোজাম্মেল হোসেন এবং 'ঢাকা হাওলাদার ট্রাভেলস' এর বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার অসহযোগিতাসহ আসামিদের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ তুলছেন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা।
রোববার (১৬ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ক্রাব মিলনায়তনে 'মানবপাচার মামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশের গড়িমসি' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন এসব কথা জানান ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা।
ঘটনার বিস্তারিও তুলে ধরে ভুক্তভোগী মাসুম মোল্যার ভাই আশরাফুল মোল্যা বলেন, দালাল মো.মোজাম্মেল হোসেন আমার বড় ভাইকে ইতালীতে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। সে বলে বৈধভাবে ১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে 'ঢাকা হাওলাদার ট্রাভেলস' অফিসের মাধ্যমে ইতালিতে লোক পাঠায়। তখন তার প্রস্তাবে আমি রাজি হই এবং ১১ ডিসেম্বর দালাল চক্রের অন্য সদস্যদের নিয়ে গুলশান অফিসে আসার পর আমার বড় ভাই মাছুম মোল্যাকে ১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালীতে পাঠানোর জন্য মৌখিক ভাবে চূড়ান্ত চুক্তি হয়।
ওই দিন আমি পাসপোর্টের সাথে নগদ ৩ লাখ টাকা জমা দিয়ে বাড়িতে চলে আসি। পরে আসামি মো. মোজাম্মেল হোসেন আমাকে ফোন করে বলে যে, আপনার বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাইট জানুয়ারির ২৮ (২০২৪ সালের) এবং আমাকে বলে বাকি ১৫ লাখ টাকা সাথে নিয়ে অফিসে আসবেন।
পরে গত জানুয়ারির ২১ তারিখে আসামি মোজাম্মেল আমাকে ব্যাংক হিসাব নম্বর দেয় এবং বলে ১ লাখ টাকা পাঠানোর জন্য, আমি ওই দিনই ১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেই।
পরে ২৬ তারিখে বাকি ১৪ লাখ টাকা যোগাড় করে ঢাকার অফিসে এসে অন্য সকল আসামিদের সামনে নগদ ১৪ লাখ টাকা মোজাম্মেল হোসেনের হাতে বুঝিয়ে দেই। সে সময় মোজাম্মেল হোসেন ২৮ তারিখ সকাল ৯ টার মধ্যে আমার বড় ভাইকে অফিসে নিয়ে যেতে বলেন। সন্ধ্যায় আমার বড় ভাইয়ের ইতালীর উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাইট বলে জানান তিনি।
আমি তার কাছে বিদেশ যাওয়ার সকল কাগজপত্র চাইলে সে বলে কাগজপত্র লাগবে না। সব কাগজ ফ্লাইটের ওঠার আগে আমার বড় ভাইকে বুঝিয়ে দিবে। তখন আমি তার কথা বিশ্বাস করি। তারপর আমি ফ্লাইটের দিন ২৮ তারিখে আমার বড় ভাইকে নিয়ে তাদের অফিসে আসি। সেখানে আরোও ৫ থেকে ৬ জনকে দেখি অফিসে, তারাও ইতালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছে। পরে ওই দিন রাত ৯ টায় ডুবাইয়ের উদ্দেশ্যে আমার বড় ভাইসহ আরো ৫ থেকে ৬ জনের ফ্ল্যাইট হয়। আমার বড় ভাই ডুবাই গিয়ে পৌঁছালে আমাকে কল দিয়ে বলে যে, আমি এখন ডুবাই আছি। এখান থেকে ৫ দিন পরে ইতালীর ফ্ল্যাইট দিবে বলছে। এ বিষয়ে আমি মোজাম্মেলের সাথে কথা বললে ওরা বলে যে, ওখান থেকে ইতালীর ফ্ল্যাইট দিবে।
তারপর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে আমাকে আমার বড় ভাই ইমু নাম্বারে কল দিয়ে বলে যে, আমি সহ আরো ৭ থেকে ৮ জনকে ইতালীর ফ্ল্যাইট না দিয়ে দালালের মাধ্যমে লিবিয়া নিয়ে আসে। আমি এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মোজাম্মেল হোসেন ও তার স্ত্রী ফারজানাসহ অন্য আসামিদের সাথে যোগাযোগ করি। তারা আমকে বলেন ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ইতালীতে যাবে। আমি তাদের কথা বিশ্বাস করি। তারপর ১৫ দিন পরে আমার বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পরে মার্চের ২৪ তারিখে আমাকে আমার বড় ভাই কল দিয়ে বলে যে, দালালরা আমাকে আটক করে রেখেছে। পাশাপাশি অমানবিক নির্যাতনের ভিডিও অডিও ক্লিপ পাঠায় আমাকে। আমাকে বলে ভাইকে ওখান থেকে মুক্ত করতে হলে ২৫ লাখ টাকা দালালদের দিতে হবে। তারপর একথা শোনার পর দালালদের সাথে যোগাযোগ করি এবং ঢাকা অফিসে (ঢাকা হাওলাদার ট্রাভেলস) এসে অফিস বন্ধ পাই। তারপর মোজাম্মেল হোসেন এর কথায় আমায় বড় ভাইয়ের জীবন বাচাঁনোর জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ লাখ টাকা দেই।
এ নিয়ে দালাল চক্রকে মোট ৩৫ লাখ টাকা দেয়। কিন্তু তারপরও তারা আমার ভাইকে ছাড়েনি। পরে টাকা দেয়ার ৬ মাস পার হয়ে গেলেও ভাইয়ের সন্ধান না পেয়ে আমি দাদাল মোজাম্মেলসহ অন্যদেরর সাথে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে প্রাননাশের হুমকি দেয়। পরে আমি এবং অন্য এক ভুক্তভোগির বাবা চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি (২০২৫) গুলশান থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করি।
গুলশান থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে তাল বাহানার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. পলাশ আসামির রিমান্ড নিয়ে গড়িমসি করে ও টাকার জন্য আমাদেরকে হুমকি দেন। টাকা না দেওয়ায় মামলার সঠিক তদন্ত নিয়ে তাল বাহানা করে। পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তিনি অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করছে না।
তিনি বলেন, এসআই মো. পলাশ মামলার ৪ নম্বর আসামি নওশেদ শিকদারকেও গ্রেফতার করতে অনীহা প্রকাশ করে। তারপর আমরা ৯৯৯ কল দিয়ে গুলশান থানার এস আই মশিউর এর সহযোগিতায় নওশেদ শিকদারকে গুলশান থানার পার্শ্ববর্তী তাজ উদ্দিন আহমেদ পার্ক থেকে গ্রেফতার করে।
এসময় গ্রেফতারকৃত আসামি নওশাদ শিকদার, দালাল মোজাম্মেল হোসেন এবং আসামি মুন্না হাওলাদার অবৈধভাবে কিভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক লিবিয়াতে পাচার করে সে সম্পর্কে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই মো. পলাশ হোসেনের সামনে বিস্তারিত জবানবন্দী দেন। জবানবন্দি পাওয়ার পরও এসআই পলাশ কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলেও জানান তিনি।
মামলার পলাতক আসামি মুন্না হাওলাদারসহ অন্যরা ভুক্তভোগীদের লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের অন্য সদস্য মো. তারেক (দিপু) এর কাছে আটকে রেখে আমাদেরকে হুমকির পাশাপাশি মুক্তিপণের জন্য আরও ২০ লাখ টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না বলেও জানান তিনি।
এসএস//
আরও পড়ুন