ইয়াবার শুরুটা আনন্দদায়ক পরিণতি মর্মান্তিক, ধ্বংসাত্মক
প্রকাশিত : ১৭:৩৩, ৭ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ২১:২৪, ১০ জুলাই ২০১৮
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
গাঁজা, মদ, হেরোইন ও কোকেন বিগত শতাব্দীর বহুল পরিচিত মাদক বা নেশাদ্রব্য। পাশাপাশি ফেনসিডিল, আঠা জাতীয় দ্রব্যও নেশার জন্য ব্যবহূত হতো এবং হচ্ছে। এগুলোকে মাদকদ্রব্য বলার চেয়ে বরং বিষ বলাই অধিকতর শ্রেয়। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মাদক জগতে এক নতুন সদস্যের প্রবেশ ঘটে, যার নাম ইয়াবা, যা বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত মাদক। তার নীল ছোবল থেকে সমাজের পুরুষ-নারী,শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন-অসচেতন, ধনী-গরীব, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী কেউই রেহায় পাচ্ছে না।
বলা হচ্ছে, দেশের ইয়াবাসেবীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখের উপরে, যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশই মহিলা। সমাজের রন্ধে রন্ধে বিষপাষ্পের ছড়িয়ে পড়ছে এই ইয়াবা, সবাইকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করছে।
ইয়াবা মূলত থাই শব্দ, যার অর্থ ক্রেজি মেডিসিন বা পাগল ওষুধ। মূল উপাদান মেথঅ্যামফিটামিন, এক ভয়াবহ মাদক যা মস্তিষ্ক, হূদযন্ত্র এবং শরীরের যে কোনো অঙ্গকেই আক্রান্ত করতে পারে।
যতদূর জানা যায় সর্বপ্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাদের নিদ্রা, ক্ষুধা ও ক্লান্তিহীন করার জন্য এই মেথঅ্যামফিটামিন খাওয়ানো হতো। সেনারা হয়ে উঠত হিংস্র, ক্লান্তিহীন ও আগ্রাসী।
কিন্তু পরে আসক্ত যুদ্ধ ফেরত সেনারা মানসিক অবসাদে ভুগত এবং আরও হিংস্র হয়ে উঠত। এক সেনা আরেক সেনাকে গুলি করে মারত, আবার কখনো নিজে আত্মহত্যা করত। ধীরে ধীরে এর কুফল বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদঘাটিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
কিন্তু বিশ্বের কয়েকটি দেশে এর উত্পাদন চলতেই থাকে, এমনকি মেথঅ্যামফিটামিনের সঙ্গে ক্যাফেইন বা হিরোইন মিশিয়ে ব্যবহূত হতে থাকে মাদকদ্রব্য হিসেবে। বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙ্গুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার, সবুজ বা লাল কমলা রং।
ইয়াবা নামের ছোট্ট এ ট্যাবলেটটি দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো, স্বাদেও তেমনই। ফলে আসক্ত ব্যক্তিরা এর প্রচন্ড ক্ষতিকর প্রভাবটুকু প্রথমে বুঝতে পারে না। তাছাড়া আকারে অত্যন্ত ছোট ওয়ালেট এবং ভ্যানিটি ব্যাগেও এটি বহন করা ও লুকিয়ে রাখা যায়। অধিকাংশ মাদকসেবী ট্যাবলেটটি মুখেই গ্রহণ করে।
অনেকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের ওপর রাখা অপর প্রান্তে তাপ দিয়ে গলিয়ে যে ধোঁয়া বের হয়, তা নি:শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে, যা তত্ক্ষণাৎ মস্তিষ্কের বিশেষ অংশকে আন্দোলিত করার মাধ্যমে ডোপামিন নি:সরণ করে, যা তাকে দ্রুত উত্তেজিত ও উত্ফুল্ল করে স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়।
আবার ট্যাবলেটটি গুড়ো করে পানিতে মিশিয়ে সিরিঞ্জের মাধ্যমে শিরাপথে সরাসরি রক্তেও ঢুকিয়ে দেয় অনেকে। ইয়াবাকে আরও বলা হয় আপার ড্রাগ। কারণ এটি শুরুতে সেবনকারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তোলে।
একবার সেবন করলে ইয়াবার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে। ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা, তারা বাস করে স্বপ্নের এক জগতে। তাই অনেকেই নানা রকম হতাশা-ব্যর্থতা, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ এবং অসৎ সংসর্গে শুরু করে ইয়াবা সেবন।
ইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে যৌন-উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে এটি। যাদের ওজন বেশি, তাদের কেউ কেউ স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে শুরু করে ইয়াবা সেবন। আবার কিছু কিছু শিল্পীরাও ইয়াবা সেবন করেন তাদের শিল্পকর্মের দক্ষতা বাড়বে মনে করে। রাত জেগে বেশি বেশি পড়াশোনার জন্য ঘুম কমানোর ওষুধ হিসেবেও অনেকে সেবন করেন ইয়াবা।
