ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

ইন্টারনেট বিশ্বমানবতার জানালা!

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

প্রকাশিত : ২০:৪০, ১ মে ২০২০ | আপডেট: ০০:২৫, ২ মে ২০২০

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

ভাবুন তো; ফেসবুক নেই ইউটিউব নেই, নেটফ্লিক্স কিংবা হোয়াটস অ্যাপ-ও! তাহলে করোনার এই দিন - রাতগুলো কিভাবে কাটাতেন! বিগত শতাব্দীগুলোতে যত মহামারি হানা দিয়েছিল, তাতে অগণন মানুষের জীবনের বিনাশ ঘটেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু রোগের থেকেও বেশি ভয়ংকর হল আতংক। একবার বুকে হাত দিয়ে কি আমরা বলতে পারি, যে পরিমাণ বিভীষিকাময় এই কোভিড-১৯ নামের ভাইরাসটি, আমরা সবাই কি সেই পরিমাণে আতংকগ্রস্থ! আমরা কি দিন রাত বাতিক প্রবণ হয়ে পড়ছি ভাইরাসের এই আক্রমণের ভয়ে! নিজেদের কী সংকুচিত করে রেখেছি ভীষণভাবে! করিনি। কেন জানেন? কারণ, আমাদের হাতে চলে এসেছে ছোট অথবা বড় পর্দার সাথে যুক্ত আন্তর্জাতিক সংযোগ ব্যবস্থা। বিনোদন থেকে ব্যবসা, শিক্ষা থেকে সামাজিক মেলবন্ধন, সব ক্ষেত্রেই বর্তমান বিশ্ব যুক্ত হয়ে হয়ে পড়েছে এক মহাজাগতিক জানালায়। আপনার মন খারাপ, অর্থাভাবের খবর কয়েক মিনিটে ছড়িয়ে পড়ছে বন্ধু মহলের মধ্যে। অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে সহানুভূতির বার্তা অথবা বেঁচে থাকার সংস্থান। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এমনকি বেইজিং থেকে বেলারুশের হালহকিকত আপনাকে, আপনার দেশকে করে রাখতে পারছে সর্তক। তাই বলা হচ্ছে যে, তথ্যই বর্তমান বিশ্বের প্রধান সম্পদ। তাই হয়তো দেখা যায়, এই তথ্য সম্পদ করায়ত্ত করার জন্য সারা বিশ্বে হ্যাকার নামের বিশেষ গোষ্ঠীর আবির্ভাব। 

যা বলছিলাম, আমরা সত্যিই কিন্তু আর একা নই। এই নতুন বিশ্বে আপনি চাইলেও আর সেভাবে নিরেট একা হয়ে যেতে পারবেন না। আপনার আমার সাধের একাকিত্ব বিলিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আমরা খুব কম কিছু কী পেলাম! আমাদের প্রিয় মন খারাপ, আলগোছে সমাজ থেকে তুলে নেওয়া আমার ব্যাক্তিগত ছাপ, নদী বা সমুদ্রের কিনারে তিল তিল করে গড়ে তোলা একাকীত্বের বসতি, নিশুতি রাতে কান্নার অশ্রুদলের আশ্রয়ে হৃদয়কে জারিত আর সারবান করে তোলার মোলায়েম অনুভূতিগুলোকে হয়তো আমাদের বিসর্জন দিতেই হয়েছে। এখন আমার একাকিত্ব আপনার একাকিত্ব মিলেমিশে এক বৈশ্বিক সম্মেলনে পরিণত হয়েছে। যেখানে একা আর একা মিলে দুই জন হয়। হৃদয়ের তাপ আর
অনুভূতির ভাপে আপনি আর সেই একাকিত্বে ভোগা মানুষটি আর থাকেন না। গড়ে তোলেন অনুভূতির এক বিশ্ব সম্মেলন। সেই বিশ্ব সম্মেলনের মহাভোজ সভায় আপনি আমি চাই বা না চাই প্রসাদের অংশীদারী হয়েই চলেছি। সুতরাং, এই মহামারির ত্রাসে কেঁপে ওঠার সত্যি সত্যি কী খুব একটা সময় আছে! বিনোদনের পৃথিবী ভরা আয়োজন আমাদের আঙুলের কাছেই তো! ঘুম ভাঙার পর ব্রেকফাস্টের 'পিক' দিয়ে যে দিনের সূচনা (যদিও এখন ইফতারের হোম মেড ট্রায়ালের পিকের ছড়াছড়ি) তার পরবর্তী প্রহর গুলো কাটে আবহাওয়া অথবা মন বদলের ধারাবাহিক বিজ্ঞপ্তি-নিনাদে। এই পৃথিবী আর আমার নয়, আমাদের। এর ব্যথা-বেদনা-হাসি-উল্লাস খুব ঘনভাবে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের হৃদয়ে বাজে। ধমনীর শিরা - উপশিরাগুলো এখন বিশ্বমানবতার তারে তারে বাঁধা। তাই কোথায় পালাব- এখন আমরা! পালবই বা কেন? সাহিত্য-সংগীত-সিনেমা যে বিশ্বমানবতা আকাঙ্খা জাগিয়েছিল বিশ্ববাসীর মনে বিগত দশকগুলোতে, তা যেন আজ মূর্তি পেয়েছে। ‘যেন’ হয়তো নয়, সত্যি সত্যি আজ বিশ্ব আত্না ধারণ করেছে তার দেহ আর মন। আর সেই দেহ-মন-আত্নার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আজ সমবায়ের বাতাস।

প্রশ্ন আসবে, তাহলে আফ্রিকা কেন এখনও সব থেকে পিছিয়ে পড়া মহাদেশ! মধ্যপ্রাচ্য খনিজতেলের মহিম সম্পদে কুবেরকেও হার মানায়। তা সত্বেও কোথাও কোথাও নিদারুণ খাদ্যাভাব! কোথাও বা আবার অভাব অন্য। খাদ্যভাব না থাকলেও সামাজিক তথা পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্যের শিকার। মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আধুনিকতা গ্রহণে অনীহা। শুধু কি তাই! মধ্যপ্রাচ্যের  রাজনৈতিক মানচিত্র ও গণতন্ত্রের সুঠাম ভিত্তিতে ইমারত গড়ে তুলতে পারেনি। এক্ষেত্রে বিশ্বমানবতা কী বলে! যেমন পাকিস্তানের একটা বড় সংখ্যার মানুষ ভারত-বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের পক্ষে। প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় উপচে উঠছে হৃদয়ের উষ্ণতা। অথবা, মনান্তরের অবসান ঘটে যাচ্ছে নিভৃত সংলাপে। পৃথিবীর সমস্ত বিরোধ এইভাবে ক্ষয় পেতে পেতে একসময় হয়তো ভোঁতা হয়ে যাবে সমস্ত কাঁটাতার।

পাশাপাশি আরেকটা নাম আসবে অনিবার্য ভাবেই, সেটা  হল চীন। চীন কিন্তু এই বিশ্বমানবতার সাগরতীরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রুপে অনেকটাই স্বতন্ত্র রেখে দিতে পেরেছে। এই দেশের সবকিছু খুব সহজে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় না! তার মানে যে স্বপ্নের বাস্তবায়নের কথা এত বাড়িয়ে-টারিয়ে  বলার চেষ্টা  করলাম, তা হয়তো নেহাত কথার কথা। হয়তো আংশিকভাবে আমরা খন্ডিত বিশ্বমানবতার সদস্য। খুব সর্তকভাবে কেউ কেউ নিজেকে স্বতন্ত্র রেখে অবশিষ্ট বিশ্বের গতিবিধির উপর রাখছে শ্যেনদৃষ্টি। যে কোনও সময়ে সে সমস্ত হিসেবের গুটি রেখাচিত্র বদলে দিতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী যে  আগ্রাসন আমরা দেখেছিলাম বিগত শতাব্দীতে, তা কিন্তু আজ স্বরূপে নেই। প্রযুক্তির ঘেরাটোপে আমাদের বন্দী করে রচিত হয়ে যাচ্ছে না তা নয়া সাম্রাজ্যবাদের ডিজিটাল সংস্করণ! যে ইন্টারনেটের জালে অচতুর মীনশাবকের মতো আমরা আনন্দ-বেদনায় খাবি খাচ্ছি, সেখানেই সেই অদৃশ্য পথ দিয়ে প্রবেশ করে কেউ আপনার আমার মাথার ঘিলুর মাপ আর বুদ্ধি তথা হৃদয়বত্তার ছাপ তুলে নিয়ে যাচ্ছে না তো! আমাদের স্ক্রিনটাচের প্রতিটি সন্ধি আর উদ্দেশ্য বিধেয়ের বিস্তারিত প্রলাপ আর বিলাপ কোথাও কোনও তথ্য ব্যাংকে জমিয়ে তুলছে না তো অর্থের অশুভ পাহাড়! যদিও সেই পাহাড়ের মালিক আপনি বা আমি নই! তাহলে এ কেমন খেলা!  যে খেলায়
আমরা শুধুই ক্রীড়নক! বৃহত্তম জালে আমাদের বন্দি করে পিছন থেকে খেলছে বিরাট কোনও শয়তান "শিশু "! তারই পরিনামে হয়তো আমরা এবার দেখতে পাব নতুন নতুন ভাইরাস বধূদের, যার এমনই লাজ যে তার প্রকৃত মুখ ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করতে করতে কেটে যাবে কয়েক বছর! যখন শেষে সেই মিলনের মধুর লগন আসবে, ততদিনে যা হওয়ার হয়ে যাবে। দৃষ্টি বিনিময়ের মূল্য স্বরূপ দিয়ে দিতে হতে পারে আমাদের অমূল্য জীবন। 