এভাবে সাময়িক লাভের ট্যাবলেটটি কখন যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তা তারা টেরও পায় না। আসলে ইয়াবা নামক এই দানবটি শুরুতে সত্যিই আনন্দদায়ক, উদ্দীপক, উত্তেজক যা সাময়িকভাবে উচ্ছসিত ও রোমাঞ্চিত করে। কিন্তু শেষ পরিণতি হয় বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক, হূদয়বিদারক এবং ধ্বংসাত্মক।
দেখা যায় কিছু দিন ইয়াবা সেবনের পর শুরু হয় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কৌতূহলবশত কয়েক দিন সেবনের পরই আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌছে যায় যে, এটি ছেড়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ইয়াবা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। তখন এই মাদক পেতে যে কোন হীন অপকর্ম করতেও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
প্রথমে কম মাত্রায় এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে হয়। আগে যেটুকু ইয়াবা আনন্দ এনে দিত, পরে ওই মাত্রায় আর কাজ হয় না। বাড়াতে হয় ট্যাবলেটের পরিমাণ, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গও।
রাত কাটে নির্ঘুম, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, গলা মুখ শুকিয়ে আসে, অনবরত প্রচন্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়ে। এর সঙ্গে বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দেহে আসে মানসিক অবসাদ, চিন্তা আর আচরণে বৈকল্য।
মেজাজ খিটখিটে হয়, অহেতুক রাগারাগি, ভাংচুরের প্রবণতা বাড়ে। মানুষ আর মানুষ থাকে না। হয়ে উঠে হিংস্র, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ন্যায়, অন্যায় বোধ লোপ পায়, হয়ে উঠে অপরাধপ্রবণ। বিঘ্নিত হয় সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা, ব্যাহত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্রোতধারা। এই ভয়াল মাদকের করাল গ্রাসে তারুণ্য, মেধা, বিবেক, মনুষ্যত্ব এমনকি স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা আর পারিবারিক বন্ধন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়।
এদিকে যেমন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে, তেমনি মাদকাসক্ত অনেক তরুণ-তরুণী সন্ত্রাস, দুনীতি, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এমনকি খুনও করে নেশার টাকা যোগাড় করার জন্য। মা-বাবার গলায় ছুরি ধরে টাকার জন্য, বুকে বসে ছুরি চালাতেও তার হাত কাপে না। নেশার টাকা না পেয়ে নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ক্রোধে খুন করে নিজ সন্তানকে, এমনকি স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মত অমানবিক ঘটনাও ঘটেছে হর-হামেশা।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে এসব ঘটনার দায় পড়ে মাদকসেবীর ঘাড়ে, কিন্তু একটু গভীর ৃদৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, কোনো কোমল হূদয় বা মানুষের বিবেক এই খুন বা অপকর্ম করে না, করে ইয়াবা নামক এক ভয়ানক সর্বনাশা মাদক। এই মাদক জীবন থেকে জীবন আর হূদয় থেকে আবেগ অনুভূতি কেড়ে নেয়। আলোর পথে ছেড়ে নিয়ে যায় অন্ধকার পথে।
স্বাধীন হৃদয় পরিণত হয় নেশার দাসে। মানসিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি এক সময়ে শরীরেও প্রভাব পড়তে শুরু করে। হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, লিভার, কিডনী থেকে শুরু করে শরীরে সব অঙ্গই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইয়াবা খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়, মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং ছিড়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
যৌন উদ্দীপক হিসেবে গ্রহণ করা হলেও আসলে যৌন ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শুক্রানো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সন্তান উত্পাদন ক্ষমতাও কমে যায়। মেয়েদের ঋতুস্রাবেও সমস্যা হয়। বেশি পরিমাণে নেওয়া ইয়াবা সেবনের ফলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে।
এছাড়া কয়েক ঘন্টা বা নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর আবার না নিলে শরীরে ও মনে নানা উপসর্গ দেখা দেয়, ফলে বাধ্য হয়েই আসক্ত ব্যক্তিরা আবার ফিরে যায় নেশার জগতে।
(পরবর্তী সংখ্যায় ইয়াবা থেকে মুক্তির পথ)
লেখক: ডীন, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
/ এআর /
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।