এই অত্যাধুনিক সাম্রাজ্যবাদের আয়ুধ কি তাহলে এই ইন্টারনেট! বলা হয় যে, কিছু অসাধু সংস্থা নাকি বাজারে প্রথমে ভাইরাস ছেড়ে দিয়ে আতংক সৃষ্টি করে, পরে তারাই আবার " অ্যান্টিভাইরাস" তৈরি করে অধিক মুনাফা গুছিয়ে নেয়।ব্যাপার কী তবে এরকমই? যে ঘাতক, সে-ই ত্রাতা! যে ত্রাতা সে-ই আঘাতের ছুরি নিয়ে অপেক্ষা করছে গোপনে! যে বৈশ্বিক জানালায় মুহূর্তেই চোখ ফেলে দেখে নিই ইতালির মৃত্যুহার অথবা ক্রিস্টোফার নোলানের নতুন ছবির ট্রেলার, তার আড়ালে অন্য কেউ মেপে নিচ্ছে অন্য কোনও হিসেব!আপনার আমার মেধা বোধ, সে রুচি অরুচির যা-ই হোক, তাদের ব্যবসার সামগ্রী! তার মানে, আমরা মৃত মানুষগুলোর নিকট আত্নীয়ের হাহাকার শুধু দেখালাম না,সেই মুহূর্তে আমার আবেগের প্যারামিটার, হৃদয়ের স্পন্দন কারও হিসেবের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে অন্য কোথাও, অন্য কোনো ভাবে! তাহলে কি মুখ দেখাব না সেই জানালায়! সাধের পশ্চিমা বাতাসকে আর জুড়োতে দেব না অবরুদ্ধ হৃদয়। সমস্ত ধরনের মুক্তির, চেপে রাখা আবেগের স্ফূরণের যে অপার রঙিন সম্ভাবনা হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তাকে কি খালি হাতে ফিরিয়ে দেব। মনখারাপের চলমান যে বিঙ্গাপন দেখিয়ে দেখিয়ে প্রকৃত বা অপ্রকৃত ভাবে আমি সুখী হওয়ার মন্ত্র শিখে নিয়েছিলাম, তা ভুলে যাব! না।এর উওর নেই।এর উওর আপনাকে আমাকেই খুঁজে নিতে হবে। আমরা এই যুগের অভিমন্যু, যারা শুধুই প্রবেশের পথা জানি।এও এক চমৎকার সাপলুডু খেলা, যার রাশটা ইচ্ছায় - অনিচ্ছায়, প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে দিয়ে রেখেছি অন্য মহাজনের হাতে। যার দয়া নেই, মায়া নেই, নেই মহান হওয়ার বিন্দুমাএ বাসনা। পরিবর্তে আছে সীমাহীন ক্রূর লোভ।মানুষের রক্ত,হৃৎপিণ্ডের কচি মাংস,মস্তিষ্কের অর্ধতরল ঘিলু যার প্রিয় খাদ্য। তাহলে এর থেকে পরিএাণের উপায় কী? ওই যে একটু আগে বললাম, আমরা এই যুগের অভিমন্যু, যে এই মায়াজালে বহুসাধে স্বেচ্ছায় বন্দী করেছে নিজেকে আর তার নাম মুক্তি! 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, দৈনিক গড়ব বাংলাদেশ।

এসি


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি